- স্বাধীনতা দিবস
- মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন হাতছাড়া হয়ে গেছে
মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন হাতছাড়া হয়ে গেছে

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। একাত্তরের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। স্বাধীনতার ৫১ বছরে রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, 'মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্র হবে সবার। কিন্তু এখন রাষ্ট্র শুধু শাসক দলের বা কারও কারও।' দেশের প্রথম বিরোধী দল জাসদ গঠন করা এই নেতার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজীব আহাম্মদ
সমকাল: যে লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন স্বাধীনতার ৫১ বছরে কতটা অর্জিত হলো?
আ স ম রব: স্বাধীনতা কত বড় অহঙ্কার তা অনেকেই অনুধাবন করতে পারেন না। কিন্তু ৫১ বছরে স্বাধীনতা লক্ষ্য অর্জনে অনেক পিছিয়ে পড়েছি। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার অর্থাৎ একটি গণতান্ত্রিক মানবিক নৈতিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের অঙ্গীকারে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। যেখানে গণতন্ত্র হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক ভিত্তি। নিয়মিত নির্বাচন, সর্বজনীন ভোটাধিকার, সংখ্যালঘুর অধিকার, স্বাধীন বিচার বিভাগের তত্ত্বাবধানে ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল। সর্বোপরি মানুষের মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্র হবে সবার। কিন্তু এখন রাষ্ট্র শুধু শাসক দলের বা কারও কারও। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন হাতছাড়া হয়ে গেছে। গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও নৈতিকতাকে বিপর্যস্ত করা বর্তমান বাংলাদেশ ৩০ লাখ শহীদের প্রতিনিধিত্ব করে না।
সমকাল: স্বাধীনতার মাত্র ১০ মাসের মাথায় আপনারা জাসদ গঠন করলেন। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন না হওয়ার ক্ষোভ, নাকি আপনাদের বিবেচনায় আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে গিয়েছিল বলে?
আ স ম রব: স্বাধীনতার পর জাতীয় ঐক্য ভেঙে 'বিপ্লবী জাতীয় সরকার' প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা ছিল ঐতিহাসিক ভুল। আওয়ামী লীগের এই ভুলে সমাজ রূপান্তরের সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে। ফলে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে মানুষের মনে যে আকাঙ্ক্ষার উদ্ভব হয়েছিল, তা স্বাধীনতার পর বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। যে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই শাসন ব্যবস্থাই দ্রুত স্বাধীন বাংলাদেশে পুনর্বহাল করা হয়। জাতির দুর্ভাগ্য তখন থেকেই শুরু।
বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে সিরাজুল আলম খান বিপ্লবী জাতীয় সরকারসহ ১৫ দফা দাবি বঙ্গবন্ধুর কাছে দিয়েছিলেন। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেওয়া সব দল ও উপদলকে নিয়ে জাতীয় সরকারের কথা বলেছিলেন। ১৫ দফা উপেক্ষা করায় মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনির্মাণের তাগিদে জাসদ গঠিত হয়েছিল।
সমকাল: বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে জাসদের উত্থান হলো। সংঘাতে জড়াল। পরবর্তীকালে নানা ধারায় বিভক্ত হয়ে টিকতে পারল না।
আ স ম রব: শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থার লড়াইয়ে জাসদ বাহাত্তর সাল থেকেই নিপীড়নের শিকার। বহু মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র-যুবককে স্বাধীন দেশে জীবন দিতে হয়েছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মী-সংগঠককে বিনাবিচারে কারাগারে থাকতে হয়েছে। পঁচাত্তরের পরবর্তী সরকারও অত্যাচার অব্যাহত রাখে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দলের অনেকবার ভাঙনে। অনেক বিতর্কের জন্ম হয়েছে। আমাদেরও ভুলভ্রান্তি হয়েছে। ইতিহাসের নির্ধারিত দায় থেকে কারও রেহাই পাওয়ার উপায় নেই।
সমকাল: জাসদের পথই ভুল ছিল, নাকি পথভ্রষ্ট হয়েছে?
আ স ম রব: সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র' প্রতিষ্ঠার লড়াই আমাদের প্রচণ্ড প্রতিকূলতায় ফেলে, বিপজ্জনক অবস্থায় ঠেলে দেয়। শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী জনগণের দেশ শাসনে সাংবিধানিক কর্তৃত্ব, সংসদের উচ্চকক্ষ, ৯টি প্রদেশ, প্রাদেশিক সংসদ ও সরকার, সাংবিধানিক আদালত, শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রবর্তনসহ সুস্পষ্ট সাংবিধানিক প্রস্তাব ও কর্মসূচি জাসদের ছিল। লক্ষ্য বাস্তবায়নে সমাজ বাস্তবতার নিরিখে অনেক কৌশল নিতে হয়। কখনও কখনও তা ব্যর্থ হয়।
সমকাল: স্বাধীনতার পর জাসদের কর্মকাণ্ড এবং পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো উল্টো পথে চলেছে বলেই মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি-আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা প্রায়ই এমন অভিযোগ করেন...
আ স ম রব: পঁচাত্তরের আগেই রাষ্ট্র উল্টো পথে চলতে শুরু করেছিল। জনগণের কণ্ঠরোধ, একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা, সংসদীয় ব্যবস্থার বিলোপ, বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের অধীনে আনা, সংসদের মেয়াদ বাড়ানোর মতো অসাংবিধানিক কাজ রাষ্ট্রকে গভীর সংকটে নিপতিত করে। পঁচাত্তরে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানের মৌলিক কাঠামো আওয়ামী লীগই ধ্বংস করেছিল। রক্ষীবাহিনী গঠন, জরুরি অবস্থা, দুর্নীতি ও দুর্ভিক্ষ, অস্থির রাজনীতি, ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বঙ্গবন্ধুর সরকারকে গভীর সংকটে নিক্ষিপ্ত করে। শুধু আত্মসর্বস্ব বাগাড়ম্বর ছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে রাজনৈতিক মূল্যায়ন করেনি আওয়ামী লীগ।
সমকাল: বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য আপনাদের দায়ী করা হয়...
আ স ম রব: সত্তরে বিশ্বের নানা প্রান্তে সকালে-বিকালে ক্যু পাল্টা ক্যু হয়েছে। আমেরিকা, চীন, সৌদি আরবসহ সবখানে ক্যু হয়েছে। তারপরও বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার ব্যবস্থা তার সরকারই করেনি। বঙ্গবন্ধু ১৫ আগস্ট রাতে যাদের সহযোগিতা চেয়েও সাড়া পাননি, যারা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দেয়নি, তারা সবাই পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের এমপি, মন্ত্রী হয়েছেন। এটাই বঙ্গবন্ধুর প্রতি আওয়ামী লীগের কৃতজ্ঞতা! মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানে দেশের একজন মানুষও ছিল না। ছিল শুধু আওয়ামী লীগ।
সমকাল: আওয়ামী লীগের সমালোচনায় মুখর হলেও ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকারে মন্ত্রী হয়েছিলেন। খুব কাছ থেকে দেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর এবং শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্থক্য দেখেন?
আ স ম রব: শুধু একটি কথা বলব। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- 'আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। বাংলার মানুষের অধিকার চাই'। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়- এই ধ্রুব সত্য মেনে নেওয়ার সক্ষমতা এই আওয়ামী লীগের নেই।
সমকাল: মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগকেই দায়ী করছেন বারবার। তাদের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলছেন?
আ স ম রব: গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ভোটাধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাবিহীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের আশা-আকাঙ্ক্ষার অবস্থান কোথায়? এই প্রজাতন্ত্র আর শহীদের রক্তে অর্জিত প্রজাতন্ত্র নয়। একজন ছাত্র মেধা-যোগ্যতায় বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও শুধু দলীয় কারণে চাকরিতে যোগ দিতে পারছে না। এ ধরনের অন্যায় বিশ্বে বিরল। বাংলাদেশ আর প্রজাতন্ত্র নয়। গুম খুন করে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে। রাষ্ট্রকে দলীয় সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়েছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে সমাজে বড় ধরনের বিদ্রোহ হবে। বিস্ফোরণ ঘটবে।
সমকাল: পরিবর্তনের জন্যই তো বিএনপিকে নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট করলেন; ব্যর্থ হলেন। এখন আপনাদের ভিন্নমতও দেখা যাচ্ছে। বিএনপি নির্দলীয় সরকারের দাবি করছে, কিন্তু আপনারা জাতীয় সরকারের কথা বলছেন...
আ স ম রব: আগেরবার দিনের ভোট রাতে করেছে আওয়ামী লীগ। দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর সামনে ঐক্যফ্রন্ট তা প্রমাণ করতে পেরেছে। এটাই ঐক্যফ্রন্টের সফলতা। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী কর্তৃত্ববাদী চরিত্র বিশ্বব্যাপী উন্মোচিত হয়েছে ঐক্যফ্রন্টের কারণেই। দিনের ভোট রাতে- এই কলঙ্ক উন্নয়ন দিয়ে ঢাকা যাবে না। ভবিষ্যতে ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হবে। আইয়ুব খানও দৃষ্টিনন্দন সংসদ ভবনসহ বহু উন্নয়নের বয়ান জারি করে গেছে। কিন্তু ইতিহাস তার উন্নয়ন মনে রাখেনি, তাকে স্বৈরাচার হিসেবেই চিহ্নিত করেছে।
সমকাল: নতুন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের আশাবাদ জানাচ্ছে। কতখানি আশা করেন?
আ স ম রব: ভোটের অধিকার সুরক্ষার চেতনা থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। সেই স্বাধীন দেশে বর্তমান সরকার জনগণকে ভোট থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এর যে কী ভয়ংকর পরিণতি হবে, সরকার তা বুঝতে অক্ষম।
সমকাল: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদর্শ, লক্ষ্য কি শুধু কথামালাতেই থেকে যাবে? এখনও কি আশা আছে, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে?
আ স ম রব: বিশাল আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশ পরাজিত হতে পারে না। একদিন নিশ্চয় জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে।
মন্তব্য করুন