গরুর মাংস, সঙ্গে হাড়-মাংসমিশ্রিত চনার ডাল ও নলার ঝোল– হয়ে গেল মেজবানি। জিভে জল আনা এমন খাবার বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ঐতিহ্য। কুলখানি, চেহলাম, মৃত্যুবার্ষিকী, আকিকা, গায়ে হলুদ, নতুন ঘরে ওঠা, সভা-সমাবেশ ছাপিয়ে এখন ইফতারের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে মেজবানির মাংস।

নগরীর বিভিন্ন সড়ক মোড় ও অলিগলিতে বড় পাতিলে নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনিসহ বিভিন্ন পদের সঙ্গে মেজবানি মাংস সংগ্রহ করছেন রোজাদাররা। যদিও গরুর মাংসের দাম বেড়ে যাওয়ায় সবাই এর স্বাদ নিতে পারছেন না। গত বছর হোটেল-রেস্তোরাঁয় যে মেজবানি মাংস ছিল ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায়, এবার তা এলাকাভেদে ১ হাজার টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। মাংসমিশ্রিত চনার ডাল ও নলাসহ ঝোল নিতে গুনতে হচ্ছে আলাদা টাকা।

নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার হাসান মুরাদ মামুন বলেন, ‘মাটির খোরায় (প্লেট) মেজবানি কিংবা আখনি বিরিয়ানি খাওয়ার মজাই আলাদা। রমজানে ইফতারির স্বাদ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে মেজবানি মাংস।’ নগরীর বাদুরতলার আরএ ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী জাকির হোসাইন বলেন, ‘মেজবানি মাংস চট্টগ্রামের ঐতিহ্য। সামর্থ্য রয়েছে এমন প্রত্যেকের ইফতারিতে মেজবানি মাংস থাকছে।’

চট্টগ্রাম নগরীতে ‘মেজ্জান হাইলে আইয়্যুন’ (মেজবান খেলে আসুন) হোটেলের রয়েছে বেশ কয়েকটি শাখা। শুলকবহর শাখার এক বাবুর্চি বলেন, চট্টগ্রামের মেজবানের বিশেষ সুখ্যাতি মূলত আলাদা রান্না পদ্ধতির কারণে। যে কেউ চাইলে মেজবানির মাংস রান্না করতে পারেন না।
জানা গেছে, চতুর্দশ শতাব্দীর আগে চট্টগ্রাম অঞ্চল ছিল আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। হিন্দু ও বৌদ্ধ অধ্যুষিত এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্র ধরে তখন চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বহু জাতি-ধর্মের মানুষ আসা-যাওয়া করতেন। তারই পথ ধরে অনেক মুসলিম মনীষী ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে আসেন। কালের পরিক্রমায় অনেকে থেকে যান। বারো আউলিয়ার অঞ্চল নামে খ্যাত চট্টগ্রামে আসা পীর-দরবেশদের মধ্যে বদর শাহ, বায়েজিদ বোস্তামী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

মুসলমানরা পরিচিত হতে শুরু করে দীক্ষাগুরুদের গরুর মাংসের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে। তখন থেকে মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক-ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে অনুষ্ঠান করে গরুর মাংস দিয়ে বড় বড় ভোজসভার আয়োজন শুরু হয়। আস্তে আস্তে চট্টগ্রামের মানুষের সংস্কৃতি আর পছন্দের সঙ্গে মিশে যায় মেজবানি।

একসময় মাটির প্লেটে করে মেজবানি খাওয়ানো হলেও এখন সেভাবে আর খাওয়ানো হয় না। তবে চট্টগ্রামের অনেক হোটেল-রেস্টুরেন্টে সে ঐতিহ্য ধরে রাখতে মাটির প্লেটে পরিবেশন করা হয় মেজবানি খাবার। ফলে হারিয়ে যেতে বসা মাটির প্লেট, কলস, পেয়ালা ঘিরে কিছুটা হলেও ফিরতে শুরু করেছে মেজবানি।