
সাতে শূন্য সত্তর, সাতের পিঠে এক একাত্তর। হ্যাঁ, গণিতে সত্তরের পরেই একাত্তর। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের ধারাপাতে এই নামতা যে চিরস্থায়ী হয়ে যাবে তা কে জানত? তবে আমরা যারা ইতিহাসের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে ঘটনার স্রোতধারায় ছিলাম, রাজপথের উত্তাল মিছিলে ছিলাম, নির্বাচনের ডামাডোল দেখেছি তারা টের পাইনি কখন মুক্তিযুদ্ধের মোহনায় সাগরসঙ্গমে এসে পড়েছি। এ যেন ছিল স্বতঃসিদ্ধ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা এক দিনে আসেনি। বস্তুত ১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ধাপে ধাপে গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন ও সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের জন্য আন্দোলনের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৭১-এ মার্চে মুক্তিযুদ্ধে পৌঁছে যাওয়ার আগে সেই দীর্ঘ সিঁড়ির শেষ ধাপটি ছিল ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন।
প্রধান দুটি দিক থেকে ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল ঐতিহাসিক। প্রথমত, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পরে গোটা দেশে ওটাই ছিল প্রথম সাধারণ নির্বাচন। হাজার মাইলের ব্যবধানে পূর্ব ও পশ্চিমের দুটি পৃথক ভূখণ্ডের একটি রাষ্ট্র পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ছিল এমনই শোষক, স্বৈর ও বেইমান চরিত্রের যে তারা প্রতিশ্রুতি দিলেও এত দীর্ঘ সময় পাকিস্তানে নির্বাচন হতে দেয়নি। ১৯৫১ সালেই একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান এবং ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইউব খানের নেতৃত্বে প্রথম সফল সামরিক অভ্যুত্থানের পর যুগ যুগ ধরে দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাস প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, ক্যু ও হত্যাকাণ্ডে পরিপূর্ণ। পাকিস্তানে এখনও তা-ই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সাড়ে তিন বছরের মাথায় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। বাংলাদেশেও সামরিক শাসনের ভূত আছর করেছিল, তবে সংগ্রাম করে আবার আমরা নতুন করে গণতন্ত্রের পথনির্মাণ করছি। এ অধ্যায় আমাদের আলোচ্য নয়।
১৯৭০-এর নির্বাচনকে বোঝার জন্য একটু পুরোনা নির্বাচনের ইতিহাস ছুঁয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
১৯৫৪ সালে প্রথম এক-ব্যক্তি-এক-ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচন হয় পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক আইনসভা বা প্রভিন্সিয়াল লেজিসলেটিভ এসেমব্লির। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা দল মুসলিম লীগের লজ্জাজনক পরাজয় ঘটে ত্রয়ী নেতা হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে প্রধানত চারটি দলের জোট যুক্তফ্রন্টের কাছে। পরিষদে মোট আসন ছিল ৩০৯টি। এর মধ্যে তৎকালীন পৃথক নির্বাচকম লী পদ্ধতিতে মুসলিম আসন ছিল ২৩৭টি। অবশিষ্ট বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ২৩৭-এর ২২৩টিই পায় যুক্তফ্রন্ট। আর এর মধ্যেও ফ্রন্টের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ একাই পায় ১৪৩টি। মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি। সংখ্যালঘুদের আসনগুলোর সিংহভাগ পায় যুক্তফ্রন্ট সমর্থিত প্রার্থীরা। অর্থাৎ ওই নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ বস্তুত ধুয়ে-মুছে যায়, আওয়ামী লীগের প্রতি ব্যাপক গণমানুষের সমর্থন প্রকাশ পায় এবং জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য নূ্যনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে একাধিক দলের গঠিত ঐক্যবদ্ধ জোটের নেতৃত্বে আন্দোলনের ধারা তৈরি হয়, যা পরবর্তীকালে এই দেশে একটি রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়।
'৫৪-তে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়ের পটভূমি ও ভিত্তি ছিল ১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ২১-দফা একটি দাবিনামা যা নির্বাচনী ইশতেহার হয়ে দাঁড়ায়। তাতে ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা, পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও কৃষকসহ ব্যাপক জনগণের স্বার্থে অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া। এতেই বাজিমাত।
তবে নির্বাচনোত্তর যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা একবারেই টিকতে পারেনি। দু'মাসের মধ্যেই কেন্দ্রের পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ৯২-ক ধারা নামে একটি শাসনতান্ত্রিক আইনের ক্ষমতাবলে তা বাতিল ও গভর্নরের শাসন জারি। শেখ মুজিবুর রহমানসহ মাঠের নেতারা গ্রেপ্তার হন। এই চক্রান্ত সফল হওয়ার পেছনে ততক্ষণে শুরু হয়ে যাওয়া যুক্তফ্রন্টের নেতাদের অনৈক্য ও পরস্পরবিরোধিতাও দায়ী।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে একটি শাসনতন্ত্র তৈরি হয়েছিল। তাতে পশ্চিমাঞ্চলের পাঞ্জাব-সিন্ধু-বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশ একীভূত করে 'এক ইউনিট' হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশ গঠিত হয়। শাসনতন্ত্র মোতাবেক নির্বাচন হওয়ার আগেই আবার প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে গভর্নর ইস্কান্দার মির্জার বিদায় ও সামরিক শাসক হিসেবে আইউব খানের আবির্ভাব। মুখ্যত পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থান এবং পাকিস্তানের গণতন্ত্রমনা মানুষের আন্দোলনের ধাক্কায় ১৯৬৯ সালে আইউবের পতন ঘটে।
এই হলো গোটা পাকিস্তানে ১৯৭০-এর আগে একবারও সাধারণ নির্বাচন না হতে পারার করুণ ইতিহাস। আইউবকে বিদায় নিতে হলেও ক্ষমতা দিয়ে যান তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়ার হাতে। তবে তৎক্ষণাৎ জনতার বিরুদ্ধে যাওয়ার শক্তি ছিল না সেনানায়ক ও শাসকগোষ্ঠীর। আয়োজিত হয় গোটা পাকিস্তানে ইতিহাসের প্রথম ও শেষ তথা একমাত্র সাধারণ নির্বাচন।
দ্বিতীয় আরেকটি কারণে '৭০-এর নির্বাচন ঐতিহাসিক। এই নির্বাচন পাকিস্তানকে দু'ভাগ করে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়। সামরিক শাসন রেখেই ইয়াহিয়া ঘোষিত একটি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) বা আইনগত কাঠামো আদেশের অধীনে নির্বাচনটি হয়। ওই কাঠামোয় পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ভেঙে দিয়ে আবার চারটি প্রদেশ ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া হয়। এ ছাড়া সংখ্যাসাম্যের পরিবর্তে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে জাতীয় পরিষদে প্রতিনিধিত্ব ঠিক হয়। ১৯৫৬-র সংবিধানে বাঙালিদের সংখ্যাসাম্য (প্যারিটি) মেনে নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। অর্থাৎ পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যায় ৫৬ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানে ও ৪৪% পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী হলেও কেন্দ্রীয় আইনসভায় দুই প্রদেশে সমান সংখ্যক প্রতিনিধি রাখতে বলা হয়েছিল। এলএফওতে জাতীয় পরিষদের আসন রাখা হয় ৩১৩টি; পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯ ও পশ্চিম পাকিস্তানে ১৪৪। এই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিরোধিতা করেন পশ্চিম পাকিস্তানের মূলধারার রাজনৈতিক নেতারা। আরেকটি বিষয় ছিল নতুন পার্লামেন্ট পাকিস্তানের জন্য ১২০ দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে, কিন্তু তা অনুমোদনের চূড়ান্ত ক্ষমতা থাকবে প্রেসিডেন্টের। এই বিধানটির সমালোচনা হয় দুই প্রদেশ থেকেই। বিশেষত বাংলাদেশে অনেক রাজনীতিক বলেছিলেন, এই বিধানের ফলে নির্বাচন করে লাভ নেই।
কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা বঙ্গবন্ধু এলএফওর পক্ষে-বিপক্ষে কিছুই বলেননি। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ঈগলদৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল কেবল ভোটের মাধ্যমে বাঙালি জনগণের রায়ের ওপরে। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে বিজয়ের জন্য বামপন্থিরা ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে লড়ার পক্ষে আওয়াজ তুলেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এককভাবে আওয়ামী লীগকেই নির্বাচনে নামালেন এবং নির্বাচনকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি ৬-দফার পক্ষে গণভোট বলে উল্লেখ করলেন।
সত্তরের নির্বাচনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
আরও একটি ঘটনা ঘটল। নির্বাচনের তারিখ ছিল জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের ভোট যথাক্রমে ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর। এর আগে ১২ নভেম্বর গভীর রাতে উপকূল এলাকায় প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৫ লাখ লোকের মৃত্যু হয়। প্রায় সব দল নির্বাচন পেছানোর পক্ষে। কেবল বঙ্গবন্ধু নির্ধারিত তারিখে নির্বাচনে অনড়। তিনি পাকিস্তানের শাসকদের কোনো অজুহাত ও সুযোগ দিতে চাননি। কেবল গণরায়টি নিয়ে নিতে চেয়েছেন। এটা তার দূরদৃষ্টি।
মওলানা ভাসানির দল রাজনৈতিকভাবে নির্বাচন বর্জন করে স্লোগান দিয়েছিল 'ভোটের বাক্সে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।' পরে তারাও নিশ্চয়ই বুঝেছেন ভোট না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো কি-না।
ভোটের ফলাফল হলো সংরক্ষিত ৭ নারী আসনসহ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে আওয়ামী লীগের জয়। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে আওয়ামী লীগ। জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানে ১৪৪ আসনের মধ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি পেল ৮৮টি আসন। এই ফলাফলে বাঙালি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার তথা পৃথক রাষ্ট্র পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের জন্য এক অচিন্তনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তা হচ্ছে পাকিস্তানের কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সরকার গঠনের অধিকারী হয়ে যায়। ভুট্টো সাহেব বলেন, তিনি এই জাতীয় পরিষদ বর্জন করবেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একাত্তর সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসানোর ঘোষণা দিয়ে একদিন আগে ১ মার্চ তা স্থগিত করেন। মানুষ স্রোতের মতো রাস্তায় নেমে এসে স্লোগান দেয় 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।'
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণ না করেও জনগণকে বলেন ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে আর আক্রান্ত হলে যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে প্রতিরোধ করতে। 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশের অবসংবাদিত নেতা এবং পুরো পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত না হলে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করার পর স্বাধীনতা ঘোষণার যৌক্তিকতা বিশ্ববাসীর কাছে সহজে প্রতিভাত হতো না। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন আমরা পেয়েছিলাম কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মুসলিম শাসকদের দেশগুলো আমাদের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিল। আবার আমেরিকা-ব্রিটেনসহ সব দেশের মানুষের যে সমর্থন-সহানুভূতি পাওয়া গিয়েছিল তার পেছনেও ছিল বঙ্গবন্ধু যে পাকিস্তানি জনগণের 'আইনসংগত' নেতা সেই অবস্থান। সেটার ভিত্তি ১৯৭০ সালের নির্বাচন। ওই নির্বাচন থেকে ফলাফলটি বের করে আনতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর স্বাধীনতায় উত্তরণে সিঁড়ির শেষ ধাপটি স্থাপিত হয়েছিল।
লেখক
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সমকাল
মন্তব্য করুন