ঘুরে আসতে পারেন সুনামগঞ্জের হাওর, নীলাদ্রি লেক, শিমুল বাগান ও বারিক্কা টিলা থেকে। টেকেরঘাটের নীলাদ্রি লেকের নীল জল,  দূরের পাহাড়, শিমুল বাগান ও বারিক্কা টিলার অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতি আপনাকে ভাবনায় ডোবাবে। লিখেছেন মিথু হোসাইন।

যান্ত্রিক এই শহরে ব্যস্ততম দিনে সকাল শুরু হয় এক কাপ চা কিংবা কফিতে। সেদিন কফিতে চুমুক দিতে দিতে ভাবছিলাম কোলাহলমুক্ত ও সবুজে ঘেরা কোথাও যাওয়া দরকার। অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয় না। প্রাণ কেমন যেন হায় হায় করছিল। এর মধ্যে হঠাৎ তপুর কল বেজে উঠল। জানাল, একটা ভ্রমণ গ্রুপের সঙ্গে সে সুনামগঞ্জের নীলাদ্রি লেক, শিমুল বাগান যাবে। কোনো কিছু না ভেবে ওদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আর ছোট যাব। দুটি সিট বুকিং দিলাম। ছোটও খুব খুশি। কারণ আমাদের দুই ভাইবোনের কারোই আগে সিলেট যাওয়া হয়নি। ব্যাগ গুছিয়ে রওনা হলাম। তিন দিনের জন্য সুনামগঞ্জ যাচ্ছি ভাবতেই কেমন লাগছে! আনন্দরা যেন বাতাসে দোল খাওয়া কলমি পাতার মতো মন নাড়াচ্ছিল।

রাত ১১টায় ফকিরাপুল থেকে বাসে উঠলাম। সবাই বাসের মধ্যে গান গাইতে গাইতে গিয়েছি। হৈহুল্লোড় করতে করতে যাচ্ছিলাম। ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়েও নিয়েছি। সুনামগঞ্জে নেমে হোটেল পানসিতে নাশতা করি। এর মধ্যে ঝুমবৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির শীতলতায় আমাদের মন সতেজ হয়ে উঠল। কয়েকজন মিলে গান শুরু করে দিই। দারুণ মুহূর্ত। তার পর ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে আবার লেগুনা দিয়ে তাহিরপুর বাজারের উদ্দেশে যাই। যেতে ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। ভ্রমণসঙ্গী সবাই খুব মিশুক। তাই আমাদের আড্ডা বেশ জমে উঠেছিল। ১ মিনিটের জন্যও কেউ বিরক্তবোধ করেনি। গান, আড্ডা, মজা করেই উপভোগ করেছি আঁকাবাঁকা রাস্তা, রাস্তার দুই পাশের গাছ ইত্যাদি। সবুজ প্রকৃতি চোখে প্রশান্তি এনে দিয়েছে। আমাদের ভ্রমণ গ্রুপের সাব্বির ভাই গাইড করেন সবাইকে। তাঁকে অনুসরণ করেই গিয়েছি সব জায়গায়।

তাহিরপুর বাজারের সঙ্গেই ঘাট। আমরা পৌঁছে যাই ঘাটে। হাওরে যাওয়া ও ঘোরার জন্য সাম্পান ঠিক করা হয়। আমরা মোট ৫০ জন। তাই দুটি সাম্পান নেওয়া হলো। সাম্পানের ছাদে বসে খোলা আকাশ দেখতে পাব, ভাবতেই দারুণ এক অনুভূতি কাজ করছে। বোট চলতে শুরু করল। হাওরের মাঝে ছোট ছোট ঘরবাড়ি দেখলাম। জেলেদের মাছ ধরা দেখলাম। কী নিপুণ দক্ষতায় জেলেরা জাল ফেলে মাছ ধরেন! হাওরের জল, নীল আকাশ ও চারপাশের দৃশ্য দেখে মন শান্ত হয়ে গেল। সে সময় তিনজন মিষ্টি মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। গল্প করতে করতে শুনলাম তাঁরা সময় পেলেই প্রকৃতির কাছে চলে আসেন।

অনেকটা পথ যাওয়ার পর মাঝখানে বোট থামিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম পানিতে। সুরক্ষার জন্য সবার কাছে লাইফ জ্যাকেট ছিল। যেহেতু অনেক পানি, তাই সবাই সতর্কভাবেই আনন্দ করেছি। অনেক বছর পর সাঁতার কাটতে পেরে ভীষণ ভালো লেগেছে। তার পর পানি থেকে উঠে যাই। এর মধ্যে আমাদের দুপুরের খাবার চলে আসে। বোটেই রান্না করা হয়েছিল নদীর পাবদা মাছ, গরম ভাত ও ভর্তা। পেটপুরে খেয়েছি। অমৃত লেগেছে। লাল চায়ে চুমুক দিয়ে যে যার মতো ছবি তুলে দু’চোখ ভরে পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখছিলাম। বোট থেকেই দেখছিলাম মোহমায় সব দৃশ্য। এক পর্যায়ে নীলাদ্রি লেকে পৌঁছলাম। সবুজ পাহাড়ের উঁচু-নিচু টিলা, স্বচ্ছ নীল জল দেখে আমরা চিৎকার করে উঠলাম। পাখির কিচিরমিচির আমাদের সময়কে আরও রাঙিয়ে দিয়েছে। সেখানের আকাশে-বাতাসে কেমন যেন এক মুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে ছিল। নীলের রাজ্যের এ স্থানকে অনেকেই বাংলাদেশের কাশ্মীর বলে থাকেন। তখন প্রায় সন্ধ্যা। ঝিঁঝিঁ পোকাদের অবিরাম শব্দব্যঞ্জনায় মুগ্ধ হলাম। আমাদের মতো ভ্রমণপ্রিয় অনেক মানুষ এসেছেন প্রকৃতির কাছে। আমরা চা খেয়ে গল্প করে সাম্পানে করেই ফিরে যাই । হাঁসের মাংস, ভাত, ডাল দিয়ে রাতের খাবার সেরেছি। তার পর জমজমাট গানের আসর!

হাওরের মাঝে খোলা আকাশের নিচে তারার আনাগোনা, মেঘের লুকোচুরি, মেঘের ভাঁজে হারিয়ে যাওয়া আবছা চাঁদও ছিল আমাদের সঙ্গী। মনে হচ্ছিল, নিজের জন্য মহামূল্যবান এই সময়। এভাবেই রাত কেটে যায়। ভোর হয় আজানের সুরে। পাখির কিচিরমিচির ভোরকে রাঙিয়ে দিল। উপভোগ করলাম সূর্য ওঠার দারুণ মুহূর্ত। মিষ্টি আপা, ভাবিকে নিয়ে সকাল দেখলাম। চা খেতে গেলাম। কিছুক্ষণ হাঁটলাম। সামনেই পাহাড়। স্নিগ্ধ ও সতেজ সকালে পাহাড় যেন সব সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আকাশকে ছোঁবে বলে। ঘোরাঘুরি শেষ করে ফিরে এলাম সাম্পান বোটে। নাশতা সেরে রওনা হলাম শিমুল বাগানের উদ্দেশে। শিমুল বাগানে সবুজের সমাহারও অনন্য। অন্যরকম মাদকতায় ভরায় ভ্রমণপিপাসুদের মন। শিমুল বাগান সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুরের মানিগাঁও গ্রামে প্রায় ১০০ বিঘার বেশি জায়গাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে। বসন্তকালে এখানে রক্তজবার মতো ফুটে থাকে শিমুল ফুল। গাছে গাছে সারাক্ষণ ডেকে বেড়ায় অগণিত পাখি। যাদুকাটা নদী, নদীর ওই পাড়ের মেঘালয় পাহাড় আর সবুজ গাছ ও রক্তিম ফুলের সমারোহ যে কাউকে মুগ্ধতায় ভাসাবে।

শিমুল বাগান ঘুরে চলে যাই বারিক টিলায়। আদিবাসীদের ঘরবাড়ি আছে আশপাশে। পাহাড়ি ফলও পাওয়া যায়। আমরা উঠতে শুরু করলাম বারিক টিলায়। আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে পাহাড়ে উঠতে বেশ সময় লেগেছে। উঠতে উঠতে পৌঁছে গেলাম। পাশেই ভারতের সীমানা। সাইনবোর্ডে বড় অক্ষরে  লেখা আছে– সীমান্ত অতিক্রম করা যাবে না। অবশেষে বারিক টিলা জয় করলাম। মেঘগুলো ছোটাছুটি করছিল। নিচে নয়নাভিরাম যাদুকাটা নদী। নিমেষেই ক্লান্তি দূর হয়ে গেল।
কীভাবে যাবেন?

ঢাকার সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন মামুন ও শ্যামলী পরিবহনের বাস সরাসরি সুনামগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এসব বাসে জনপ্রতি ভাড়া ৬৫০ টাকা। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ পৌঁছাতে প্রায় ৭ ঘণ্টা সময় লাগে। আপনার সুবিধামতো রাতের বাসে সুনামগঞ্জ রওনা দিলে সকাল ৭টার মধ্যে সুনামগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাতে পারবেন। সকালের নাশতা করে সিএনজি বা লেগুনা ভাড়া করে তাহিরপুরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ুন। সুনামগঞ্জ থেকে তাহিরপুর যেতে ঘণ্টা দেড়েক লাগে। তার পর ঘাট থেকে নৌকা ঠিক করে যদি নিজেরা বা মাঝির সঙ্গে আলাপ করে দু’দিন এক রাতের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে ফেলুন। নৌকা অনুযায়ী ভাড়া ৩ হাজার থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা হতে পারে। চেষ্টা করুন সকাল  ১১টার মধ্যে নৌকায় উঠে পড়ার।

নৌকা নিয়ে সোজা যেতে পারেন ওয়াচ টাওয়ার এলাকায়। ওয়াচ টাওয়ার থেকে জলাবনের সৌন্দর্যের পাশাপাশি ছোট ছোট নৌকা নিয়ে শিশুদের ঘুরতে দেখবেন। ওয়াচ টাওয়ার দেখে উন্মুক্ত হাওরের মাঝে বেরিয়ে পড়ুন। দিগন্তজোড়া জলরাশি ও দূরের পাহাড়ের রূপ দেখতে দেখতে দুপুরের পর টেকেরঘাট যেতে পারেন। টেকের ঘাটের দিকে যতই এগোতে থাকবেন, ততই পানি স্বচ্ছ দেখতে পাবেন এবং দূরের পাহাড়গুলো আরও স্পষ্ট হতে থাকবে। সেখানে নৌকায় সকাল পর্যন্ত যে পরিকল্পনা দেওয়া আছে, তার মতোই সবকিছু করবেন। সকালে ফ্রেশ হয়ে নৌকা ছেড়ে দিন। নাশতা করে টেকেরঘাট থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে শিমুল বাগান, বারিক টিলা ও যাদুকাটা নদী দেখতে রওনা দিতে পারবেন। বারিক টিলা ঘুরে দেখার পর নৌকায় যাদুকাটা নদী পার হয়ে লাউড়ের গড় বাজারে যাওয়া যাবে।  লাউড়ের গড় বাজার থেকে বাইক অথবা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ঘণ্টা দেড়েক সময়ে সুনামগঞ্জ সদর চলে যেতে পারবেন। লাউড়ের গড় থেকে সুনামগঞ্জ শহরের দূরত্ব প্রায় ২৮ কিলোমিটার। v

বিষয় : নীলাদ্রি লেক

মন্তব্য করুন