ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

একদিন তুলি ফুল মালা গাঁথি তায়

একদিন তুলি ফুল মালা গাঁথি তায়

জাহাঙ্গীর আলম জাহান

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৯ আগস্ট ২০২২ | ০২:১৮

দীনেশ চন্দ্র সেন সংকলিত 'মৈমনসিংহ গীতিকা'র পুরোটা জুড়েই ছড়িয়ে আছে আজকের কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার তৎকালীন সমাজচিত্রের ট্র্যাজিক উপাখ্যান। লোককবিরা প্রচলিত গ্রামীণ সুরে বিভিন্ন ট্র্যাজিক কাহিনি গ্রামে গ্রামে পরিবেশন করতেন। সুরের তেমন বৈচিত্র্য না থাকলেও অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে সুরে সুরে পরিবেশন করা হতো, এতে শ্রোতার মধ্যে বিরক্তি নয়, আবেগে উদ্বেলিত হতো। নারীদের দুঃখ-জাগানিয়া গল্পগুলো মানুষের কাছে হয়ে উঠত উপভোগ্য। আর লোককবিরা মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হতেন। যাত্রাপালা, পুঁথি কিংবা ভাটকবিতা শুরুর আগে, যেমন- গৌরচন্দ্রিকা বা প্রস্তাবনার মতো এসব গীতিকা পরিবেশনের আগে বন্দনা পরিবেশন করা হতো। ফলে শ্রোতা পুরো কাহিনির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠতেন।

আনুমানিক ষোড়শ শতক থেকে ঊনবিংশ শতকের মধ্যে পূর্ববাংলায় এসব গীতিকা বিকশিত হয়; যা আগে মুখে মুখেই প্রচলিত ছিল। সেই মৌখিক রত্নভান্ডারকে লিখিত আকারে তুলে ধরার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ছিলেন কেন্দুয়া উপজেলার আইথর গ্রামের হতদরিদ্র স্বল্প লেখাপড়া জানা সাধারণ এক মানুষ চন্দ্র কুমার দে। তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে গীতিকাগুলো সংগ্রহ করে লিখিত অবয়ব দেন। সেই গীতিকাগুলো পরিমার্জন করে দীনেশ চন্দ্র সেন নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করলেন 'মৈমনসিংহ গীতিকা'। ফলে বাংলা লোকসংস্কৃতির এক বিশাল ভান্ডারই শুধু উন্মোচিত হলো না, চিরায়ত গ্রামীণ বাস্তবতা এবং নারীদের দুঃখ-কষ্ট-বঞ্চনা ও জীবনধারার বাস্তব রূপ প্রতিফলিত হলো। 'মৈমনসিংহ গীতিকা'য় সংকলিত অনেক উপাখ্যানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গীতিকা হচ্ছে 'চন্দ্রাবতী'। চন্দ্রাবতীকে আমরা বাংলাদেশের মধ্যযুগীয় প্রথম নারীকবি হিসেবে শনাক্ত করেছি। কিশোরগঞ্জের কাচারিপাড়া বা পাতুয়াইর গ্রামকেই চিহ্নিত করা হয়েছে চন্দ্রাবতীর পৈতৃক গ্রাম হিসেবে। পুরোনো দ্বিতল ভবন ও দুটি শিব মন্দিরকে চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি ও মন্দির হিসেবে পর্যটকরা মেনে নিয়েছেন।
নয়ানচাঁদ ঘোষ নামক এক গ্রামীণ পালাকার চন্দ্রাবতীর প্রেম-বিরহের চালচিত্র নিয়ে 'চন্দ্রাবতী' পালাটি রচনা করেছিলেন। এই পালায় জয়ানন্দ নামক এক ব্রাহ্মণ যুবকের সঙ্গে চন্দ্রাবতীর প্রণয় এবং প্রতারিত হওয়ার কাহিনি খুব সরল অথচ বেদনাময় ভাষ্যে তুলে ধরা হয়েছে। জীবনালেখ্য-নির্ভর পালাটি শুনে ও মঞ্চে দেখে আজও শ্রোতা-দর্শক বেদনায় ভারাক্রান্ত হন। অনেকে নীরবে অশ্রুপাত করেন। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে চন্দ্রাবতী চিরকুমারীর ব্রত নিয়ে পিতার নির্দেশে রামায়ণ রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। তার রচিত 'রামায়ণ' হয়ে ওঠে বাল্মীকির রামায়ণ অপেক্ষা ভিন্নতর। রামায়ণ গানের মধ্য দিয়ে ক্ষিতিষ চন্দ্র মৌলিকের সংগৃহীত চন্দ্রাবতীর 'রামায়ণ'-এর শেষ পরিচ্ছেদে সীতার বনবাস, তাঁর সন্তান প্রসব এবং তাঁদের লালন-পালন করার আটপৌরে আবহমান চিত্রটি ফুটে উঠেছে। এসেছে সীতার অপমানকর অগ্নিপরীক্ষার কথাও। চন্দ্রাবতী এর সমাপ্তি টেনেছেন বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক নির্মমতা থেকে নিপীড়িত-অপমানিত সীতাকে পৃথিবী-প্রকৃতির বুকে টেনে নেওয়ার দৃশ্যায়নের মধ্য দিয়ে। চন্দ্রাবতী কাব্যে আছে- 'ডাল যে নোয়াইয়া ধরে জযানন্দ সাথী।/তুলিল মালতী ফুল কন্যা চন্দ্রাবতী।/একদিন তুলি ফুল মালা গাঁথি তায়।/সেইত না মালা দিয়া নাগরে সাজায়'। মধ্যযুগীয় এই নারীকবি ট্র্যাজিক কাব্যের অমর নায়িকা হিসেবে শুধু কিশোরগঞ্জকেই নয়, গোটা বাংলাদেশ ও বাংলা সাহিত্যকেই মহিমান্বিত করেছেন।
উপদেষ্টা সুহৃদ সমাবেশ কিশোরগঞ্জ

আরও পড়ুন

×