আগামী অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় সামাজিক সেবামূলক খাত সংবাদপত্রশিল্প নিয়ে মতবিনিময়ের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তথা এনবিআর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ তথা নোয়াবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আলোচনায় অংশ নিয়ে বর্তমানে সংবাদপত্রশিল্পে যে 'রুগ্‌ণ পরিস্থিতি' বিরাজ করছে, তা থেকে উত্তরণের স্বার্থে নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি এবং বিজ্ঞাপন আয়ের উৎসে কর কমানোসহ আমরা কিছু দাবি জানিয়ে এসেছি। আমরা বিশ্বাস করি, এসব যৌক্তিক দাবি আসন্ন বাজেটে পূরণ করা হবে।

আমরা জানি, শ্রম আইন ২০০৬-এর ২(৬০) ধারা অনুসারে সংবাদপত্র একটি শিল্প। পরবর্তীকালে, ২০১৪ সালে সংবাদপত্রকে 'সেবা শিল্প' হিসেবেও ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আর দশটা সাধারণ শিল্প বা সেবা খাতের মতো সংবাদপত্র নিছক বাণিজ্য ও মুনাফার মাধ্যম নয়। ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক সংবাদপত্র সূচিত হওয়ার পর গত আড়াইশ বছরের ইতিহাসে দেখা গেছে, এ শিল্প সবসময়ই সমাজ ও রাষ্ট্রের বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে ভূমিকা রেখে এসেছে।

কালের বিবর্তনে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও মতাদর্শভিত্তিক এবং স্বেচ্ছাশ্রমনির্ভর সংবাদপত্রশিল্প পুঁজিঘন প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে ঠিকই; সমাজের প্রতি এর দায়বদ্ধতায় ঘাটতি পড়েনি। বরং ক্রমেই সম্প্রসারিত ও বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সংবাদপত্র তথা বৃহত্তর অর্থে সংবাদমাধ্যমের কথা বিশেষভাবে বলতে হবে। আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম ও আর্থসামাজিক বিকাশে সংবাদপত্রশিল্প যে ভূমিকা রেখেছে, তার তুলনা বিশ্বে খুব বেশি নেই।

ইতিহাসের উদ্ধৃতি শুধু নয়; বর্তমানে দাঁড়িয়েও সংবাদপত্রশিল্পের ভূমিকা ও প্রাসঙ্গিকতা উপেক্ষা করার অবকাশ নেই। সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগে যেমন সমর্থন, তেমনই ভুল কাজ বা পদক্ষেপের যথার্থ সমালোচনার মাধ্যমে সুশাসনে সহায়তা করে। দুর্নীতি ও অনিয়মের মতো নেতিবাচক প্রপঞ্চ রোধ; অপরাধ ও অপসংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণেও সংবাদপত্রশিল্পের রয়েছে অসাধারণ অবদান।

ফলে নোয়াবের পক্ষ থেকে এনবিআরের কাছে আমরা যেসব দাবি জানিয়েছি, সেগুলো নিছক একটি সংগঠন বা শিল্পের পক্ষ থেকে উত্থাপিত দাবি নয়। কারণ নাগরিকদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ শিল্পের সঙ্গে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির প্রশ্ন গভীরভাবে জড়িত।

এটা এখন প্রমাণিত- ডিজিটাল মিডিয়ার দ্রুতগতির সম্প্রসারণ এবং পারিপার্শ্বিক নানা কারণে মুদ্রিত সংবাদপত্র বাজার হারাচ্ছে। প্রচারসংখ্যার পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের হারও ক্রমে কমে যাচ্ছে। আগে যেসব বিজ্ঞাপন সংবাদপত্রে আসত, সেগুলোর বড় অংশ এখন টেলিভিশন, ইউটিউব, ফেসবুকসহ অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যমে যায়। সরকারি যেসব বিজ্ঞাপন সংবাদপত্রে ছাপা হয়, সেগুলোও ক্রমে 'ই-টেন্ডার' হয়ে যাচ্ছে। গত দুই বছরের করোনা পরিস্থিতি সংবাদপত্রশিল্পের সংকট আরও ঘনীভূত করেছে।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে নিউজপ্রিন্টের দাম ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। এর সঙ্গে জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি এ শিল্পে কর্মরত সাংবাদিক ও কর্মচারীদের জীবন ও জীবিকার ভারসাম্য বিঘ্ন করছে। এমন উভয় সংকটে পড়ে দেশে কয়েকটি সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো উদ্বেগজনক চিত্রও দেখা গেছে। ফলে সংবাদপত্র এখন অনিবার্যভাবেই 'রুগ্‌ণ শিল্প' হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিকে যদি সংবাদপত্রশিল্পের জন্য ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুর্যোগ হিসেবে ধরি, তা অত্যুক্তি হবে না।

এ অবস্থায় সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সংবাদপত্রশিল্পের পক্ষে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে টিকে থাকা কঠিন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সংবাদপত্র অন্যতম প্রধান ও বহুমাত্রিক সেবা শিল্প হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। মনে রাখা জরুরি, সংবাদপত্র এমন একটি সেবা, যার উৎপাদন খরচ বিক্রীত মূল্যের কয়েক গুণ বেশি। যে বিজ্ঞাপনের আয় দিয়ে সংবাদপত্রের উৎপাদন ব্যয়ের ঘাটতি পূরণ করা হয়, সেটা এখন কমে যাওয়ায় লোকসান ও ভর্তুকি ক্রমে বেড়েই চলেছে।

সংবাদপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রধান কাঁচামাল ও অন্যতম প্রধান ব্যয় খাত নিউজপ্রিন্টের দাম যে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে, আগেই বলা হয়েছে। দেড় বছর আগেও যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন নিউজপ্রিন্টের দাম ছিল ৫৭০ ডলার; এখন তার দাম ৯৩০ ডলার। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে আরেকটি বড় ব্যয়- সাংবাদিক, প্রতিনিধি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাসিক বেতন ব্যয় অপরিবর্তিত রয়েছে। এ ছাড়া পত্রিকাগুলোর অফিস ভাড়া, কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবহন ব্যয়, ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পত্রিকা পরিবহন ব্যয়সহ অন্যান্য ব্যয়ও অপরিবর্তিত রয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে রুগ্‌ণ হয়ে পড়া সংবাদপত্রশিল্পকে বাঁচানোর স্বার্থে ২০২২-২৩ সালের বাজেটে বিবেচনার জন্য নোয়াবের পক্ষ থেকে আমাদের কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রয়েছে।

প্রথমত, সংবাদপত্রের করপোরেট ট্যাক্স কমিয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ করা জরুরি। সংবাদপত্র সেবা শিল্প হওয়া সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। যেমন তৈরি পোশাকশিল্প একটি মুনাফা অর্জনকারী শিল্প হওয়া সত্ত্বেও এর করপোরেট ট্যাক্স ১০ থেকে ১২ শতাংশ। অথচ সংবাদপত্র সেবা শিল্প হওয়া সত্ত্বেও একে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি, অনিবন্ধিত কোম্পানি ও নন-রেসিডেনসিয়াল ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে এবং করপোরেট ট্যাক্স ৩০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা মনে করি, এই শিল্পের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, সামাজিক অবদান এবং সাম্প্রতিক আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সংবাদপত্রের করপোরেট ট্যাক্স ১০ থেকে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করার দাবি অযৌক্তিক হতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, সংবাদপত্রশিল্পে মূল্য সংযোজন কর অব্যাহতি প্রয়োজন। মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক্ক আইন ২০১২-এর শিডিউল-১-এ ভ্যাটমুক্ত পণ্যের তালিকা দেওয়া আছে। শিডিউল-১, পার্ট-২-তে বিশেষ সুবিধা প্রদানের জন্য ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত সেবার তালিকায় সংবাদপত্র অন্তর্ভুক্ত। এই শিল্পের অন্যতম প্রধান কাঁচামাল নিউজপ্রিন্ট কেনার ব্যয় সংবাদপত্রের মোট খরচের ৫০-৬০ শতাংশ। বর্তমানে এই নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে। তাই সংবাদপত্রশিল্পের শিডিউল-১, পার্ট-২তে থেকেও ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে। এই সুবিধার কোনো অর্থ থাকে না। অন্যদিকে, অনেক পণ্যই ভ্যাটমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে। তাই সংবাদপত্রশিল্পের প্রধান কাঁচামাল তথা নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাটমুক্ত সুবিধা দেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা যেতে পারে।

তৃতীয়ত, টিডিএস ও এআইটি অব্যাহতির যে দাবি আমরা জানিয়েছি, তা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স ১৯৮৪-এর ৫৩ (কে) অনুসারে সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর টিডিএস ৪ শতাংশ এবং ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স ১৯৮৪-এর ৫৩ ধারা অনুযায়ী উৎসস্থলে কাঁচামালের ওপর ৫ শতাংশ এআইটি মিলে টিডিএস/এআইটি হয় ৯ শতাংশ। অথচ অধিকাংশ সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের মোট আয়ের ৯ শতাংশ লভ্যাংশই থাকে না। তাই সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর টিডিএস ৪ থেকে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা প্রয়োজন। অন্যদিকে উৎসস্থলে কাঁচামালের ওপর ৫ শতাংশের স্থলে এআইটি শূন্য শতাংশ করা জরুরি।

চতুর্থত, সংবাদপত্র কর্মীদের আয়কর থেকে প্রতিষ্ঠানের দায়মুক্তিও জরুরি। আয়কর অধ্যাদেশে ১৯৮৪-এর ৫০ ধারা অনুসারে সরকারিসহ সব প্রতিষ্ঠানে কর্মীরা নিজের আয়কর নিজেই প্রদান বা বহন করে। অথচ সংবাদপত্র ওয়েজ বোর্ড অনুসারে কর্মীর আয়ের ওপর প্রযোজ্য আয়কর প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করতে হয়। দেশে এমন কোনো আইন থাকা উচিত নয়, যা সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য নয়। তাই সংবাদপত্র ওয়েজ বোর্ডের ক্ষেত্রেও আয়কর অধ্যাদেশে ১৯৮৪-এর ৫০ ধারার প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

পঞ্চমত, সংবাদপত্রশিল্পের সাংবাদিক, প্রতিনিধি, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া ৭০ শতাংশ করমুক্ত করা জরুরি। সংবাদপত্র ওয়েজ বোর্ডে বাড়ি ভাড়া মূল বেতনের ৭০ শতাংশ। আর আয়কর অধ্যাদেশে বাড়ি ভাড়া ৫০ শতাংশ পর্যন্ত করমুক্ত রেয়াত হওয়ায় অবশিষ্ট ২০ শতাংশ ব্যক্তি খাতের করের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। তাই আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর বিধি ৩৩(এ) মূল বেতনের ৫০ শতাংশের স্থলে বাড়ি ভাড়া ৭০ শতাংশ করমুক্ত করা প্রয়োজন।

একই সঙ্গে করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনার অংশবিশেষ সংবাদপত্রশিল্পের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। সংগত কারণে সংবাদপত্রশিল্পকেও সরকার-ঘোষিত প্রণোদনার আওতায় আনার জন্য বিশেষ অনুরোধ করছি।

মনে রাখতে হবে, সংবাদপত্রশিল্প সংকটে পড়ার অর্থ রাষ্ট্রের 'চতুর্থ স্তম্ভ' নাজুক হয়ে পড়া। এর নেতিবাচক প্রভাব কেবল কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও কিছু ব্যক্তিবিশেষের ওপর সীমিত থাকবে না। সামাজিক সেবায় ও সামষ্টিক স্বার্থে সংবাদপত্রশিল্প যে ভূমিকা রেখে আসছে, তা নিঃসন্দেহে ক্ষুণ্ণ হবে।

নোয়াবের পক্ষ থেকে আমাদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সরকার এবং রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী সংস্থা ও কাঠামোগুলো সংবাদপত্রশিল্পের পাশে দাঁড়াবে। স্বস্তির বিষয়, নোয়াবের সঙ্গে আলোচনা সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান স্বীকার করেছেন- রাজস্ব আদায় ও করের আওতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশে সংবাদপত্র তথা সংবাদমাধ্যম ইতিবাচক অবদান রাখছে। আমরা আসন্ন ২০২২-২৩ বাজেটে এর প্রতিফলন প্রত্যাশা করি।

নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, অব বাংলাদেশ (নোয়াব) এর পক্ষ থেকে প্রকাশিত