মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য বিরাট এক ঘটনা। কেননা, এই যুদ্ধের মাধ্যমেই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতা এনে দিলেও এর ক্ষয়ক্ষতি এখনও ভোগাচ্ছে আমাদের। অনেকে এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত। আমি যখন চারুকলায় ভর্তি হই, তখন থেকেই ক্যাম্পাসে সরকারবিরোধী আন্দোলন হতো। এসব আন্দোলন মূলত ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু হয়েছিল। তখনকার ছাত্র ও শিক্ষকরা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতেন। এগুলো দেখে ধীরে ধীরে আমিও এর সঙ্গে জড়িয়ে যাই। সেই জড়িয়ে যাওয়া থেকে মুক্তিযুদ্ধে চলে যাই। যুদ্ধের ক্ষত এখনও আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। সে যাক, যুদ্ধের ক্ষত অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো চিত্রকলায়ও লেগেছে। তবে সেই ক্ষতের চেয়ে লাভটাই বরং বেশি হয়েছে। সচেতন যে কেউ আজ স্বাধীন বাংলাদেশের চিত্রকলায় চোখ রাখলেই বুঝতে পারবেন। গত ৫০ বছরে আমাদের শিল্পকলার ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। আগের চেয়ে প্রদর্শনী বেড়েছে। ভাস্কর্য বেড়েছে। ছাত্রছাত্রী বেড়েছে। শিক্ষক বেড়েছে। কাজের ক্ষেত্র বেড়েছে। যুদ্ধের আগে তো ভাস্কর্য ছিল না বললেই চলে। এখন জয়দেবপুরে গেলে চোখ জুড়িয়ে আসে। এমন সুন্দর ভাস্কর্য হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। রাজশাহী গেলে যেমন চোখে পড়বে; তেমনি চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট কিংবা বরিশাল গেলেও চোখে পড়বে ভাস্কর্য।

একসময় কেবল ঢাকা চারুকলা ছিল। আস্তে আস্তে চট্টগ্রাম চারুকলা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছে। একে একে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অসংখ্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা খোলা হয়েছে। শুধু তাই নয়; প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও এখন পড়ানো হচ্ছে চারুকলা। এখন নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচিও তৈরি হয়েছে। আমাদের চিত্রকলায় এভাবে বিগত ৫০ বছরে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।

এখন শিল্পীরাও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন। স্কাল্পচার করছেন, যা একসময় ছিল না বললেই চলে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এক্সিবিশন হচ্ছে। আগে এসব এক্সিবিশন কেবলই ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল। সেই গণ্ডি পেরিয়ে এখন সারাদেশে হচ্ছে দেশি এবং আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী।


এশিয়ান চিত্রকলা প্রদর্শনী হচ্ছে বাংলাদেশে; বিগত কয়েক বছর ধরে। দেশের তরুণদের পাশাপাশি এশিয়ার নামি শিল্পীরা এতে অংশগ্রহণ করছেন। এর মাধ্যমে বাইরের দেশের শিল্পীদের চেয়ে আমাদের তরুণ শিল্পীরা বেশি উপকৃত হচ্ছে। তারা দেশে বসেই দেখতে পাচ্ছে এশিয়ার অন্যান্য দেশের শিল্পীদের ভাবনা এবং তাদের কাজ। এসব কাজ দেখে নিজেদের অবস্থান যেমন জানতে পারছে, তেমনি কোথায় পরিবর্তন আনা দরকার, কোথায় ঘষামাজা দরকার- তাও জানতে পারছে। এই জানার মাধ্যমে তারা নিজেদের নতুন করে তৈরি করতে পারছে। এভাবে গত ৫০ বছরে শিল্পকলার চিন্তাভাবনারও অনেক প্রসার ঘটেছে।

এখন অনলাইনেও অনেক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে তরুণরা। প্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়ে শিল্পকলার প্রতিটি শাখায় অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারছে তারা। আগে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ ছিল না বললেই চলে। যত দিন যাবে, ততই এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ বাড়বে। অথচ আগে এমন সুযোগ ছিল না বললেই চলে। আসলে শিল্পকলা এমন একা মাধ্যম; এখানে যত বেশি চর্চা হবে, ততই পরিবর্তন হবে এবং ভালো কাজ উঠে আসবে।

ভালো কাজের উৎসাহ পাওয়া যায় আরেকটি জায়গা থেকে; তা হচ্ছে ছবি বিক্রি। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রচুর ছাত্রছাত্রী বের হচ্ছে প্রতিবছর। এসব ছাত্রছাত্রী নিয়মিত প্রদর্শনী করছে এবং বিক্রি হচ্ছে তাদের অনেক ছবি। একসময় ছবি বিক্রি হতো না বললেই চলে! এখন বিক্রি বেড়েছে। এই ছবি বিক্রি উৎসাহ বাড়ায় তরুণদের। এতে তারা নতুন কাজের উৎসাহ পায়। তরুণরা এখন দেশের বাইরে যাওয়ারও সুযোগ পাচ্ছে। অন্যরাও যাচ্ছে। এতে বাইরের চিত্রকলার সঙ্গে আমাদের চিত্রকলার পরিবর্তনও তারা অনুমান করতে পারছে।

আগেই বলেছি, কম্পিউটার-ইন্টারনেটের কারণে কাজের ধরনও পাল্টে গেছে। অনেক পরিবর্তন হয়েছে ও হচ্ছে। যেসব পরিবর্তনের কথা আমরা চিন্তাও করিনি। এই পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের মানিয়ে নিতে হবে এবং নিজেদের যোগ্যতা ও পরিমণ্ডল বাড়াতে হবে। করোনার একটা ধাক্কা লেগেছিল শিল্পকলায়। সব মাধ্যমেই এই ধাক্কা লেগেছে। তবে আমরা তা অনেকটা সামলেও উঠেছি। করোনার ভেতরও অনেক প্রদর্শনী হয়েছে। শিল্পীরা অনেক কাজ করেছে। এতসব ইতিবাচক বা আশা-জাগানিয়া সময়ে বসেও শোনা যায় আক্ষেপের গান। একটু সচেতন যে কেউ চিত্রকলায় চোখ রাখলে সেই আক্ষেপের সুর ধরতে পারবেন। আসলে গত ৫০ বছরে দেশে অনেক কিছু বাড়লেও তুলনামূলক বাড়ছে না আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনী আরও ব্যাপক হারে বাড়াতে হবে। স্থাপন করতে হবে আন্তর্জাতিক গ্যালারিও, যা আরও অনেক আগে গড়ে তোলার দরকার ছিল। কিন্তু হয়নি। তবে খুব দ্রুত এই গ্যালারি গড়ে তুলতে হবে।

আরও দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও দেশে স্থায়ী একটা ন্যাশনাল গ্যালারি হয়নি। এটি যে কত বড় ক্ষতি করছে, আমাদের তা বলে বোঝানো যাবে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্ল্যাসিক ছবির স্থায়ী গ্যালারি আছে। দেশ বাদ দিয়ে আমরা বিভিন্ন শহরের দিকে তাকালেও দেখব, অসংখ্য শহরে গড়ে তোলা হয়েছে স্থায়ী গ্যালারি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তো রয়েছেই, কলকাতাতেও আছে স্থায়ী গ্যালারি। সেসব গ্যালারিতে ঢুকলে ১০০ বছর আগে বা ৫০ বছর আগে কী কাজ হয়েছিল, তা সহজেই দেখতে পারেন আগ্রহী দর্শক ও শিল্পীরা, যা তাদের চিন্তার জগতে অনেক সমীকরণ দাঁড় করিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের তরুণরা সেই সুযোগ পাচ্ছে না। সুযোগ হারাচ্ছেন দর্শকও। তা ছাড়া পরিবর্তনের ইতিহাসও জানতে পারছে না আমাদের শিল্পীরা।

আমাদের নির্দিষ্ট সংস্কৃতি আছে। আছে আমাদের অনেক ভালো শিল্পীও। এসব শিল্পীর অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের যে অনেক নামি ও ভালো শিল্পী আছেন এবং ছিলেন, একসময় তা অনেকেই ভুলে যেতে থাকবে; কেবল একটা গ্যালারির অভাবে। তাদের ছবি কোথাও প্রদর্শিত হচ্ছে না। তাদের ছবি সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠান কিনলেও তা স্টোরে ফেলে রাখা হয়েছে। স্টোরে পড়ে থাকা এসব ছবি স্থায়ীভাবে প্রদর্শিত হলে দেশ-বিদেশের শিল্পীরা তা দেখতে পারতেন। দর্শকও মনে রাখতেন এসব শিল্পীকে। শিল্পীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও এতে উপকৃত হতো। অনেকেই হয়তো এখানে টানাপোড়েনের জায়গা দেখাবেন। আসলে আমাদের টানাপোড়েনের জায়গা আছে, তাই বলে একটা স্থায়ী গ্যালারি হবে না- এটা মেনে নেওয়া যায় না। ন্যাশনাল গ্যালারি সরকারকেই গড়ে তুলতে হবে। শিল্পীরা এই গ্যালারি বানান না। এটা সরকারের কাজ। শিল্পকলা একাডেমিও বানাতে পারে। তবে এটি আলাদাভাবে হওয়া উচিত। এটা জাদুঘরের অদলে এবং নিরিবিলি জায়গায় করা উচিত, যাতে মানুষ ছবির মধ্যে ঢুকে যেতে পারে।

আর দেশে মানসম্মত প্রদর্শনী বাড়াতে হবে। তবেই আমাদের চিত্রকলার পরিবর্তন আরও ব্যাপকভাবে হবে। কেবল তাই নয়; আমরা নিজেদের অবস্থান সম্পর্কেও তখন স্বচ্ছ একটা ধারণা পেতে পারব। চিনে নিতে পারব বা খুঁজে নিতে পারব আমাদের শিল্পীদের।

লেখক
চিত্রশিল্পী
মুক্তিযোদ্ধা