জনমিতির হিসাব অনুযায়ী শূন্য থেকে ২৫ বছর বয়সের জনগোষ্ঠীকে তরুণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেশে এ রকম তরুণ এখন মোট জনসংখ্যার ৫৭ শতাংশ। উৎপাদন ও উদ্ভাবনে দেশকে এগিয়ে নিতে সবচেয়ে সক্ষম এই জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও প্রত্যাশা জাতীয় বাজেটে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। 'তারুণ্যের বাজেট' শিরোনামে এক গোলটেবিল আলোচনায় এমন মতামত দিয়েছেন বিভিন্ন খাতের প্রতিনিধিরা। তাঁরা মনে করেন, বাজেটে তরুণদের উদ্যোগ এবং তাঁদের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়নের নীতিনির্দেশনা প্রয়োজন। তবে প্রান্তিক পর্যায়ের তরুণ কৃষক-মজুর থেকে শুরু করে উচ্চস্তরের উদ্যোক্তা তরুণ- কেউই যাতে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা থেকে বাদ না পড়েই, সে বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। দৈনিক সমকাল ও জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল (জেসিআই) ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট সামনে রেখে এ আয়োজন করে। গত ৪ জুন রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে এ গোলটেবিল আলোচনা হয়

এম এ মান্নান

বাজেট পেশের আগে শেষ পর্যায়ে এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিছুটা দেরি হয়ে গেল। তবে বাজেট পেশের পর ও পাসের আগ পর্যন্ত তরুণদের উন্নয়নে উত্থাপিত প্রস্তাবগুলো বিবেচনার সুযোগ আছে। সেখানেও সমাধান না হলে হয়তো কিছুটা ধৈর্য রাখতে হবে। কারণ, এটিই সরকারের শেষ বাজেট নয়। সংলাপ চালিয়ে যেতে হবে। ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনা সহজ করার ক্ষেত্রে আমাদের বড় ধরনের দুর্বলতা আছে, এটা সত্য। এটা হয়তো সংস্কৃতিরই সমস্যা। বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আমাদের খুব প্রয়োজন। এখানে হাত দেওয়া প্রয়োজন। তবে বিনিয়োগ-সংশ্নিষ্ট যেখানে হাতে দিই, সেখানেই সমস্যা। এ কারণে ভয়ে হাত দিই না। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ইমেজ আরও বাড়াতে হবে। বিবিএসেরও কিছু দুর্বলতা আছে। তবে পর্যায়ক্রমে সব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে সরকার। এ রকম উদ্যোগকে সহায়তা করা দরকার। কিন্তু সরকারের তো অভাবের সংসার। টেনেটুনে চলতে হয়। ই-কমার্সেও সম্ভাবনা আছে। যদিও দু-একজনের কারণে ইমেজ কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এখানে বাজেটের বাস্তবায়ন নিয়ে কথা বলেছেন। বাজেট বাস্তবায়ন পরিকল্পনার তুলনায় কম হয়, এটি সত্য। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।


জাফর সাদিক দেশের জনসংখ্যার মধ্যে তরুণের আধিক্য বেশি। শূন্য থেকে ২৫ বছর বয়সের জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার ৫৭ শতাংশ। তাহলে বাজেট তো তাদের কেন্দ্র করেই হওয়া উচিত। তরুণরা কী চায়, তাদের প্রত্যাশা কী; তা জানতে হবে। বাজেটে সেই চাহিদার প্রতিফলন থাকা উচিত। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এখন বিশ্বের ৪০টি দেশের একটি। জিডিপি এখন ৪৫৩ বিলিয়ন ডলার। অথচ ব্যবসার পরিবেশ কিংবা লজিস্টিকসের মতো গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সূচকে এ দেশের অবস্থান ১০০টি দেশের মধ্যে নেই। এর মানে আমাদের ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে অনেক কাজ করতে হবে। ব্যবসার পরিবেশ উন্নত হলে তা তরুণদের উদ্যোগ নিতে সহায়তা করবে। তাহলে যত দিন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা আমাদের আছে, তত দিন তা কাজে লাগাতে পারব।


আবুল কাশেম খান কিছু কোম্পানির ইনসিডেন্টের জন্য আমার মনে হচ্ছে, কেন জানি লকডাউন হয়ে গেছে ই-কমার্সে। ই-কমার্সসহ সব খাতে সহজে ব্যবসা করার সুযোগ দিতে হবে। সংস্কার কার্যক্রমের মধ্যে এগুলো থাকতে হবে, যাতে নতুন উদ্যোক্তারা সহজে একটা ট্রেড লাইসেন্স পেতে পারে। এটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমার ছেলে একটা ই-কমার্স কোম্পানি করছে। কিন্তু আমি দেখলাম, যেসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হচ্ছে, তা খুবই অদ্ভুত। কেন জানি, আমরা কিছু ব্যবসায়ীর জন্য একটা লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছি।
আরেকটি বিষয়ে কথা বলব এবং তা হলো বিকল্প অর্থায়ন। মাননীয় মন্ত্রী এখানে রয়েছেন। আমি বলব, যাঁরা বড় ব্যবসায়ী, তাঁরা কিন্তু সবাই ব্যাংকমুখী। বাংলাদেশে এখনও বিকল্প অর্থায়ন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। পুঁজিবাজারও আবার দু-একটা কোম্পানির জন্য লকডাউন মোডে চলে গেছে। এখানে কিছু বিধিনিষেধ আছে, যা বাজারের জন্য সহায়ক নয়। এসব বিষয় হয়তো বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগে থাকবে। বাজেটেও এ বিষয়ে একটা দিকনির্দেশনা থাকলে ভালো হয়। কারণ আমরা ব্যবসায়ীরা ব্যবসা এবং বিনিয়োগে আত্মবিশ্বাস চাই। যখন যে ধরনের ধাক্কাই আসুক না কেন, সরকার যাতে সব ধরনের নীতি-সহায়তা দিয়ে ব্যবসায়ীদের আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে সহায়তা করে।


শহিদুল্লাহ আজিম আমাদের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের বয়স ৪০ বছরের নিচে। এদের মধ্যে তরুণদের উদ্যোক্তা হতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে। জাতীয় সব উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশ্ববাজারে চাহিদা বিবেচনায় তৈরি পোশাকে কৃত্রিম তন্তুর পণ্য উৎপাদনে এখন ব্যাপক হারে বিনিয়োগ প্রয়োজন। এ ধরনের বিনিয়োগে তরুণদের আগ্রহী করতে ব্যবসা কার্যক্রম সহজ করাসহ অর্থায়নের সুযোগ করে দিতে হবে। বাজেটে বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। ব্যবসা পরিচালনা সহজ করার যত উপায়-উপকরণ আছে, সেগুলো অগ্রাধিকার দিতে হবে। তরুণরা যাতে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে এসে হতাশায় না ভোগে; যেন দেশ ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা না করতে হয়। এ বিষয়গুলো সরকারের নীতি-কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। সরকারের সব নীতিনির্দেশনারও সঠিক বাস্তবায়ন প্রয়োজন। যাঁর যে দায়িত্ব, তিনি যেন সে কাজটি সঠিকভাবে করেন।



এ এইচ এম হাসিনুল কুদ্দুস
তরুণদের সুযোগ করে দিলে অনেক কিছু করার অবকাশ আছে। ই-কমার্সের কথায় আসি। করোনার সময় ই-কমার্সের প্রবৃদ্ধি হার ৩০-৪০ থেকে ৩০০ শতাংশে উন্নীত হয়। এটা আসলে একটা বিশাল সম্ভাবনাময় খাত। তবে সম্ভাবনার তুলনায় এর অবদান এখনও যথেষ্ট কম। সহজ, সাশ্রয়ী এবং নিরাপদ কেনাকাটার স্বার্থে ই-কমার্সের বিকাশ প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে কিছু নীতিনির্দেশিকা আরও যুগোপযোগী করা দরকার। বর্তমানে ভ্যাট আইনে অনলাইনে পণ্য বিক্রয়কে শুধু রিটেইল ব্যবসার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা আছে। ই-কমার্সের বড় একটি অংশ মার্কেটপ্লেস। তাই এর সংজ্ঞা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত ই-কমার্স নির্দেশিকা (SOP) অনুযায়ী সংযোজন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। আমাদের প্রতিদিন গড়ে বিক্রির হার ১ লাখ ২৫ হাজার। এর ভ্যাট চালান সংরক্ষণের দায়িত্ব মার্কেটপ্লেসের ওপর বর্তায় না এবং যা বাস্তবসম্মতও না। ই-কমার্সের বিকাশ এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের স্বার্থে নূ্যনতম করের হার শূন্য দশমিক ১ শতাংশ হওয়া সমীচীন। আমরা নিরাপদ কেনাকাটার পাশাপাশি এ খাতের বিকাশের সুযোগ চাই।



আরিফ খান
১০ বছরের মধ্যে আমাদের বাজেট অনেক বড় হয়েছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি ধরলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৫০০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলো বলছে, ২০৫০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ট্রিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করবে। সুতরাং বাংলাদেশের সামনে অনেক সম্ভাবনা এবং সুযোগ আছে। আমি দেশ নিয়ে সব সময়ই আশাবাদী। তবে খুব বেশি আত্মতৃপ্তিতে যেন আমরা না ভুগি। কারণ, ভিয়েতনামসহ আমাদের অন্য প্রতিযোগীরা আমাদের চেয়েও দ্রুত এগোচ্ছে। সুতরাং আমাদেরও সঠিক নীতির মধ্যে দ্রুত এগোনোর চেষ্টা করতে হব। নীতিটা খুব জরুরি। যেমন খেলাপি ঋণের কারণে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পুনর্মূলধনীকরণের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে। এর পরিবর্তে এ টাকা তরুণদের জন্য তহবিল হিসেবে দেওয়া হলে একদিকে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান হবে; অন্যদিকে সরকারের টাকাও ফেরত আসবে। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারের স্টার্টআপ তহবিল পাঁচ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করছি আমি। এতে তরুণ উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে হাজারো কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ডলারের বিনিময়ে টাকার দর আরও কমানো প্রয়োজন। এর একটা স্থায়ী নীতি দরকার। এতে প্রবাসী আয় বাড়বে। রপ্তানি সক্ষমতাও বাড়বে।


তারিন হোসেন প্রারম্ভিক প্রবন্ধ উপস্থাপনা থেকে আমরা জানলাম যে, দেশের শূন্য থেকে ২৫ বছর বয়সের জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার ৫৭ শতাংশ। জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থেই বাজেটে তাদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বাস্তবতা হচ্ছে, বাজেট আলোচনায় সাধারণত তরুণ প্রজন্মকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অথচ অতিমারি করোনায় সবচেয়ে বড় অভিঘাত তাদের ওপরেই এসেছে। তরুণদের শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। চরম হতাশায় ভুগছে তারা। এ পরিস্থিতি সত্ত্বেও আমাদের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণে বরাদ্দ এখনও যথেষ্ট কম। এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে অন্যান্য ক্ষেত্রে মনোযোগ চলে যাচ্ছে। এ বি সি বাদ দিয়ে আমরা যেন এক্স ওয়াই জেডে চলে যাচ্ছি। করোনায় বাস্তবতা বদলেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষা এখন আর কেবল বই-খাতা নয়। পরিস্থিতির কারণে তথ্যপ্রযুক্তির মতো বিষয় এখন মৌলিক হয়ে উঠছে। আগামী বাজেটে গুণগত শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেওয়ার সুপারিশ করছি।


নিয়াজ মোর্শেদ এলিট
১৮ থেকে ৪০ বছরের উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করে জেসিআই। বর্তমানে সারাদেশে আমাদের সদস্য সংখ্যা চার হাজার। তরুণ উদ্যোক্তা তৈরিতে আমরা সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা মূলত নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই। তরুণদের বড় একটা অংশের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে। তরুণদের বিশাল এ অংশের স্বপ্ন পূরণে বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া হলে হাজারো তরুণের কর্মংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। অথচ সহায়ক পরিবেশ এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতার অভাবে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা ব্যবসা ছেড়ে যাচ্ছে। তরুণদের বিনিয়োগে আগ্রহী করতে একটি সমন্বিত জাতীয় নীতিমালা করার অনুরোধ করছি আমি। এতে কম সুদ এবং সহজ শর্তে ঋণ, কর অবকাশের সুবিধা থাকতে হবে, যাতে ব্যবসা এবং বিনিয়োগ করা তাদের জন্য সহজ হয়। ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলে ৫০০ উদ্যোক্তা লাখ লাখ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারবে।


মোহাম্মদ মিজানুর রহমান তৈরি পোশাকের পরই চামড়া ও চামড়াপণ্য সবচেয়ে বড় সম্ভাবনাময়। দেশে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কারখানা নিয়ে আমরা প্রস্তুত। অথচ শ্রমিক নেই। এ খাতের জন্য উপযোগী প্রশিক্ষণ দিয়ে তরুণদের কর্মসংস্থানে নিয়ে আসার সুযোগ আছে। তরুণদের মধ্যে মেধা আছে। অনেকেই প্রতিশ্রুতিশীল। এদের সুযোগ করে দিতে হবে। গত বছর আমি দেশের বিভিন্ন জেলায় কয়েকজন তরুণকে নিয়ে কাজ করেছি। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার দু'জন তরুণও ছিল। দেখলাম, আমাদের তরুণরা খুব সহজে উন্নত প্রযুক্তির ড্রোন, ই-বাইকের মতো প্রযুক্তির যন্ত্র এবং বাহন তৈরি করেছে। এ রকম উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবনে তরুণদের মেধা কাজে লাগানো সম্ভব। তবে তাদের সুযোগটুকু করে দিতে হবে। বাজেটে সে ধরনের বরাদ্দ এবং দিকনির্দেশনা থাকা দরকার।


জিয়া আশরাফ করোনাকালে সরবরাহ পরিস্থিতি যখন ভেঙে পড়েছিল, তখন মুদিপণ্য সরবরাহে বড় অবদান রেখেছে চাল-ডালের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ অনেকে আমাদের কাজের প্রশংসা করেছেন। তবে অনেকে আমাদের বিশ্বাস করে না। ব্যাংক ঋণ পেতে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। স্থায়ী সম্পদ কি আছে, দৃশ্যমান অফিস আছে কিনা- এ রকম হাজারো প্রশ্ন। আমরা দেশের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ এনেছি। এখনও আমরা লোকসানে আছি। নূ্যনতম কর আমাদের জন্য না থাকলে ভালো হয়। অন্তত কমিয়ে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ করা উচিত। কর দিতে গিয়ে ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে সেটা দুঃখজনক। চাল-ডালের মতো অন্যান্য বিনিয়োগ বিকাশে ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা থাকার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি। আমরা স্বচ্ছতার ভিত্তিতে লেনদেন করি। তবে সাধারণ ভোক্তা তাদের কাছে এক কেজি আলু বিক্রি করলে ভ্যাট চালান সংরক্ষণ করা কঠিন। এখানে একটা সংস্কার প্রয়োজন।


ডা. আশরাফুল হক সিয়াম বাজেটের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তরুণদের নিয়ে ভাবনা থাকা উচিত। অতিমারি করোনাকালে প্রমাণিত হয়েছে যে, তরুণরা কতটা কর্তব্যপরায়ণ। স্বাস্থ্য খাতে যে ধরনের সুবিধা থাকার প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। করোনার সেই কঠিন সময়ও স্বাস্থ্যসেবায় তরুণ চিকিৎসকরা অনেক নিবেদিত ছিলেন। তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ে সবার জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো খুব বেশি প্রয়োজন। কারণ, এখন পর্যন্ত বরাদ্দ অনেক কম। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ। এ হার দক্ষিণ এশিয়ার গড় বরাদ্দ ৫ দশমিক ৩ শতাংশের অর্ধেকেরও কম। বরাদ্দের বড় অংশ ব্যয় হয় অবকাঠামোতে। আবার সেই বরাদ্দেরও একটা অংশ বছর শেষে ফেরত যায়। ফেরতযোগ্য অর্থ রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় হলে সেবার মান আরও বাড়বে।


সালাহ উদ্দিন ইউসুফ বাজেট নিয়ে প্রতিবছর কেন কথা বলতে হবে! এটা তো দীর্ঘমেয়াদি নীতি নিয়ে করতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ এবং অন্যান্য উন্নয়ন লক্ষ্য সামনে রেখে বাজেট হতে হবে। বাজেট হবে শিল্পনীতি কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা নিয়ে। আইএফসি আমাদের শিল্পের সক্ষমতা নিয়ে একটা প্রতিবেদন করেছে। সেখানে অনেক দুর্বলতার কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে ছোট্ট একটি উদাহরণ হচ্ছে, অটোমেশন নেই, ডিজিটালাইজেশন হয়নি। এসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে নির্দেশনা থাকতে হবে বাজেটে। শিল্পনীতি বাস্তবায়নে বাজেটে নির্দেশনা থাকতে হবে। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আদৌ এ শিল্পনীতি পড়েছে কিনা সন্দেহ আছে। শিল্পনীতিতে বলা আছে, স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া হবে। বাস্তবে দেখা যায়, আমরা ২০০ শতাংশ প্রতিযোগিতা মোকাবিলা করি। শিল্পনীতিতে বলা আছে, সার্কুলার ইকোনমি, রিসাইক্লিংয়ে জোর দেওয়া হবে। কিন্তু বাজেটে এ নিয়ে কি কোনো কথা থাকে? বাজেটে এ নিয়ে নীতিনির্দেশনা থাকলে শিল্পভিত্তিক বিনিয়োগ আসবে। উদ্যোক্তারা একটি পরিচ্ছন্ন ধারণা পাবেন। বিদ্যুতের দর বৃদ্ধি নিয়ে যে আলোচনা, তা বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভুল বার্তা দেবে। অনুমান-অযোগ্য নীতি শিল্পায়নকে নিরুৎসাহিত করবে। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সারাদেশে বিসিকের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে জমির ব্যবস্থা করা দরকার।



তাহসিন আজিম সেজান তরুণ উদ্যোক্তাদের বিকাশে ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতে স্বল্পসুদে এবং সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা প্রয়োজন। গ্যাসসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সহযোগিতা পাওয়া গেলে তৈরি পোশাকের লজিস্টিকসে বিনিয়োগ করার জন্য অনেক তরুণ উদ্যোক্তা এগিয়ে আসতে চায়। বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকের চাহিদা এবং বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধির যে প্রবণতা তাতে পোশাক খাতে এ মুহূর্তে লজিস্টিকসে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, একটা স্পিনিং মিল হলে সেখানে অন্তত দুই হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। তরুণ উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে হাজার হাজার তরুণের বেকারত্ব ঘুচতে পারে। আমি মনে করি, তরুণ উদ্যোক্তাদের বিকাশে তাঁদের যে কোনো ব্যবসা উদ্যোগে অন্তত পাঁচ বছরেরকর অবকাশ সুবিধা থাকা উচিত। তৈরি পোশাকের বিকাশে এ ধরনের উদ্যোগের বড় ভূমিকা ছিল।


রেজা আলী মাহমুদ শপআপ মূলত লজিস্টিক প্রোভাইডার। ৪৫ লাখ মুদি দোকানিকে আমরা অনলাইনে সহযোগিতা দিই। তাঁরা কোনো পণ্য তৈরি করেন না। তাঁরা ২৫ থেকে ৩০টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করেন। বিক্রেতা বা পণ্য সরবরাহকারীদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে আমরা সহযোগিতা দিয়ে থাকি। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত হিসেবে নূ্যনতম কর হিসেবে শূন্য দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ করও আপাতত বেশি। এ হার শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ হওয়া উচিত। যুব উদ্যোক্তাদের জন্য স্বাধীন একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা যায়। অবকাঠামো যেমন গুরুত্বপূর্ণ, রক্ষণাবেক্ষণ আরও গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে হাজার হাজার কোটি টাকায় নির্মিত অবকাঠামো প্রকল্প কয়েক বছর পর আর ব্যবহারযোগ্য থাকবে না। এখনই এ বিষয়ে নজর দিতে হবে। আর তরুণদের সুযোগ করে দিতে একটা কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে; অভিভাবকের মতো। যেখানে তরুণ উদ্যোক্তারা সব ধরনের সহযোগিতা পাবেন। বড়দের অভিজ্ঞতা এবং তরুণদের মেধা মিলে দেশের জন্য ভালো কিছু করার বড় সুযোগ রয়েছে।


মিনহাজ আহমেদ ব্যবসা পরিচালনা সহজ করার পাশাপাশি বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক সময় লাগছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৪ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যাচ্ছে। এতে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা কমছে। রেলের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনের উদ্যোগ নেওয়া হলে ভালো হয়। চট্টগ্রাম বন্দরকে আরও সক্ষম করতে হবে। বিশ্বের সবচেয়ে অদক্ষ বন্দর হচ্ছে আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার সহজ করা দরকার। কারণ, জ্বালানিতে এখন আমাদের অনেক ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এটা নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে ভর্তুকি সাশ্রয়ের সুযোগ থাকবে। বিনিয়োগ সহায়ক এসব অবকাঠামোতে নজর দিতে হবে। সহজ ব্যবসা পরিচালনায় কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।



আবু সাঈদ খান তরুণরা মহান মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। দেশ গড়ার কাজেও তারা নিয়োজিত। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তারা বিদেশ থেকে টাকা পাঠাচ্ছে। দেশে বিভিন্ন রকম উদ্ভাবনী কার্যক্রমে জড়িত। বাজেট সবারই। তবে তরুণদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ, তারাই দেশ গড়বে। যারা উৎপাদনে সহায়ক, গবেষক, উদ্যোক্তা; তাদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। তবে গ্রামের কৃষি-মজুর থেকে উদ্যোক্তা অর্থাৎ সমাজের সর্বস্ততরের তরুণদের কেউই যাতে সরকারের উন্নয়ন পদক্ষেপ থেকে বাদ না পড়ে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সব তরুণকে সমান সুযোগ দিতে হবে। কোনো তরুণ যাতে বেকার না থাকে। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণরা কেন বেকার থাকবে? কিছুতেই যাতে দেশের সম্পদ তারুণ্যের অপচয় না হয়। তাদের শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কারণ বিদেশে আমরা অদক্ষ বেশি লোক পাঠিয়েও কম অর্থ পাচ্ছি। দেশে এত বিশ্ববিদ্যালয় থাকা সত্ত্বেও ম্যানেজার থেকে শুরু করে টেকনোক্র্যাট পর্যন্ত বিদেশি কর্মীর পেছনে আমাদের আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ চলে যায়। সুতরাং আমাদের কর্মীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। এটা বিবেচনায় আনা দরকার। তরুণদের বাজেটে মানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সব খাতে মনোযোগ দিতে হবে, যাতে তারুণ্য উপকৃত হয়।


জাকির হোসেন অনেকেই বলেছেন, প্রাক্‌-বাজেট আলোচনা বাজেট পেশের অনেক আগেই করা উচিত ছিল। তাঁদের মতামতকে আমি সমর্থন করি। তবে বাজেট পাস হবে জুনের শেষে, সেহেতু অনেক প্রস্তাব সংশোধনের সুযোগ থাকবে। ফলে এ আলোচনার উপযোগিতা থাকবে। এ ছাড়া বাজেট পাসের পরও সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। বাজেটে তরুণদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে অর্থবছরের যে কোনো সময় পদক্ষেপ নেওয়ার অবকাশ রয়েছে।



শাখাওয়াত হোসেন ধন্যবাদ মাননীয় মন্ত্রী। এ আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই দৈনিক সমকালকে। দারাজ, বিএনও এবং অন্যান্য কো-স্পন্সরকে ধন্যবাদ জানাই। তাদের সহযোগিতার ফলে এ আয়োজন সফল হয়েছে। যাঁরা আলোচনায় অংশ নিয়েছেন, অত্যন্ত বাস্তবসম্মত পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন- তাঁদেরও ধন্যবাদ। আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত এবং পরামর্শ আমাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নে সহায়ক হবে। এ আয়োজনের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।

প্রধান অতিথি

এম এ মান্নান
পরিকল্পনামন্ত্রী

প্রারম্ভিক বক্তব্য

জাফর সাদিক
সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট
সিপিডি

আলোচক

আবুল কাশেম খান
সাবেক সভাপতি, ঢাকা চেম্বার এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এ কে খান টেলিকম

শহিদুল্লাহ আজিম
সহসভাপতি, বিজিএমইএ

এ এইচ এম হাসিনুল কুদ্দুস
চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার
দারাজ বাংলাদেশ

আরিফ খান
ভাইস চেয়ারম্যান
শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট

তারিন হোসেন
পরিচালক
দৈনিক ইত্তেফাক

নিয়াজ মোর্শেদ এলিট
ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট
জেসিআই

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান
চেয়ারম্যান, ফরচুন সুজ

জিয়া আশরাফ
প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক
চাল-ডাল লিমিটেড

ডা. আশরাফুল হক সিয়াম
সহযোগী অধ্যাপক
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট

সালাহ উদ্দিন ইউসুফ
পরিচালক
বিএনও লুব্রিকেন্টস বাংলাদেশ

তাহসিন আজিম সেজান
পরিচালক, ক্লাসিক গ্রুপ

রেজা আলী মাহমুদ
পরিচালক, শপআপ

মিনহাজ আহমেদ
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
আহমেদ ফুড

সভাপতি

আবু সাঈদ খান
উপদেষ্টা সম্পাদক
সমকাল

সঞ্চালক

জাকির হোসেন
বিজনেস এডিটর
সমকাল

ধন্যবাদ জ্ঞাপন

শাখাওয়াত হোসেন
প্রেসিডেন্ট
জেসিআই ঢাকা উত্তর

অনুলিখন

আবু হেনা মুহিব
সিনিয়র রিপোর্টার
সমকাল