ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩

শুভ্র শরতে

শুভ্র শরতে

মডেল: জেরিন তাসনিম, মেকওভার: রুমানা ইসলাম, পোশাক: অঞ্জন’স, ছবি: ফয়সাল সিদ্দিক কাব্য

রিক্তা রিচি

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ০৬:১১

‘প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ,
নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত’– মহাকবি কালিদাস

আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে শরৎ রানী এসেছে মাসখানেক হয়ে গেল। পথে পথে ঝরে পড়া দুধ সাদা-কমলা রঙের শিউলি, ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা তো তাই বলে। বিলের ধারে, অনাবাদে পড়ে থাকা জমি, রাস্তার আশপাশে ফোটে কাশফুল। এখনই উপযুক্ত সময় শরৎ যাপনের। খোলা চুলে কিংবা চুলে খোঁপা অথবা বেণি করে কাশবনে হারিয়ে যাওয়ার এখনই সময়। ঢাকা ও এর পাশপাশে বিভিন্ন জায়গায় কাশফুল ফুটতে শুরু হয়েছে। কোথাও কোথাও বেশ বড় হয়ে গেছে কাশ-গাছ। কোনো এক শরৎ বিকেলে অথবা ছুটির দিনের একটি বিকেল ঘুরে আসুন কাশবাগান থেকে। যেতে পারেন ছুটির সকালেও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে উচ্চারণ করতে পারেন কবিতার চরণ– ‘আজ কি তোমার মধুর মূরতি,/ হেরিনু শারদ প্রভাতে!/ হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ,/ ঝলিছে অমল শোভাতে।/ পারে না বহিতে নদী জলধার,/ মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর– ডাকিছে দোয়েল, গাহিছে কোয়েল/ তোমার কাননসভাতে।’


শরৎ রানীর প্রকৃতির প্রতি মোহাবিষ্ট ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাই তো তিনি লিখেছেন, ‘শিউলিতলায় ভোরবেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লী-বালা। শেফালি পুলকে ঝরে পড়ে মুখে খোঁপাতে চিবুকে আবেশ-উতলা।’
গত কয়েক বছরে শরতের এ সময়টায় তরুণ-বুড়ো সবার কাশবনে যাওয়ার হিড়িক বেড়েছে। অন্তত সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করলে এমনটাই দেখা যায়। সাদা, নীল কিংবা সাদা-নীলের সংমিশ্রণ আছে এমন পোশাকই বেশি পরতে দেখা যায় তাদের। অনেকে বাছেন নীলের কাছাকাছি অন্য কোনো রঙের পোশাক। শরতে ফ্যাশন হাউসগুলোও নিয়ে আসে বিভিন্ন শেডের নীল ও সাদা রঙের পোশাক। কিছু কিছু পোশাকে জ্যামিতিক স্ক্রিনপ্রিন্ট, এমব্রয়ডারির পাশাপাশি নীল আকাশ, সাদা মেঘ, শিউলি ইত্যাদি তুলে ধরা হয়।
ঠাসবুনটের এই শহরে কিছুটা স্বস্তি ও প্রশান্তি পেতে আপনিও চলে যেতে পারেন কাছের কোনো কাশবনে, বালু নদীর পাড়ে কিংবা উত্তরার দিয়াবাড়ীতে। সঙ্গে নিতে পারেন পরিবার ও বন্ধুদের। এতে পরিবারের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম দেওয়া হবে।
দিয়াবাড়ী: পরিবার নিয়ে সানন্দে ঘুরে বেড়ানো এবং কাশফুলের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার জন্য চলে যেতে পারেন উত্তরার দিয়াবাড়ীতে। দিয়াবাড়ীতে বিস্তৃত জায়গাজুড়ে কাশফুলের সমারোহ থাকে এ সময়টায়। সেখানে গিয়ে মন ভরে ছবি তোলা যাবে, পার্সোনাল ব্লগের জন্য ভিডিও করা যাবে। কাশফুলের শুভ্রতা উপভোগের পাশাপাশি দেখতে পারবেন নদীতীরের সূর্যাস্ত। সকাল থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত যে কোনো সময়েই যেতে পারেন সেখানে। তবে বেলা থাকতে থাকতে ফিরে আসতে হবে। নয়তো অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
কেরানীগঞ্জ: কাশফুল দেখার জন্য চলে যেতে পারেন কেরানীগঞ্জে। শরতে হযরতপুরের কালীগঙ্গা নদীর তীরে কাশফুলের সমারোহ ঘটে। বছিলা ব্রিজ পার হলেই কিছুটা সামনে এগোলেই হযরতপুর। সেখানে যেতে পারেন বন্ধুদের নিয়ে। কাশফুলের সঙ্গে এক অপরূপ বিকেল কাটবে।
ঢাকা উদ্যান: বেশ কয়েক বছর ধরে ঢাকা উদ্যান নদীর পাড়ে বিস্তৃত জায়গাজুড়ে কাশফুল ফোটে। সবুজ ডাঁটার ওপর ফুটে থাকা সাদা কাশফুল গুচ্ছ দেখতে অনেক দূর থেকেও সেখানে যান দর্শনার্থীরা। নদীর অপর পাড়ে যেতে হলে আপনাকে নৌকা পাড়ি দিয়ে যেতে হবে। ঢাকা উদ্যান ঘাটে অনেক নৌকা থাকে। প্রতিজনে ৫-১০ টাকা করে ভাড়া দিতে হয়। ২-৩ মিনিটের নৌকা ভ্রমণ করলেই পৌঁছে যাবেন কাশের রাজ্যে। তবে যারা নৌকায় উঠতে ভয় পান, তারা এ জায়গাটি এড়িয়ে চলতে পারেন। কাশফুল দেখতে যেতে পারেন অন্য কোথাও।


মধুসিটি: মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড় থেকে সিএনজি অটোরিকশা কিংবা বাসে চড়ে যাওয়া যায় মধুসিটি। এখন সেখানে রেস্টুরেন্ট ও ফুডকোর্ট হয়েছে। রেস্টুরেন্ট ও ফুডকোর্টের আশপাশে রাস্তার দুই ধারে কাশফুলের দেখা মেলে। যারা ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়ার দিকে থাকেন তারা যে কোনো বিকেলে চলে যেতে পারেন মধুসিটিতে। কাশবনে ঘোরাঘুরি করে ফুডকোর্টে খাওয়া-দাওয়া করতে পারবেন। চাইলে চটপটি, ফুচকা, ঝালমুড়িও খেতে পারেন।
পূর্বাচল: কোনো এক বিকেলে চলে যেতে পারেন পূর্বাচলের ৩০০ ফুট সড়কে। শরতে সেখানে মনোরম কাশফুলের দেখা মেলে। কুড়িল উড়াল সড়ক থেকে নেমে পূর্বাচলের যে সড়কটি চলে গেছে সামনের দিকে সেটি ‘৩০০ ফুট’ নামে পরিচিত। সড়কটি খিলক্ষেত উড়াল সড়কের পর থেকে বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারের সামনে দিয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে উঠেছে। পূর্বাচলে এখন অনেক রিসোর্ট, ফুডকোর্ট ও ঘোরার জায়গা হয়েছে। অনেকেই সময় পেলে বন্ধুবান্ধব নিয়ে চলে যায় সেখানে। শরতের কোনো এক দিনে চলে যেতে পারেন আপনিও। কাশফুল দেখতে গেলে দুপুরের পর রওনা দেওয়া ভালো। বিকেলের মধ্যেই ঘুরে সন্ধ্যার আগে দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লে বিপদের আশঙ্কা থাকে না। বিকেলের দিকে রোদের তেজ কম থাকে। স্বস্তির বাতাসও থাকে। ঘুরে আরাম পাওয়া যাবে।
আফতাবনগর: ঢাকার আফতাবনগরেও বিস্তৃত জায়গাজুড়ে কাশফুল ফোটে। এখানে পাশেই রয়েছে নদী। রিকশা নিয়ে ঘুরে ঘুরে কাশফুল দেখার সুযোগ মিলবে সেখানে। যারা স্বস্তি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে চান, তারা আফতাবনগরে যেতে পারেন। সবুজ ঘাস, গাছপালা, প্রশস্ত সড়ক, কাশফুল ইত্যাদি সবকিছুর দেখা মিলবে আফতাবনগরে। আফতাবনগরে রাস্তার পাশে ছোট ছোট ফুডভ্যানও আছে। ঝালমুড়ি, ফুচকা– এ জাতীয় খাবার খেতে পারবেন। অবশ্য কাশফুল ফোটে এমন অধিকাংশ জায়গায়ই দর্শনার্থীদের জন্য ঝালমুড়ি, ফুচকা, চা এসবের দোকান বসে। তবে এসব খাবার খেলে যাদের পেটে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়, তারা খাবেন না।
মায়াদ্বীপ: মেঘনার বুক চিরে জেগে ওঠা ত্রিভুজ আকৃতির এক অপূর্ব দ্বীপ হলো মায়াদ্বীপ। এটি মূলত নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের বারদী ইউনিয়নের নুনেরটেক গ্রামে অবস্থিত। মায়াদ্বীপে এই শরতে কাশফুলে ছেঁয়ে যায়। শুধু কাশফুলই নয়, রয়েছে সবুজ প্রকৃতিও। খোলা প্রান্তর, নদীর ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ করে ছুটে চলা– সবকিছু মিলিয়ে দারুণ উপভোগ করবেন। মায়াদ্বীপে বেড়াতে গেলে গ্রামীণ আবহের দেখা মিলবে। একইসঙ্গে স্থানীয়দের জীবনযাত্রা, চালচলন দেখতে পারবেন। পরিবার, প্রিয়জন কিংবা বন্ধুদের নিয়ে মায়াদ্বীপ গেলে গুলিস্তান থেকে বাসে চড়ে বৈদ্যেরবাজার যাবেন। সেখানের মেঘনার ঘাট থেকে ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করে মায়াদ্বীপে যেতে পারবেন। তবে এ দ্বীপে ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যার আগেই বৈদ্যেরবাজারে ফিরতে হবে। কোনোভাবেই সন্ধ্যা কিংবা রাত পর্যন্ত ওখানে থাকা যাবে না।
সারিঘাট: খুব অযত্নেই সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে কেরানীগঞ্জের কোণ্ডা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের আইন্তা সারিঘাটে ফোটে কাশফুল। শুভ্র কাশফুলের ছোঁয়া পেতে ঘুরে আসতে পারেন সেখান থেকে। সারিঘাটের অবস্থান বসুন্ধরা রিভারভিউ আবাসিক এলাকার শেষ প্রান্তে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী কিংবা তার আশপাশে থাকেন যারা তারা কোনো একদিন সারিঘাট থেকে ঘুরে আসতে পারেন। কাশফুলের অপার সৌন্দর্য উপভোগ, ফটোসেশন শেষ করে চাইলে স্বচ্ছ জলেও নামতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে যারা সাঁতার জানেন, তারা ছাড়া বাকিদের জলে নামা ঠিক হবে না। চিরচেনা গ্রামীণ পরিবেশ, সাধারণ মানুষের জীবনযাপন, সবুজ প্রকৃতির স্বাদ নেওয়া যাবে সারিঘাটে গেলে। নিরিবিলিতে সময় কাটাতে চাইলে ‘জল ছবির গাও’ রিসোর্টে চলে যেতে পারেন। সেখানে মাটির পাত্রের খাবার পরিবেশন আপনার নিঃসন্দেহে ভালো লাগবে। এ ছাড়া সারিঘাটে কায়াকিং ও ডিঙি নৌকার ব্যবস্থাও আছে। যারা কায়াকিং করতে ভালোবাসেন তারা আধা ঘণ্টার মতো কায়াকিং করতে পারবেন ৭৫-৯০ টাকায়। যারা নৌকায় ঘুরতে চান তারা ১০০-১৫০ টাকার মধ্যে নৌকা ভাড়া নিয়ে ১৫-২০ মিনিট ঘুরে বেড়াতে পারবেন। যারা এই শরতে ডে ট্রিপে যেতে চান তারা সারিঘাটকে উপযুক্ত জায়গা হিসেবে ভাবতে পারেন।



আরও পড়ুন