- আন্তর্জাতিক
- সৌদি-ইরান চুক্তিতে মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তনের বার্তা
আন্তর্জাতিক
সৌদি-ইরান চুক্তিতে মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তনের বার্তা

গত ১০ মার্চ সৌদি আরব ও ইরান তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে বলে ঘোষণা করেছে। এটা ভালো সংবাদ। এ ধরনের চুক্তি উভয়েরই এ মুহূর্তের প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষার বাহিঃপ্রকাশ। সৌদি-ইরানের মধ্যকার সংঘাত অবসান উভয়ের জন্যই প্রয়োজন। কারণ তা উভয়ের জন্যই ব্যয়বহুল এবং ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত। মধ্যপ্রাচ্যের জন্যও তা বিপর্যয়কর। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার রেখে যাওয়া কৌশলগত শূণ্যতা পূরণে এবং নিজেকে বিশ্বস্ত বৈশ্বিক অংশীদার হিসেবে প্রমাণ করতে চীন এখানে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে।
বিগত দুই বছরের কঠিন আলাপ-আলোচনার পর চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বীরা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পর রাতারাতি দেবদূতে পরিণত হবে– এমনটা আশা করা যাবে না। এখনও উভয়ের মধ্যে অনাস্থা ও বিরোধের অনেক বিষয় আছে, যেগুলোর নিষ্পত্তি ও সমাধান ছাড়া সম্পর্ক মসৃণ হবে না।
জাতীয় স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হলে এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির কথা মাথায় থাকলে নবায়নকৃত সম্পর্কটি কার্যকর সম্পর্কে পরিণত হতে পারে। এর বিপরীতও হতে পারে, যদি তা নিছক পরস্পরবিরোধী মতাদর্শ এবং আঞ্চলিক এজেন্ডা দ্বারা প্রভাবিত হয়। রিয়াদ-তেহরান ১৯৯৮ এবং ২০০১ সালে স্বাক্ষরিত সহযোগিতা ও নিরাপত্তা চুক্তিগুলো পুনরায় সক্রিয় করতে একমত হয়েছে। কিন্তু এক যুগব্যাপী চলমান শত্রুতার পরিপ্রেক্ষিতে দু’দেশের সম্পর্ক ১৯৯০-এর পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব না হলেও চ্যালেঞ্জিং।
সত্যিই, তাদের সাম্প্রদায়িক ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ পরের মুখে ঝাল খাওয়ার নীতি সম্পূর্ণ ধ্বংসাত্মক বলে প্রমাণিত। এর কারণে দুই দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ক্ষুণ্ন হয়েছে; অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত এবং সমাজ হয়েছে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। তারা একে অপরের বিষয়ে যত বেশি হস্তক্ষেপ করেছে; তত ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাক, লেবানন ও বাহরাইনের লোকেরা ভোগান্তিতে পড়েছে।
এ কারণে আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়ার চেষ্টা তাদের কাউকেই মুক্তির পথ দেখাবে না। নতুন ও জটিল আঞ্চলিক ব্যবস্থার আলোকে অথবা যে হযবরল অবস্থার মধ্যে তারা এখন আছে, যা তারা নিজেরাই সৃষ্টি করেছে– দু’দেশকে অবশ্যই এমন একটি নতুন ও টেকসই পথের সূচনা করতে হবে, যা তাদের জাতীয় স্বার্থের জন্য তো বটেই; প্রতিবেশীদেরও স্বার্থের অনুকূল হবে।
এ জন্য তাদেরকে প্রথমেই একে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য সমাজকে হেয় করার পেছনে– যে পথ ধরে শুরু হয় অস্ত্র প্রতিযোগিতা; সম্পদের অপচয় বন্ধ করতে হবে।
অন্যান্য দেশের জনগণের মতো ইরানি ও সৌদিরাও চাইবে তাদের নেতারা অন্য দেশে নৈরাজ্য ছড়ানো বা বাহাদুরি প্রদর্শনের পরিবর্তে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় ও গণতান্ত্রিক সম্প্রীতি মজবুতকরণে মনোযোগ দিক।
সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নতুন উপায় হলো, উত্তেজনা ও ক্ষয়ক্ষতি কমানো এবং প্রতিবেশীদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা। প্রকৃতপক্ষে সিরিয়া, ইয়েমেন এবং অন্যান্য দেশের লোকজনের, যারা প্রক্সি সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ছিন্নভিন্ন জীবন পুনর্গঠনে সাহায্য করা দুটি তেলসমৃদ্ধ দেশের নৈতিক দায়িত্ব। চীন ও পশ্চিমাদেরও উচিত এতে সহযোগিতা করা।
আমি বিশ্বাস করি, আঞ্চলিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা সবার জন্যই ভালো; বিশেষ করে যেহেতু তাদের আঞ্চলিক প্রভাব বিদেশি শক্তিগুলোকে সেখানে শোষণ চালাতে সহয়াতা করে এবং এর স্বার্থে দেশগুলোর মধ্যে সংঘাত বাড়িয়ে তোলে।
প্রকৃতপক্ষে এখন রিয়াদ ও তেহরানকে বিদেশি হস্তক্ষেপ বিষয়ে দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে ইসরায়েলের ঔপনিবেশিক ও বর্ণবাদী আচরণে পশ্চিমা সমর্থনের বিরুদ্ধে তাদের সোচ্চার হতে হবে। সন্দেহ নেই, ইসরায়েলই একমাত্র দেশ, যে উপসাগরীয় অঞ্চলের নতুন এ সুসম্পর্কের সরাসরি বিরোধিতা করবে এবং একে নষ্ট করতে এমনকি অন্তর্ঘাতমূলক কিছু সে করে বসতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে সরাসরি কিংবা অন্যের মাধ্যমে বৈশ্বিক শক্তির হস্তক্ষেপের সব চেষ্টা তাদের অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে। চীনও এর অন্তর্ভুক্ত। বেইজিং এখানে সবচেয়ে বড় বিজয়ী। কারণ তারা রিয়াদ-তেহরান চুক্তির মধ্যস্থতা এবং চূড়ান্ত উদযাপনের আয়োজন করেছিল। চীন এ ক্ষেত্রে অনেক বড় বিশ্বস্ততা এবং মর্যাদা অর্জন করবে। কারণ তারা মার্কিন প্রভাবের অধীন বলে বিবেচিত একটা অঞ্চলে জটিল সংঘাত সমাধানে সহযোগিতা করছে।
অধিকন্তু পৃষ্ঠপোষক হিসেবে চীন সম্ভবত পুনর্মিলন ও স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া দেখার জন্য জড়িত থাকতে চাইতে পারে। এর ফলে সে দীর্ঘমেয়াদে তার অর্থনীতি ও সামরিক শক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ তেলসমৃদ্ধ একটা অঞ্চলে আরও বেশি প্রবেশাধিকার পাবে। বিষয়টা অন্যভাবেও বলা যায়। বিভিন্ন আঞ্চলিক মধ্যস্থতায় চীনের প্রধান প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রকে যেখানে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে; চীনকে তার কিছুই করতে হয়নি। বরং সে তার প্রতিপক্ষকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুফতে হটিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেল।
বাইডেন প্রশাসন উপসাগরীয় অঞ্চলের এ নতুন সমঝোতাকে স্বাগত জানিয়েছে এবং এটি ইয়েমেন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। কিন্তু এ বক্তব্য বাইডেন প্রশাসনের ক্ষোভ ও হতাশা আড়াল করতে পারেনি। কারণ বেইজিং এমন সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে কূটনৈতিক অগ্রগতি অর্জনে সফল হয়েছে, যখন ওয়াশিংটন রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতা বন্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের বাঁকা হাসির মুখ তার ক্ষোভ আড়াল করতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ চীন তার এ সাফল্যের মাধ্যমে তথাকথিত আব্রহাম চুক্তিতে সৌদি আরবকে অন্তর্ভুক্ত করার মার্কিন প্রয়াস এবং নতুন পারমাণবিক চুক্তির আড়ালে ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মার্কিন পরিকল্পনাকে দুর্বল করে দিয়েছে। অবশ্য এটা বলার সময় এখনও আসনি যে, চীনা মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত চুক্তিটি ইসরায়েলপন্থি ও ইরানবিরোধী শিবিরকে মজবুতকরণে আমেরিকা-ইসরায়েলের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেবে।
তদুপরি সৌদি আরবও আমেরিকা থেকে সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে নেবে না কিংবা জোট পরিবর্তন করবে না। কারণ তারা সামরিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে পরস্পর অনেক বেশি নির্ভরশীল। কিন্তু অন্যান্য আঞ্চলিক নেতার মতো তারাও তাদের কূটনীতিতে আরও একটি নতুন সম্পর্ক যুক্ত করেছে। যার প্রধান লক্ষ্য হলো নিজেদের স্বার্থগুলোকে সবার আগে সুরক্ষিত করা।
ইরানও তাই করবে। সে ইতোমধ্যে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে এবং ন্যায্য একটা পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মত হয়; ইরান তার সঙ্গেও মিত্রতা গড়ে তুলতে পারে।
অন্য কথায়, সৌদি-ইরান চুক্তি মধ্যপ্রাচ্য ও ভূ-রাজনীতি পরিবর্তনের একটি বার্তাও বহন করে।
মারওয়ান বিশারা: আলজাজিরার সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক; আলজাজিরা থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর মোজাহেরুল ইসলাম, শিক্ষার্থী; গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন