
২০১২-তে যা হওয়ার কথা ছিল সেটা নিয়ে সিনেমা হয়েছে, বাস্তবে কিছু ঘটেনি। সেপিয়েন্সরা মনে করে যে পৃথিবী তাদের সে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়নি। ধ্বংস হওয়ার কথা ছিল নাকি?
ছিল।
কে বলেছে?
মায়ান ক্যালেন্ডার।
সত্যি বলেছে কিনা হদিস নাই, কিছু প্রমাণ-সমানও হয়নি, ২০১০-১১ থেকেই শোর উঠেছিল ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কেন নয় মায়ানদের ক্যালেন্ডারে ২০১২-র পর আর কিছু নাই। সেটা কি সম্পূর্ণ ক্যালেন্ডার? মায়া সভ্যতার কোনো মায়া বলেছে?
হুজুগে সেপিয়েন্স। ঘুরছে ফিরছে নাইট পার্টি করছে আর ভেবে ভেবে হদ্দ হয়ে যাচ্ছে– পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।
হদ্দ হওয়া কী? কে জানে কী?
হদ্দ সেপিয়েন্সদের বলে কয়ে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল আর কি! বলে কয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে!
হুমায়ূন স্যারের কাছে গেছি সন্ধ্যায়। প্রচ্ছদ দেখানো এবং টাকিলার সন্ধ্যা। সেই মেসেজ এখনও আমার ফোনে আছে, আজ প্রচ্ছদ দেখাতে যাব কিনা কাল রাতে মেসেজ দিয়েছিলাম স্যারকে, দুপুরে স্যার রিপ্লাই দিয়েছেন, ‘ইয়েস, ইয়োর টাকিলা ইজ রেডি।’
আমার টাকিলা।
স্যারের হুইস্কি।
আমি স্যারের বইয়ের প্রকাশক না, নাট্যজগৎ সিনেমাজগতের কেউ না, তাও প্রশ্রয় এত পেয়েছি যে বোকাসোকা যে কোনো কথাও স্যারকে যখন তখন বলে ফেলতে পারতাম। কুণ্ঠা বোধ হতো না। জন্মম্রিয়মাণ আমি কখনও অকপট ছিলাম কেবল এই একজন মানুষের সঙ্গেই মনে হয়। যখন যা মনে হয় বলে ফেলেছি।
‘স্যার পৃথিবী কি সত্যি ধ্বংস হয়ে যাবে?’
‘সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে।’
‘না এই যে মায়ান ক্যালেন্ডারে নাকি বলছে–।’
‘দুই হাজার বারো সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে?’
‘জি।’
স্যার বরফ নিলেন, গ্লাসে ঢেলে এক চুমুক দিলেন। সিগারেট ধরালেন। বা এ রকম কিছু না হয়তো। স্যার বললেন, ‘শোনো, পৃথিবীর ওজোন স্তরে যে একবার ফুটো ধরা পড়েছিল জানো?’
‘জি। রেডিওতে শুনছি, পত্রিকায় দেখসি।’
‘হ্যাঁ। বিরাট চিন্তায় পড়ছিল মানুষ। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা চিন্তা করে পেরেশান হচ্ছিলেন, ওজোন স্তর মেরামত কী করে করবেন। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট। তার পরে কী হলো বলো তো?’
আমি জানি না।
‘পৃথিবী নিজেই তার ওজোন স্তর ঠিক করে ফেলল।’
অত বিজ্ঞান ঢোকে আমার মাথায়? কিন্তু ইনি হুমায়ূন আহমেদ। থট এক্সপেরিমেন্টের মতো জটিল ব্যাপারও সহজে বুঝিয়ে দিতে পারেন কাউকে। শ্রোয়েডিংগারের বেড়াল প্রসঙ্গে এই থট এক্সপেরিমেন্টের কথা বলেছিলেন একদিন। যখন শুনছি মনে হয়েছিল, আরে, এতো সহজ! পরে দেখি সহজ কিছুই মনে নাই। ন্যূনতম বিজ্ঞানবোধ ছাড়া এসব নিয়ে চিন্তা না করাই শ্রেয়। মাথা বিগড়ে যেতে পারে। বরং স্যার আর কী বলেন শুনি।
‘শোনো, পৃথিবীর একদল বিজ্ঞানী আছেন, যাঁরা মনে করেন পৃথিবী নিজেই একটা প্রাণী। এই তথ্য নিয়া প্রচুর কাজও তারা করছেন। তাদের ধারণা ভুল সেটা কিন্তু কেউ দাবি করে নাই। এখন পৃথিবী যদি প্রাণী হয়ে থাকে, ধরে নিলাম প্রাণী, তাহলে নিজেই নিজেকে রক্ষা করবে সে।’
স্বস্তির কথা। কিন্তু এই মানুষটা হলেন টুসিটালা হুমায়ূন আহমেদ। টুসিটালা– যে গল্প বলে মুগ্ধ করতে পারে। কোন ভাষার শব্দ বলতে পারব না। ‘ট্রেজার আইল্যান্ডে’র লেখক রবার্ট লুই স্টিভেনসনকে সামোয়া দ্বীপের আদিবাসীরা ডাকত। রোগাক্রান্ত স্টিভেনসন জীবনের শেষ চার বছর ছিলেন সামোয়া দ্বীপে। সন্ধ্যায় গল্প শোনাতেন সামোয়ার আদিবাসী ছেলে বুড়োদের। আমি শুনি হুমায়ূন আহমেদের কথা, সন্ধ্যায়।
আগের কথায় রেশ ধরে স্যার বললেন, ‘কিন্তু প্রাণী ... যে কোনো প্রাণী তো আত্মহত্যাপ্রবণ হতেই পারে। পৃথিবী যদি সেরকম আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে থাকে?’
২০১২ থেকে ২০২৩। সেই সন্ধ্যা মন থেকে যায়নি, যাবে না। প্রশ্নটাও মন থেকে যায়নি, যাবে না আর কখনও হয়তো, পৃথিবী কি আত্মহত্যাপ্রবণ?
মন্তব্য করুন