তিন মাস 'বোতলবন্দি' থাকার পর জুনের শুরু থেকে ফের করোনা সংক্রমণ নিয়েছে উল্টো বাঁক। গত ৬ জুন নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় ৫ শতাংশের ওপরে উঠে আসে সংক্রমণ হার। দেশে করোনার চতুর্থ ঢেউয়ের ঝাপটা লাগে ২৯ জুন। এবারের সংক্রমণ বাড়ার পর গত ১ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত মারা যাওয়া ১৮ জনের তথ্য পর্যালোচনা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেখানকার পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, মৃত রোগীর ৩৩.৩ শতাংশ টিকা নেননি। আর বুস্টার ডোজ পাননি ৭০ শতাংশ। মৃতদের বয়স ৫০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে। তাঁদের ৫০ শতাংশের বেশি অন্য কোনো রোগে ভুগছিলেন।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেছেন, এমন ছবি দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউয়ের সময়ও দেখা গেছে। তখন দেশে টিকার সংকট ছিল, তবে এখন সেই ঘাটতি নেই। ফলে এ সময়ে এমন তথ্য উদ্বেগজনক। বাদ পড়া ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে খুঁজে বের করে দ্রুত টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও এ তথ্যকে হতাশাজনক বলছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা টিকা ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ডা. শামসুল হক সমকালকে বলেন, দ্রুত টিকা নিশ্চিত করতে কাজ করছে সরকার। মাঝে মধ্যেই বিশেষ ক্যাম্পেইন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ দ্বিতীয় ডোজ টিকার আওতায় চলে এসেছে। টিকা কেন্দ্রগুলো সবসময় খোলা রাখা হয়েছে। এখনও প্রথম, দ্বিতীয় ও বুস্টার ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ২০ থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক মাসে করোনা সংক্রমিত ১২ জনের মৃত্যু হয়। তাঁদের মধ্যে শুধু একজন দুই ডোজ টিকা নিয়েছিলেন। বাকি ১১ জনের কেউই টিকা নেননি। টিকা নেওয়া ব্যক্তিসহ মৃতদের সাতজনের দুই বা তার চেয়ে বেশি সহরোগ (কো-মরবিডিটি) ছিল। মৃতদের মধ্যে আগের তুলনায় এই মাসে কো-মরবিডিটিতে আক্রান্ত সংখ্যা ৮.৩ শতাংশ বেশি ছিল। মৃতদের ৫০ শতাংশের বয়স ছিল ৬১ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে।

গত ২৭ ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত এক মাসে মৃত্যু হয় ১৭ জনের। তাঁদের মধ্যে ১২ জন টিকা নেননি। টিকা নেওয়া পাঁচজনের মধ্যে দু'জন এক ডোজ করে এবং তিনজন দুই ডোজ নেন। মৃত ১০ জনের দুই বা তার চেয়ে বেশি কো-মরবিডিটি ছিল। আগের মাসের চেয়ে কো-মরবিডিটিতে আক্রান্তের সংখ্যা শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বেশি ছিল। মৃতদের মধ্যে ৬১ থেকে ৭০ বছর বয়সী ৫০ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও বলছে, দেশে টিকা পেতে সুরক্ষা অ্যাপে নিবন্ধন করেছেন ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৫ জন। এর মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার প্রথম ডোজ পেয়েছেন ১০৮ শতাংশ মানুষ। দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছে ১০০ শতাংশ। তবে বুস্টার ডোজ পেয়েছেন ২৪.৩৩ শতাংশ মানুষ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে বাকি জনগোষ্ঠীকে আনতে হবে টিকার আওতায়। দরকার হলে নিবন্ধন ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে বুস্টার ডোজের বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে হবে। টিকা নিলে মৃত্যু হার কমে আসে, এটা আমরা তৃতীয় ঢেউয়ে প্রমাণ পেয়েছি। টিকা নেওয়ার কারণে এবার হাসপাতালে রোগী ভর্তি কম হচ্ছে।

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোশতাক হোসেন সমকালকে বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর শতভাগ টিকার আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ৫০ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষ এবং যারা অন্য রোগে ভুগছেন তাঁদের টিকা নিশ্চিত করতে হবে। এমন হতে পারে, দেশের তরুণদের মধ্যে ৮০ শতাংশ টিকা নেওয়া হয়ে গেছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর টিকা অনেক কম পেয়েছেন। ফলে এরা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়াচ্ছে।

চতুর্থ ঢেউয়ে মৃত্যু বাড়ছে :গত তিন দিন ধরে হঠাৎ করেই বেড়েছে মৃত্যু। ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্তদের মধ্যে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ৮ মার্চ এর চেয়ে বেশি মৃত্যুর সংবাদ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। শুক্রবার পাঁচজনের মৃত্যু হয়। বৃহস্পতিবার এই সংখ্যা ছিল চারজনে।

করোনার তৃতীয় ঢেউ গত মার্চে নিয়ন্ত্রণে আসার পর শনাক্ত, পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হারের পাশাপাশি কমে আসে মৃত্যুও। মে থেকে করোনা সংক্রমণ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকার প্রবণতা দেখা গেলেও মৃত্যুর দিক থেকে স্বস্তিকর বার্তাই দিচ্ছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। টানা মৃত্যুহীন দিন হয়েছে তিন মাসের বেশি।

গত ১৬ জুন পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে তা ১০ শতাংশ, এমনকি ১৪ শতাংশ হয়ে যাওয়ার পরও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল কম। কোনো দিন একজন, কোনো দিন শূন্য মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

তবে জুন থেকেই এক পেরিয়ে দুই, দুই পেরিয়ে তিন এবং তিন পেরিয়ে চারজনের মৃত্যুর তথ্য জানানো হয় শনিবার ২৪ ঘণ্টায় ছয়জনের মৃত্যুর খবর এলো। এ সময়ে মোট রোগী শনাক্ত হয়েছেন ১ হাজার ১০৫ জন। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১৩.২২।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ছয়জনের মৃত্যু নিয়ে দেশে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ২৯ হাজার ১৬০ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ছয়জনের মধ্যে তিনজন পুরুষ, তিনজন নারী। তাঁদের মধ্যে ঢাকার তিনজন, চট্টগ্রামে দু'জন, বাকি একজন ময়মনসিংহের বাসিন্দা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৫.৩১ শতাংশ এবং করোনাকালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৩.২১ শতাংশ। এ নিয়ে টানা ১৭ দিন নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ৫ শতাংশের ওপরে। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন আরও ২২৩ জন এবং এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১৯ লাখ ৭ হাজার ৯৯০ জন। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯৬.৫২ শতাংশ এবং মারা গেছেন ১.৪৮ শতাংশ।