অগ্নিকন্যাখ্যাত মতিয়া চৌধুরী শেরপুর-২ আসনের সাংসদ, ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। দীর্ঘদিন খাদ্যমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রী সংসদ-ডাকসুর নির্বাচিত জিএস এবং ইডেন কলেজ ছাত্রী সংসদের নির্বাচিত ভিপি। ১৯৪২ সালের ৩০ জুন পিরোজপুরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বীর মুক্তিযোদ্ধা এ প্রবীণ নেতা মুক্তিযুদ্ধ ও বিদ্যমান কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফুর রহমান তপন

সমকাল: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম যারা সংগঠিত করেছেন আপনি তাদের মধ্যে অন্যতম। আপনার ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের কিছু স্মৃতি শুনতে চাই।

মতিয়া চৌধুরী: শুরু করতে হয় ৭ মার্চ দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরই বাঙালি বুঝে যায় যে সে স্বাধীন হবে; বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের কথা বলেছেন সে পথে তাকে হাঁটতে হবে। পাড়ায় পাড়ায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মার্চপাস্ট, যুদ্ধপ্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানিদের সঙ্গে আলোচনা চললেও ২৩-২৪ মার্চের দিকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পাকিস্তানের সঙ্গে আর থাকা হবে না। তবে ২৫ মার্চ রাতে যে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ হলো তা কেউ কল্পনাও করেনি। আজকে যে যাই বলুক ত্রিকালদর্শী কেউ হলে হয়তো ওই পরিস্থিতি বলতে পারত। তখন প্রতিদিনই মিছিল-মিটিং করতাম আমরা, নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় না, আজকে এ এলাকায় তো কালকে আরেক এলাকায় এভাবে। যেমন ৭ মার্চের ভাষণ শুনে আমরা মিছিল নিয়ে পুরান ঢাকার দিকে গিয়েছি। তবে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হোসেনের বাসায় একটা বৈঠক ছিল। আমি তখন ন্যাপ করতাম। সে বৈঠকে আলোচনা হলো যে, আজ রাতে কিছু একটা ঘটতে পারে। তখন আমি পুরান ঢাকায় থাকতাম সেখান থেকে খিলগাঁওয়ে আমার খালার বাসায় চলে গেলাম। খিলগাঁও থেকে রাজারবাগ পরিস্কার দেখা যেত। তখন মাঝখানে রেললাইন ছাড়া আর কিছু ছিল না। রাতে সেখানে যে কিছু একটা ঘটছিল, তা বোঝা যাচ্ছিল। মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, ট্রেসার বুলেট, ম্যাগনেসিয়াম ফ্লেয়ারের আলো দেখা যাচ্ছিল। ভোরের দিকে যখন একটু একটু আলো ফুটছিল তখন রাজারবাগ থেকে গুলিতে আহত লোকরা একে একে এদিকে আসতে থাকে। স্থানীয় যারা ডাক্তারি পড়ত তারা তাদের ব্যান্ডেজ করাসহ কিছু চিকিৎসা দেয়; আমরাও সেবাশুশ্রূষা করি তাদের। তখন সবার মাঝে একটা মনোভাব দেখা গেছে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। মুক্তিবাহিনী তো তখনও হয়নি, মানুষ বলত যদি মুক্তি ফৌজ আসে তাহলে তাদের সহযোগিতা দিতে হবে।

সমকাল: আচ্ছা আপনি বললেন ৭ মার্চের সমাবেশে ছিলেন। আপনি ন্যাপ করতেন। আপনার দল কি ওই সমাবেশে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল?

মতিয়া চৌধুরী: তখন তো আসলে দলমত ছিল না। যেমন ৭ মার্চ আমি যে পাড়ায় থাকতাম সেখানে সব চায়ের দোকান বন্ধ ছিল। মনে হয়েছিল, সেখানে কেউ নেই, অথচ পুরান ঢাকায় প্রচুর চায়ের দোকান ছিল, সেগুলো সবসময় গমগম করত। এটাই ছিল ৭ মার্চের পরিস্থিতি। কে কোন দল করে তা কোনো বিষয় ছিল না।

সমকাল: মুক্তিযুদ্ধে কখন, কীভাবে যোগ দিলেন?

মতিয়া চৌধুরী: আমি এপ্রিলের দিকে নরসিংদীর রায়পুরা হয়ে বর্মী-কাপাসিয়া হয়ে সুনামগঞ্জ দিয়ে মেঘালয়ের বালাট দিয়ে সীমান্ত ক্রস করি। সেখান থেকে গৌহাটি হয়ে আগরতলা যাই। সেখানে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের ক্যাম্প ছিল। আমাকে অনেক ঘুরপথে সীমান্ত ক্রস করতে হয়েছে। কারণ আমি ছিলাম খুব নোন (পরিচিত) মুখ; কখন কোথায় খান সেনারা বা তাদের সমর্থকরা আছে এ আশঙ্কায় এ কৌশল নিতে হয়। আমার সঙ্গে আমার স্বামী বজলুর রহমান ছিলেন, আরও অনেকে ছিলেন; যখন যেখানে গেছি সেখানকার স্থানীয় নেতারা আমাদের সহযোগিতা করেছিলেন। আগরতলা থেকে আমি খালেদ মোশাররফের সঙ্গে বক্সনগর ক্যাম্পে গেছি; সেখানে অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং নিয়েছি।

সমকাল: বিভিন্ন জনের লেখা থেকে আমরা জেনেছি যুদ্ধের শুরুর দিকে বামকর্মীদের মুক্তিবাহিনীতে রিক্রুট করা হতো না। আপনি তো ছিলেন খুবই পরিচিত এবং শীর্ষ পর্যায়ের বাম নেতা। আপনি এ ধরনের কোনো পরিস্থিতির মুখে পড়েছিলেন?

মতিয়া চৌধুরী: না, আমি এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি দেখিনি। আমি আজকে আওয়ামী লীগ করি বলে বলছি না। আমি তো সহায়ক সমিতির মিটিংয়ে কলকাতায় গেছি, দিল্লি গেছি। অনেক শরণার্থী ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করার জন্য বক্তব্য দিয়েছি। কোথাও কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। খালেদ মোশাররফ আমাদের ক্রাফট হোস্টেলে এসেছিলেন। সেখানে পার্টিরও ইন্ডাকশন ক্যাম্প ছিল। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনীর ছেলেদের ট্রেনিং হয়েছিল দেরাদুনে। তবে আমাদের ট্রেনিং হয়েছিল আগরতলায়।

সমকাল: আপনার প্রধান দায়িত্ব কী ছিল?

মতিয়া চৌধুরী: ভারী অস্ত্রের ট্রেনিং না নিলেও অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং আমরা পেয়েছিলাম। তবে আমার প্রধান কাজ ছিল আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাযত্ন করা। আগরতলায় সেখানকার সরকার তাদের হাসপাতালের একটা অংশ আমাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করে ভেতরে পাঠানোর কাজও করতাম আমি।

সমকাল: সে সময়কার কোনো স্মৃতি মনে আছে?

মতিয়া চৌধুরী: আমার এখনও মনে আছে, বেতিয়ারায় যে গ্রুপটা শহীদ হলো তাদের একজন মুনীরের একটা কথা। অপারেশনে যাওয়ার আগে সবার শেষে খেতে এসে সে আমাকে বলেছিল, আপা আমার জন্য নাই কিছু? সেদিন হঠাৎ করে কিছু ভালো সবজি পাওয়া গিয়েছিল, তা দিয়ে তৈরি লাবড়াটা বেশ ভালো হয়েছিল। তাই অন্যরা খুব দ্রুত সব খেয়ে ফেলেছিল। আমি খেয়াল করিনি। শুধু ডাল দিয়ে খেয়ে ও চলে গিয়েছিল। ওর ওই কথাটা মনে হলে আমার এখনও চোখে পানি এসে যায়।

সমকাল: মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার একটা স্বপ্ন ছিল। আজকের বাস্তবতার সঙ্গে সে স্বপ্নের মিল-অমিলের বিষয়ে কিছু বলবেন?

মতিয়া চৌধুরী: স্বপ্ন তো ছিলই। তবে স্বপ্ন সবসময়ই বাস্তবতা ও কল্পনার মিশেল। যে বাবা লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান বলে পাকিস্তানের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে বাবাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছিল। আপনি এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারবেন না।

সমকাল: অনেকে আক্ষেপ করে বলেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম তা সফল হয়নি। অনেকে সংবিধানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, সেখানে যেসব অধিকারের কথা বলা আছে তাও তারা পাননি। আপনি কী বলবেন?

মতিয়া চৌধুরী: দেখুন, আমরা একেবারে সব পেয়েছির দেশে বসবাস করছি না। এখানে অপূর্ণতা যদি কিছু থাকে তার জন্য আমি নিজেকেও দায়ী মনে করি। আমার কথা হলো, অপূর্ণতা যদি কিছু থাকে তা তোমরা পূর্ণ করনি কেন? তোমাকে তো কেউ বাধা দেয়নি। এখানে কে কাকে দুষবে বলেন তো। না পাওয়ার বিষয়গুলো নিয়ে আমি কাউকে এককভাবে দায়ী করতে রাজি নই।

সমকাল: এই যে দেশের আর্থিক উন্নতির মধ্যেও চরম দুর্নীতির খবরগুলো আসছে, এসব দুর্নীতিবাজ লোকরা আবার অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ও পাচ্ছে। এগুলো দেখে আপনার খারাপ লাগে না?

মতিয়া চৌধুরী: এগুলো না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। ম্যান ইমিটেটস ভাইসেস নট ভারচুস। এক মণ না এক কলস দুধ জোগাড় করতে আপনার খুব কষ্ট হবে কিন্তু সেটাতে এক ফোঁটা চনা দিলে সব শেষ। তবে আমার একটা কথা আছে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ দেশে কবে চালু হয়েছিল? এ দেশে যে আইন করে বলা হয়েছিল ওমুক খুনের বিচার করা যাবে না- এটা নিয়ে আমরা বিবেকতাড়িত হই না!

সমকাল: নিশ্চয়ই। কিন্তু সেজন্যই তো আপনারা যখন ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করলেন তখন জনগণ আপনাদের সমর্থন দিয়েছে।

মতিয়া চৌধুরী: কিন্তু সেজন্য শেখ হাসিনা হ্যাড টু ওয়েট ফর টোয়েন্টি ফোর ইয়ার্স। জার্নি অব এ ডটার ফর জাস্টিস। এক আত্মজার ন্যায়বিচারের জন্য দীর্ঘ পরিক্রমা। যে জার্নিটা করে, তার কষ্টটা সে বোঝে। তারপর ওয়ান-ইলেভেন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। মৃত্যুকে এত কাছে থেকে আর কে দেখছে বলেন তো? তার পরও সাহসী নেত্রী হয়ে যান খালেদা জিয়া আপনাদের কলমের কারণে, আর শেখ হাসিনা আপসকামী!

সমকাল: একটা সমালোচনা এখন প্রবল যে, দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নানাভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে কাজে লাগিয়ে যে কেউ তার বিপক্ষকে জব্দ করতে পারে। আপনি কী বলবেন এ বিষয়ে?

মতিয়া চৌধুরী: পৃথিবীতে যেখানে বলা হয় গণতন্ত্রের খুব ছড়াছড়ি সেখানেও কি আপনি যা ইচ্ছা তা লিখতে পারবেন? আমেরিকায় পারবেন না, ব্রিটেনেও পারবেন না। লিবারেল হওয়া ভালো, কিন্তু তার জন্য আপনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন? সমাজেই তো তা পারমিট করে না।

সমকাল: একটা উদাহরণ দেই। সাবেক মন্ত্রী খোন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিক প্রবীর শিকদারকে জেলে পুরে দিয়েছিলেন ফেসবুকে তার সমালোচনা করার জন্য।

মতিয়া চৌধুরী: আপনি এমন একটা উদাহরণ দিলেন যেটা...। কিন্তু পরবর্তীকালে কি সে ধারা অব্যাহত ছিল? এটা সেখানে লোকালি কেউ করতে পারে, কিন্তু নেত্রী কি সেটা সাবস্ট্ক্রাইব করেছেন? অনেক সময় ওপর থেকে যেমন সব দেখা যায় না, তেমনি নিচ থেকেও ওপরের বরাভয়টা দেখা যায় না। নেত্রী জাতির পিতার কন্যা আমাদের বরাভয় দিয়েই দেশটারে চালাচ্ছেন। সেটা ক্ষুধায় হোক দারিদ্র্যে হোক কিংবা মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে হোক।

সমকাল: '৭২-এর সংবিধান পুনর্বহালের জন্য আওয়ামী লীগ দীর্ঘ লড়াই করেছে। সে প্রশ্নটি আজও আছে জোরালোভাবে। আপনি কী বলবেন?

মতিয়া চৌধুরী: '৭২-এর সংবিধানের পূর্ণ পুনর্বহাল আমাদের লক্ষ্য। শেখ হাসিনা কি কখনও দাবি করেছেন যে, আমরা ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছে গেছি? উনি তো বই লিখছেন না, উনাকে করে দেখাতে হচ্ছে। দৌড়ের ওপর অনেক বই পড়লাম কিন্তু দৌড় দিতে গিয়ে বুঝলাম সেখানে কত ঘাম ঝরে। আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ।

মতিয়া চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।