
ছোট্ট শহর ক্যাম্পবেলফোর্ড
ছোট্ট শহর ক্যাম্পবেলফোর্ড, মাঝখান দিয়ে বয়ে চলছে ট্রেন্ট নদী। ঝকঝকে নীল জল। রোদের ছোঁয়ায় ঝিকমিক করছে। ৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীটি যেন এখানে এসে শান্ত হয়ে বসেছে। আমি এই নদীকে চিনি সেই পিটারবোরোতে ঘুরতে যাবার দিনগুলো থেকে। এমন অনেক কিছু চিনেছি ছোট ছোট শহর, কাছ থেকে। ভীষণ ভালো লাগে এ দেশের ছোট শহরগুলো। কেন লাগে?
হয়তো এ রকম কোনো ছোট শহরে আমার জন্ম নেওয়ার কথা ছিল। এই শহরগুলো আমাকে ডাকে। ভালোবাসি সেসব শহরের নিরিবিলি পথের বাঁক, কোলাহলহীন উষ্ণতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নেইবারহুড। সবাই সবাইকে চেনে, জানে, মায়ামাখা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ভালো আছো তো! কিংবা আরও আন্তরিক হলে নির্দ্বিধায় জিজ্ঞেস করবে– বড় শহরে যাচ্ছি, তোমার কি কিছু লাগবে? সপ্তাহে এক-দু’দিন ফার্মারস মার্কেটে টাটকা ফলের ঘ্রাণ, ঘরে বানানো জ্যাম, জেলি, মধু, ব্রেড, ম্যাপেল সিরাপ। ছুটির দিনে স্মল টাউনের পাব-রেস্টুরেন্টে গিটারের লোকপ্রিয় সুর শুনতে শুনতে আধা ঘরোয়া আধা ট্র্যাডিশনাল ডিনার, সঙ্গে হালকা নেশামাখা বিয়ার কিংবা ওয়াইন। ঢালো, খাও আর গলা ছেড়ে শিল্পীদের সঙ্গে গলা মেলাও। কেউ তোমাকে নিষেধ করবে না।
এ ধরনের ইচ্ছে এবং কল্পনা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় ছোট শহরের দিকে। তাই হয়তো ঘুরেফিরে পৌঁছে যাই সেসব আঙিনায়। এ দেশে যাকে স্মল টাউন বলে ডাকা হয়। সুযোগ পেলেই হলো, আমি আছি তোমার পথে হে ছোট শহর।
দীর্ঘদিনের বন্ধু জুলিয়ানা ও মার্টিনের ইচ্ছে আমার সঙ্গে দু-তিন দিনের একটা ট্রিপে যাবার। হতে পারে সেটা টরন্টোর আশপাশে কিংবা কিছুটা দূরে। ওদের অনুরোধে পছন্দসই জায়গা খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমি নিলাম। জিজ্ঞেস করলাম ওদের কোনো প্রায়োরিটি আছে কিনা। জানাল– এমন জায়গা হলে ভালো হয়, যেখানে এখনও ওদের যাওয়া হয়নি এবং সেটা লং-উইকেন্ডের সময় হলে আরও ভালো হয়। খুশি হলাম। এদিকে আমার নিজেরও অনেক দিনের ইচ্ছে অন্টারিওর ছোট শহর ক্যাম্পবেলফোর্ডের ‘জায়েন্ট টুনি’ মনুমেন্ট দেখতে যাবার। টরন্টোর উত্তর-পুবের কিছুটা বড় শহর পিটারবোরোতে যখন গিয়েছিলাম, সেখান থেকে মাত্র বায়ান্ন কিমি পুবে ক্যাম্পবেলফোর্ড, কিন্তু সময়ের অভাবে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এবার সেখানে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে ভেবে বেশ লাগছে। এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো, পিটারবোরো ও ক্যাম্পবেলফোর্ড একসঙ্গে ঘুরে আসার প্রস্তাব দিলাম।
পিটারবোরো শহরটি অনেকের কাছে পরিচিত, কিন্তু ক্যাম্পবেলফোর্ড? তা সেখানে দেখবার মতো কী আছে? ক্যাম্পবেলফোর্ডে রয়েছে রেনি গর্জ সাসপেনশন ব্রিজ, জলপ্রপাত, ফেরিস প্রভেন্সিয়াল পার্ক এবং জায়েন্ট টুনি অর্থাৎ দুই ডলারের বিশাল আইকনিক মনুমেন্ট। আরও কত কিছু! ওদিকে পিটারবোরোতে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু হাইড্রোলিক লিফট-লক। বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেনু, কায়াক এবং প্যাডেল ওয়াটার-ক্রাফট দিয়ে সাজানো কানাডিয়ান কেনু মিউজিয়াম। আদিবাসীদের ঐতিহ্যময় শিল্পসামগ্রীর আর্ট ও ক্রাফট গ্যালারি ‘হোয়েটাং ওজিবোয়ে’। আমার মুখে এসব বিবরণ শুনে বন্ধুরা বেশ উৎসাহী হয়ে উঠল। তাহলে সত্যি সত্যি যাওয়া হচ্ছে! সেই কবে থেকে বিশাল একটি শৈল্পিক ইশারা হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মনে মনে বলি, জানি তুমি অপেক্ষায় আছ ক্যাম্পবেলফোর্ড, এবার আসছি তোমার প্রকৃতি ও শিল্পের কাছে!
আমরা বেরিয়ে পড়লাম ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে, লেবার-ডের লং-উইকেন্ডে। দুটো গাড়িতে করে মার্টিন, জুলিয়ানা, ওদের দুই সন্তান, মার্টিনের যমজ ভাই মাইক এবং আমি। দুই ভাই ড্রাইভ করছে। মোবাইলে যোগাযোগ করে নেওয়া হচ্ছে দুই গাড়ি থেকে। প্রয়োজনে থামা হচ্ছে অন্টারিও প্রভিন্সের হাইওয়ের পাশে গড়ে ওঠা বিশালাকার অনরুট সার্ভিসে। যেখানে রিফ্রেশ রুম, ফুড কোর্ট, ফ্রি ওয়াইফাই ও গাড়িতে গ্যাস নেওয়ার সুব্যবস্থা। ভ্রমণে ক্লান্তি দূর করে স্বস্তি দেওয়ার জন্য এই ট্রাভেল প্লাজাগুলো রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে, অর্থাৎ বছরের ৩৬৫ দিনই খোলা। অন্টারিও প্রভিন্সের হাইওয়েতে এ রকম তেইশটি অনরুট রয়েছে।
চমৎকার আবহাওয়া। সবেমাত্র গ্রীষ্ম শেষ হয়ে শরতের দিন শুরু। তাই আবহাওয়ায় দারুণ একটা পেলবতা। কানাডার তুখোড় গরম শেষ হয়েছে আগস্টে। এখন একটু একটু করে শীতল হতে শুরু করেছে। সবাই জানি যে কানাডা একটি শীতপ্রধান দেশ। এ দেশের অসহনীয় শীতে নাজেহাল হবার জোগাড়। বিশেষ করে আমাদের মতো অভিবাসী এবং বৃদ্ধদের জন্য তা বেশ কঠিন। তাই বলে গ্রীষ্মেও কিন্তু ছেড়ে দেয় না। শুনে অবাক লাগতে পারে! কিন্তু গ্লোবাল ওয়ার্মিঙের কারণে কানাডার তাপমাত্রা ক্রমশ বেড়েই চলছে। গলে যাচ্ছে উত্তর মেরুর বরফের পাহাড়। এখন গ্রীষ্ম এলে অসহ্য রকম গরমের হাঁসফাঁস। বিশেষ করে জুলাই ও আগস্টে এই তাপ চরম, দগ্ধ হবার মতো অবস্থা। চল্লিশ-বিয়াল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তো প্রায়ই থাকে। সিটি তখন নাগরিকদের অকারণে ঘর থেকে বাইরে না বেরোবার জন্য সাবধান করে। বাড়িতে পর্যাপ্ত শীতলতার ব্যবস্থা না থাকলে, দিনের বেলা কাছাকাছি কোনো শপিংমলে চলে যাবার পরামর্শ দেয়। তাছাড়া পথের ফাউন্টেন বা কৃত্রিম ঝরনাগুলোও তখন রৌদ্রক্লান্ত পথচারীদের আরাম দেওয়ার জন্য ব্যস্ত থাকে।
তবে আজ দারুণ একটা মোলায়েম রোদ চোখে-মুখে আদর লেপে দিচ্ছে। সে যেন বলছে, না না ভয় পেয়ো না, একদম উৎপাত করব না। এখন আমি অনেক শান্ত হয়ে এসেছি! শরতের শুরু না!
বেশ। তাহলে বেরিয়েই গেলাম। আমাদের প্রথম গন্তব্য ক্যাম্পবেলফোর্ড। সেখানে সারাদিন কাটিয়ে, তারপর পিটারবোরোতে দু’দিন থেকে টরন্টোতে ফিরে আসব।
আমরা চলেছি অন্টারিও প্রভিন্সের বিখ্যাত হাইওয়ে ফোর-ও-ওয়ান ধরে। ব্রাইটনে এসে তিরিশ নম্বর কাউন্টি রোড ধরে বেশ খানিকটা গেলেই ক্যাম্পবেলফোর্ড। পথে ফ্রেশ হতে, কফি, পানি ও হালকা স্ন্যাকসের জন্য থেমেও ঘণ্টা আড়াইয়ের মধ্যে বেশ নির্বিঘ্নে পৌঁছে গেলাম।
ক্যাম্পবেলফোর্ড, টরন্টো এবং কানাডার রাজধানী অটোয়ার প্রায় মাঝমাঝি এর অবস্থান। ১৮৩৪ সালে এখানে প্রথম হোমস্টেডাররা এসেছিল। এ কারণে জায়গাটি ধনসমৃদ্ধ এলাকা হয়ে ওঠে। আজও তার চিহ্ন হিসেবে সূক্ষ্ম কারুকাজ করা ভিক্টোরিয়ান ডিজাইনের বাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। অন্টারিওর ছোট শহরগুলো ইউরোপিয়ান স্টাইলের সাথে বেশ মিল। এখানে কৃষিজমিবেষ্টিত অনেক খামারবাড়ি রয়েছে। গ্রীষ্মকালে শহরে ফার্মারস মার্কেট অর্থাৎ কৃষকদের বাজার বসে সপ্তাহে দু’দিন।
১৮৭৬ সালে ক্যাম্পবেলফোর্ড গ্রাম তৈরি হয় এবং এরপর ১৯০৬ সালে এটি শহরে পরিণত হয়। ২০০৬ সালে এর শতবর্ষ পালিত হয়েছে। তাকিয়ে দেখার মতো একটি দারুণ স্মল টাউন। হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ানোর জন্যও ক্যাম্পবেলফোর্ড একটি দুর্দান্ত শহর। ট্রেন্ট নদীর পাশে ব্রিজ স্ট্রিট, ব্রিজের চারপাশে দেখার ও করার মতো অনেক কিছু। বোটিং করে ক্যানেল দিয়ে ক্যাম্পবেলফোর্ড শহরকে পুনরায় ঝালিয়ে নেওয়া, সেও এক চমৎকার অভিজ্ঞতা। এ ছাড়া শহরের ঠিক দক্ষিণে ফেরিস প্রভেন্সিয়াল পার্কে রয়েছে প্রকৃতির সাথে এক হয়ে হাইক বা বাইক অ্যাডভেঞ্চারের জন্য দারুণ সব ট্রেল! ক্যাম্পবেলফোর্ডের স্থানীয় জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে তিন হাজারের মতো। তবে এখানকার হ্রদ এবং জলপথ, ট্রেইল এবং ক্যাম্পিং স্পটগুলোর সুবিধা থাকার কারণে, গ্রীষ্মকালে পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে মূল জনসংখ্যার চেয়ে বহুগুণ হয়ে ওঠে।
ক্যাম্পবেলফোর্ডে প্রবেশ করে প্রথমেই আমরা দেখতে গেলাম, তিনশ ফুট দীর্ঘ বিখ্যাত ‘রেনি গর্জ সাসপেনশন ব্রিজ’। পার্কিঙে গাড়ি রেখে উঠে গেলাম ব্রিজের ওপর, আমাদের মতো হাজারও দর্শনার্থী। ব্রিজটি শক্ত ধাতব তার দিয়ে বোনা। কোনো পিলার ছাড়াই দোলনার মতো ঝুলে আছে ট্রেন্ট নদীর ওপর। ব্রিজে গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ, হেঁটে পারাপার হতে হয়। তবে হাঁটার পাশাপাশি সাইকেল নিয়েও যাওয়া যায়।
ব্রিজ থেকে ত্রিশ ফুট নিচের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন পায়ের তলায় শিরশির করে উঠল! নিচে জলপ্রপাতের স্রোতধারা, সেখানে মানুষের ভিড়। কেউ গোসল করছে, কেউবা মাছের নেশায় ছিপ ফেলে বসে আছে। ব্রিজটি ফেরিস প্রভেন্সিয়াল পার্কের সঙ্গে যুক্ত। পার্কের ভিতরে পৌঁছে সবুজ বনভূমিতে শীতল ছায়াঘেরা পথে ঘুরেফিরে কাটিয়ে, ছবি তুলে, প্রকৃতির বিশুদ্ধ বাতাস প্রাণভরে টেনে নিয়ে ফুসফুস সতেজ করে ফিরে এলাম। রেনি গর্জ সাসপেনশন ব্রিজকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।
এবার আমাদের যাত্রা একটি আইকনিক শিল্প স্থাপনার দিকে, যার নাম ‘জায়েন্ট টুনি’। কানাডা মুদ্রার নাম ডলার হলেও, ধাতব তৈরি ডলার ও সেন্টগুলোকে এ দেশে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়ে থাকে। যেমন– এক ডলারকে লুনি, দুই ডলারকে টুনি। সেই জায়েন্ট টুনি দেখব বলেই না এত আগ্রহ নিয়ে ক্যাম্পবেলফোর্ড এসেছি!
সে এক বিশালাকৃতির কানাডিয়ান দুই ডলার। মুদ্রাটি এখন আইকনিক প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত। সোনা ও রুপার মিশেলে তৈরি দুই ডলারের মনুমেন্টটি উচ্চতায় সাতাশ ফুট, ব্যাসে আঠারো ফুট। ট্রেন্ট নদীর পাশে ছোট্ট ওল্ডমিলস পার্কে মনুমেন্টটি স্থাপিত। মনুমেন্টকে ঘিরে পার্কের সবুজ গাছ ও নদীর নীল জলের অপরূপ পরিবেশ মনকে স্নিগ্ধ করে তোলে। পৌঁছানোর সাথে সাথে গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে পড়লাম। ওই তো দাঁড়িয়ে বিশালাকার জায়েন্ট টুনি! অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম স্থাপনাটির দিকে। দেখলাম অনিন্দ্য শিল্পরুচি ও ঐতিহ্য চেতনার সংমিশ্রণে গড়া কী ভীষণ এক নান্দনিক সৃষ্টি!
এটি নির্মিত হয়েছে কানাডিয়ান বন্যপ্রাণী এবং ল্যান্ডস্কেপ শিল্পী ব্রেন্ট টাউনসেন্ডের করা ডিজাইন অনুসরণে। তিনি ১৯৬২ সালে টরন্টোতে জন্মগ্রহণ করেন, বসবাস করছেন ক্যাম্পবেলফোর্ডে। শিল্পীর কিছু কাজ আগেও দেখেছিলাম অ্যালগনকুইন পার্কের আর্ট গ্যালারিতে। যিনি তাঁর চিত্রকর্মকে প্রকৃতির ভাষা ও ভালোবাসায় প্রকাশিত করেছেন। বিশ্বব্যাপী তাঁর সুনাম, পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। শিল্পী ব্রেন্ট টাউনসেন্ড ওয়াইল্ড-লাইফের পক্ষে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। ১৯৯৭ সালে তাঁর আঁকা পোলার বিয়ারের শিল্পকর্মটি কানাডিয়ান দুই ডলার মূল্যের টুনিতে স্থাপন করা হয়। সে কারণে শান্ত সুন্দর নদীতীরবর্তী ক্যাম্পবেলফোর্ড শহরকে দুই ডলার মুদ্রার জন্মস্থান বলেও ডাকা হয়। পরবর্তীকালে এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ২০০১-এ ‘জায়েন্ট টুনি’ মনুমেন্টের জন্ম।
অনেক ক্ষণ রইলাম জায়েন্ট টুনির সঙ্গে। ঢের ছবি তোলা হলো। দুপুর গড়িয়ে প্রায় শেষের পথে, আর একটু পরেই বিকেলকে ছুঁয়ে দেবে। আমার যে এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছে না! কিন্তু দুপুরের লাঞ্চ তো সারাতে হবে। সবাই বেশ ক্ষুধার্ত। অগত্যা উঠতেই হলো। তবে বেশি দূর গেলাম না। মাত্র মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথে বেছে নিলাম ব্রিজ স্ট্রিটের ‘কেপার্স ট্যাপ হাউজ’ রেস্তোরাঁ। বিভিন্ন ধরনের খাবারের সমাহার, সাথে রয়েছে একটি বিশাল প্যাটিও, ইনডোর ডাইনিং এরিয়া, পাশাপাশি কাঠের দোতলাতেও আছে ডাইনিং হল। আমরা ভিতরের কোনো ডাইনিং স্পেসে না বসে, প্যাটিওর সবুজ চত্বরে বসলাম।
রেস্তোরাঁটি ১৯৯৭ সালে ট্রেন্ট নদীর ধারের সুন্দর শহর ক্যাম্পবেলফোর্ডে সেবা দিয়ে এলেও, বাড়িটি কিন্তু তারচে’ আরও একশ বছরের পুরোনো। ১৮৯০ সালের পুরোনো ডিজাইনে তৈরি চমৎকার ঐতিহ্যবাহী বাড়ির আঙিনায় বসে, খাবারের অভিজ্ঞতাও অনেক রোমাঞ্চকর ও আনন্দদায়ক। বলতে হয় দুপুরের খাবার উপভোগ করার জন্য একটি দুর্দান্ত রেস্টুরেন্ট বেছে নিয়েছি আমরা।
যে যার পছন্দের খাবারের অর্ডার করলাম। এখানে এসে আমার কেন যেন ব্রিটিশদের রসুইখানা থেকে উদ্ভাবিত ‘ফিশ অ্যান্ড চিপস’ খেতে ইচ্ছে করছে। অর্ডার দিলাম হ্যাডক মাছের ‘ফিশ অ্যান্ড চিপস’, সঙ্গে একবাটি ফ্রেঞ্চ-ওনিয়ন স্যুপ। কিছুক্ষণের মধ্যে টেবিলে চলে এলো পরিচিত সেই খাবার, তবে রাজকীয় পরিবেশনায়। কাচের প্লেটের ওপর সোনালি রঙের ভাজা মাছ, পাশে একগুচ্ছ ঝলসানো ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ওপরে পার্সলি পাতার গার্নিশ এবং হলুদ রঙের একফালি লেবু ও লেমন গার্লিক সস। চমৎকার সুস্বাদু লাঞ্চ করলাম। শেষে যথারীতি আমার প্রিয় দুধ-চিনিবিহীন ব্ল্যাক কফি তো ছিলই।
আমার আবার অ্যান্টিকসের প্রতি প্রবল দুর্বলতা রয়েছে। যেখানে যাই পুরোনো স্থাপনা খুব টানতে থাকে। খুব ইচ্ছে করছিল জায়েন্ট টুনির কাছাকাছি বেড-অ্যান্ড-ব্রেকফাস্ট ‘এমেলি-ভিল ইনে’ রাতটা থেকে যেতে। এর কাঠের কারুকাজ করা বাইরের ডিজাইন, সাথে রুমগুলোও পুরোনো অ্যান্টিকসের ধাঁচে সাজানো। তবে আধুনিক সুবিধা রয়েছে পুরোপুরি। কিন্তু আমাদের তো থাকা হবে না। আজই চলে যেতে হবে পিটারবোরোতে। সেখানে বাকি দিনগুলোর বুকিং দেওয়া আছে।
ক্যাম্পবেলফোর্ড, এই ছোট্ট শহরটি যেন একটি অনাবিষ্কৃত রত্নখনি। এখানে দেখার এবং করার মতো এতকিছু রয়েছে যে ভাবা যায় না। ‘ওয়ার্ল্ডস ফাইনেস্ট চকলেট’ ফ্যাক্টরির আউটলেটে গিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে আমরাও শিশুদের মতো উচ্ছ্বল হয়ে উঠলাম। আউটলেট স্টোরটি ছোট, কিন্তু দারুণ জনপ্রিয় ও পরিচ্ছন্ন। খুব সুন্দর করে নানান রকমের চকলেট ও গিফট সাজিয়ে রাখা হয়েছে, দামও যুক্তিসংগত। ভালো দামের জন্য বেশি বেশি চকলেট কিনে ফেললাম। বাচ্চারাও তাদের ইচ্ছেমতো নিয়ে নিল। চকলেট আমাদের সবার মনে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিল।
বিকেল ঘন হয়ে আসছে, এবার আরেক শহরের দিকে যাবার পালা। চলে যেতে যেতে আরও একবার ক্যাম্পবেলফোর্ডকে দেখে নিতে পেছন ফিরে তাকালাম। ফেলে আসা সবকিছুর মতো সেও ক্রমশ দূরে সরে সরে যাচ্ছে। ততক্ষণে গাড়ি হাইওয়েতে উঠে গেছে।
মন্তব্য করুন