
হক সাহেব মারা যাবেন ঠিক তিন দিন পর। পবিত্র শুক্রবার। বিষয়টা তিনি জানেন না। তিন দিন পর কী হতে পারে– এই বিষয়ে তার কোনো ধারণাই নাই। তিনি এখন দিব্যি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। উচ্চতায় পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। প্রশস্ত বুক। হাতের পেশি বেশ সুদৃঢ়। মাইলের পর মাইল হাঁটলেও তিনি ক্লান্ত বোধ করেন না। অবশ্য বংশগত কারণে কিছু রোগ তার শরীরে বাসা বেঁধেছে। ডায়াবেটিস, প্রেসার, ফুসফুসে প্রদাহ। এই সব রোগকে তিনি পাত্তা দেন না। ডাক্তারের পরামর্শমতো নিয়ম করে ওষুধ খান, হিসাব করে রুটিন ধরে খানাদানা করেন, প্রতিদিন সকালে পাঁচ কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি করেন। বয়সের তুলনায় তার চেহারায় বার্ধক্যের বলিরেখা একদম চোখে পড়ে না। মুখভর্তি দাড়ি, মাথায় কোঁকড়ানো চুল কাঁচা-পাকা। কপালের সামনের দিকের কিছু চুল হালকা হয়ে এসেছে। তবে সেটা ভালো করে নজর না দিলে বোঝার উপায় নেই। নিজের সুস্থ শরীর আর ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করতে পারার দক্ষতা নিয়ে সব সময় তার মধ্যে একটা পরিতৃপ্ত ভাব আছে। ফলে মারা যাওয়ার সাতদিন আগেও নিজের মৃত্যুর বিষয়ে তার কোনো ভাবনা-চিন্তাই ছিলো না। এমনকি তিনি যে মারা যাবেন এই সম্ভাবনাটুকুও কখনো তার মাথায় উঁকি দেয়নি। বরং মাঝে মাঝে তার মনে হতো তিনি যে কবে মারা যাবেন সেটা আল্লাহই ভালো জানেন। হয়তো তার কখনো মৃত্যুই হবে না। অবশ্য নিজের মৃত্যুর বিষয়ে বছর খানেক আগে তিনি স্বপ্নে একটা সূত্র পেয়েছিলেন যে, ঠিক এক বছর পর তার মৃত্যু হবে। তখন বেশ কয়েকদিন মৃত্যু চিন্তা তাকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। হক সাহেব খুব শক্ত মনের মানুষ ছিলেন বিধায় কয়েকদিন পরই আবার সব শামলে নিয়ে প্রাত্যহিক কাজে নিজেকে জড়িয়ে নেন আর ভুলে যান মৃত্যুচিন্তা বিষয়ক স্বপ্নের কথা। এমনকি মারা যাওয়ার সাত দিন আগেও হক সাহেবের মাথায় মৃত্যু বিষয়ক কোনো সম্ভাবনাই উঁকি দেয়নি। যথারীতি মারা যাওয়ার সাত দিন আগে তিনি অভ্যাসবশত মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসে একা একা কিছুক্ষণ আল্লাহর সাথে কথা বলেন। তসবিহ তাহলিল পড়েন। তারপর ফজরের নামাজ শেষ করে সবচেয়ে ছোট মেয়ের সাথে কথা বলেন। হক সাহেবের চার মেয়ে ও এক ছেলে। পাঁচ সন্তানের তিনজনই থাকে দেশের বাইরে। বড় মেয়েটা তার বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে বাবার বাসায় আছে দীর্ঘদিন। বড় মেয়ের জামাই থাকে ইউরোপ। মেজো মেয়েটা স্বামী-সন্তানসহ থাকে লন্ডন। সেজো মেয়েটা অনেক দিন হয় বাবার বাসায় আছে। বিয়ের দীর্ঘদিন পরও মেয়েটার কোনো বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি। এই নিয়ে সংসারে অশান্তি। সেজো মেয়েটার বাবু হওয়া নিয়ে হক সাহেবের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তিনি একটা আমল পেয়েছেন। কাবা শরিফের গিলাফ ধরে এই আমল করলে নাকি মানুষ যা চায় তাই পায়। হক সাহেব এই আমলটা করতেছেন গত দুই মাস ধরে আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছেন– আল্লাহ যেন তার সেজো মেয়েটার কোলজুড়ে একটা সন্তান দেন। পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট মেয়েটা হক সাহেবের জন্য খুব পাগল। ছোট মেয়ের সাথে কথা শুরু হলে দীর্ঘক্ষণ তার কথা চলে। সকাল ছাড়া মেয়েটার সাথে কথা বলার জন্য সারাদিন আর সময় পান না। পড়াশোনা নিয়ে ছোট মেয়ে খুব ছোটাছুটি করে। মেয়েটা এত পেরেশানি কেনো করে হক সাহেব জানেন না। ছোট মেয়ে বাবার খুব নেওটা। ঘুম থেকে উঠে বাবার কথা না শুনলে নাকি মেয়ের দিন ভালো যায় না। হক সাহেব ঘড়ি ধরে ধরে সময় ঠিক করে সবার সাথে কথা বলেন।
‘কি গো মা বিলকিস তোমার ঘুম ভাঙছে নি?’
‘আসসালামু আলাইকুম আব্বা। জি ঘুম ভাঙছে। আপনার সাথে কথা না বললে খালি মনে হয় কী জানি করি নাই, কী জানি করা হয় নাই। আব্বা আপনার শরীরটা ভালো তো? সকালে উইঠা কিছু খাইছেন?’
‘না মা। এখনো খাই নাই। এত সকালে ঘুম থেকে উইঠা কিছু খাইতে ইচ্ছা করে না। তোমার মায় কী করে? ঘুম ভাঙছে?’
‘মায় ফজরের নামাজ পইরা এখনো ঘুমায়তেছে। আব্বা একটা কথা।’
‘কী কথা মা?’
‘আব্বা আমার স্কুলে পড়তে ভালো লাগে না। এত পড়াশোনা কইরা কী হইবো। স্কুল কোচিং, প্রাইভেট এইসব করতে করতে আমার হয়রান লাগে।’
‘তয় কী করতে চাও আম্মাজান?’
‘আপনার কাছে আইসা পরি। আপনে একা একা থাকেন। কী খান না খান। আপনার সেবা-যত্ন করমু। রান্নাবান্না কইরা দিমু। আপনার সাথে কাবা শরিফ দেখতে যামু। মদিনা শরিফ দেখতে যামু। সারাদিন পর কাজ কইরা আইসা দেখবেন ঘরে আপনার মায় আপনার জন্য রান্নাবান্না কইরা রাখছে।’
ছোট মেয়ের কথা শুনে হক সাহেবের চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে। চোখের পাপড়িতে শিশিরের মতো পানি জমে। গলা ভার হয়ে আসে। তিনি কষ্ট করে ঢোক গিলে বলেন, ‘আম্মা বিলকিশ আপনারে এত কষ্ট করতে হবে না। আর কয়দিন পর আমিই চলে আসব দেশে।’
হক সাহেব থাকেন সৌদি আরব। ত্রিশ বছরের প্রবাসজীবন। আরব দেশের সব কিছু তার কাছে আরবদের মতোই পরিচিত। হক সাহেবের চেহারাতেও আরবদের মতো কেমন একটা ভাব চলে এসেছে। মাথায় গোল চাক্কি লাগিয়ে লম্বা জুব্বা পরে রাস্তায় বের হলে সৌদি আরবের পুলিশরাও মাঝে মধ্যে তাকে শায়েখ ভেবে সমীহ করে চলে। দীর্ঘ প্রবাসজীবন সৌদিতে কাটানোর কারণে তার আকামা ওয়ার্কপারমিটসহ যাবতীয় সব কাগজ বেশ মজবুত। কোথাও কোনো ভেজাল নাই।
হক সাহেব একরুমের একটা বাসায় থাকেন। তার রুমমেট হলো আরেক বাঙালি। জসিম সাহেব। জসিম সাহেব কয়েকদিন ঠান্ডা কাশিতে খুব কষ্ট করলেন। মৃদু জ্বল ছিলো। এখন অবশ্য সব ঠিক হয়ে গেছে। জসিম সাহেবের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। হক সাহেবের চেয়ে দশ বছরের ছোট। হক সাহেব তাকে ছোট ভাই বলে সম্বোধন করেন। জসিম সাহেবেরও দেশের বাড়িতে দুই মেয়ে। সৌদিতে এসে দেশের বাড়িতে জমিজমা কিনেছেন, বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, ছোটটার কথা চলতেছে। আর কয়টা বছর সৌদিতে থাকতে পারলে সবকিছু মোটামুটি গুছিয়ে ফেলতে পারবেন। জসিম সাহেব খুব পছন্দ করেন হক সাহেবকে। এইরকম মেয়ে অন্তঃপ্রাণ বাবা খুব একটা দেখেন নাই জসিম সাহেব। তার নিজেরও দুইটা মেয়ে। সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ পর হয়তো মেয়েদের সাথে তার একটু-আকটু কথা হয়। বড় মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের জামাই শুধু খামখাম করে। এটা দাও, ওটা দাও। আব্বারে বলো সৌদি সোনার চেইন পাঠাতে। ঘড়ি পাঠাতে। গোল্ডের ব্রেসলেট পাঠাতে। একটা উল্লুক জামাই পড়ছে তার মেয়ের কপালে। সেই তুলনায় হক সাহেব খুব ভাগ্যবান। হক সাহেবের মেয়েগুলো বাপের জন্য পাগল। মেয়ের জামাইগুলোও পাগল। ছোট মেয়ের সাথে হক সাহেবের কথা শেষ হলে জসিম সাহেব হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী হক ভাই খুব খুশি মনে হয় মেয়ের সাথে কথা বলে।’
‘হ ভাই। মেয়েটার সাথে কথা বললে খুব শক্তি পাই। আমার পাগলি মাইয়া। পড়াশোনা শেষ না কইরা সে সৌদি আরব বাবার কাছে চলে আসতে চায়। বাবাকে রান্নাবান্না করে খাওয়াবে। কেমন পাগল বুঝেন এবার।’
জসিম সাহেব দেয়ালে ঝুলানো ঘড়ির দিকে তাকান।
‘হক ভাই আপনার মেজো মেয়ের সাথে কথা বলার সময় হয়ে গেছে।’
হক সাহেবের মেজো মেয়ে, মেয়ের জামাই, সন্তান সব থাকে লন্ডনে। ফলে ঘড়ি ধরে সময় মিলিয়ে তাকে সবার সঙ্গে কথা বলতে হয়।
‘আব্বা কেমন আছেন?’
‘ভালো আছি মাগো। তোমার কি অবস্থা? আমার ভাইডা কী করে, দুষ্টুমি করেনি ঠিকমতো?’
হক সাহেব ফোনে মেজো মেয়ের মৃদু হাসির শব্দ শুনতে পান। মেয়েটা লন্ডন চলে যাওয়ার পর থেকে কথা বলার সময় খুব কিতাবি ভাষায় কথা বলে। এত শুদ্ধভাষায় মেয়েটা কথা বললে হক সাহেব কেমন খেই হারায়া ফেলেন। মাঝে মধ্যে মনে হয় তখন তার মেয়ে না অন্য কেউ কথা বলছে।
‘আব্বা প্রেসারের ওষুধগুলো খাচ্ছেন ঠিকমতো?’
‘খাই মা।’
‘আর কত বিদেশ করবেন আব্বা? অনেক কাজ করেছেন জীবনে। এবার একটু বিশ্রাম নেন।’
‘এই তো মা আর কয়টা মাস কাজ। তারপর বিশ্রাম নিবো।’
‘দেশে যাওয়ার ভাবনা-চিন্তা করেছেন কিছু?’
‘আর ছয় মাস কাজ করলে কোম্পানির সাথে আমার চুক্তি শেষ হইবো। অনেকগুলো টাকা জমে আছে কোম্পানিতে। ছয় মাস শেষ না করলে টাকাগুলো পামুনাগো মা। টাকাগুলো হাতে আসলে বাড়ির বাকি কামডা শেষ হইতো।’
হক সাহেব ফোনের অপর প্রান্ত থেকে মেয়ের একটা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পান।
‘আব্বা একটা জরুরি কথা খুব মন দিয়ে শোনেন। পৃথিবীর অবস্থা কিন্তু ভালো না। আপনি তো জানেন সারা পৃথিবীজুড়ে কভিড মহামারি ছড়িয়ে পড়ছে। ইউরোপের অবস্থা ভয়াবহ এখন। লন্ডনের অধিকাংশ শহর এর মধ্যেই সিলড করে দিয়েছে। আল্লাহ এমন এক গজব পাঠিয়েছেন যে এর কোনো চিকিৎসা নাই। সবকিছু বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমরা যে শহরে আছি দুই-একদিনের মধ্যে সেটাও লকডাউনের আওতায় পড়ে যাবে। খুব বিপদ আব্বা সামনে।’
হক সাহেব মৃদু হাসেন। কীসের বিপদ। এইসব বিপদআপদ শুধু অনাচারে ভরা ইউরোপ-আমেরিকাতেই হবে। নবীর দেশ সৌদি আরবে এইসব আসবে না। কিন্তু মেয়েকে তিনি এইসব বলেন না।
‘ঠিক আছে মা সাবধানে থাকব। চিন্তা কইরো না। তোমরা সাবধানে থাইকো।’
‘আব্বা আপনাকে সর্বোচ্চ সাবধানে থাকতে হবে। এমনিতেই আপনি হাসপাতালে কাজ করেন। মুখে মাস্ক ব্যবহার করবেন। সব সময় হাত সেনিটাইজ করবেন। গ্লাভস পরবেন।’
‘এত চিন্তা কইরো না মাইও। নবীর দেশ আল্লাহ রক্ষা করবেন।’
মেজো মেয়ের সাথে কথা শেষ করে হক সাহেব ঘড়ি দেখেন। কাজে যাওয়ার সময় হয়েছে। হক সাহেব একটা রাষ্ট্রায়ত্ত হাসপাতালের আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সচালক। ইউরোপজুড়ে তখন কভিড মহামারির ছোবল। সেই ছোবল সৌদি আরবের কয়েকটা শহরে অল্প অল্প করে পড়েছে। লোকজন ছোঁয়াছুঁয়ি মহামারিকে বিশ্বাস করতে চায় না। ওতে বিশ্বাস করলে নাকি ইমান চলে যাবে। তাই লোকজন খুব বেখেয়ালি। অসাবধান। হক সাহেব কাজে বের হয়ে যান। গাড়িতে বসেই খবরে শুনতে পান সৌদি আরবের যে শহরে হক সাহেব থাকেন সেই শহর কভিড মহামারির সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহর। শহরের অধিবাসীদের ঘরের ভেতর থাকতে এবং বিনা প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে। গাড়ি নিয়ে বের হয়ে হক সাহেব তার সত্যতা টের পেলেন। রাস্তাঘাট অন্য সব দিনের চেয়ে অনেক বেশি নীরব। হক সাহেব ঘড়ি দেখেন। নয়টা বিশ বাজে। এখন তার বড় ছেলের সাথে কথা বলা যায়। হক সাহেবের একমাত্র ছেলে থাকে স্পেন। সৌদির সাথে স্পেনের সময়ের দূরত্ব এক ঘণ্টা আগপিছ। ছেলে সকালে কাজে বের হয়ে যায়। সারাদিন আর তার সাথে কথা বলা যায় না। রাতে ফোন দিলে ছেলে ফোন ধরে না। ছেলেটার সাথে হক সাহেবের একটু দূরত্ব আছে। বাবার ওপর খুব অভিমান ছেলের। তিনি নাকি তার বাড়ির প্রায় সবটাই মেয়েদের দিয়ে দিয়েছেন। এই নিয়ে বাপ-ছেলের মধ্যে খুব মনকষাকষি। হক সাহেব ফোন দিলেন। রিং হলো বেশ কয়েকবার। ছেলে ফোন ধরল না। তিনি অবশ্য হাল ছাড়লেন না। আবার ফোন দিলেন।
‘হ্যালো আব্বা। এতবার ফোন দেয়ার কী হয়েছে। পরশু দিন তো আপনার সাথে কথা হলো।’
ছেলের কথায় হক সাহেবের মনটা খুব খারাপ হয়। তিনিও তার বাবার সাথে সব সময় এইরকম ঝাঁজ দিয়েই কথা বলতেন। হক সাহেব মন খারাপ ভাব সরিয়ে কথা চালিয়ে যান।
‘তোমার কী অবস্থা বাজান। তোমাকে তো এই সময় ছাড়া আর পাওয়া যায় না। তাই একটু বিরক্ত করি। বাবার সাথে এত রেগে থাকলে চলে?’
‘রেগে নেই। কেনো ফোন দিয়েছেন বলেন।’
‘আমার নাতি-নাতনিরা কেমন আছে?’
‘আপনি সরাসরি ওদের সাথে কথা বললেই ভালো হয়। ওদের সাথে তো আপনার সারাদিনই কথা হয়।’
‘বাজানরে তোর বাপের সাথে রাগ কইরা থাকিস না। আমি আর কয়দিন বাঁচমু। তরে দেখতে মন চায়। নাতিগুলারে দেখতে মন চায়।’
‘আব্বা আপনে সকাল সকাল কী শুরু করলেন?’
‘শোন বাজি আমি আর ছয় মাস পর একবারে দেশে চলে যামু। কোম্পানির জমানো টাকা দিয়ে বাড়ির ছয়তলার কাজটা শেষ করে তরে দুইতলা আর বোনদেরকে এক তলা এক তলা করে লিখে দিয়ে যামু। আমার সাথে আর রাগ কইরা থাকিস না।’
এই কথা শোনার পর মনে হলো হক সাহেবের বড় ছেলে কিছু একটা চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘আপনার যা ইচ্ছে করেন।’
‘বাজান তোমাদের ওখানে মহামারির কী খবর?’
‘খুব খারাপ খবর আব্বা। সবকিছু বন্ধ করে দিতেছে। নতুন একটা ফুডের ব্যবসা খুলেছিলাম। সমস্ত পুঁজি এখানে ঢাললাম। এখন ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে সরকার। আমার মাথা ঠিক নেই।’
‘বাজিগো সাবধানে থাইকো।’
‘আপনেও সাবধানে থাইকেন।’
ফোন কেটে গেলো। বড় ছেলের সাথে কথা শেষ হলে সব সময় তার বুকটা কেমন ভার হয়ে থাকে। কেমন একটা চাপ চাপ অনুভব বুকের মধ্যে থেকে যায় দীর্ঘ সময়।
ইমার্জেন্সি কলে এক আরবের বাসা থেকে বয়স্ক এক রোগী নিয়ে হক সাহেব হাসপাতালে ছুটে যান। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানোর সময় সবাই ভয়ে ভয়ে দূরে সরে যায়। হক সাহেব গ্লাভস আর মাস্ক পরে রোগীকে হাসপাতালের বেডে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। রোগীর শ্বাসকষ্ট। লোকজন সব কেমন আতঙ্কিত চোখে তাদের দিকে তাকাচ্ছে। রোগীকে ইমার্জেন্সিতে ভর্তির পর ডাক্তারের নির্দেশে হক সাহেব নিজের হাত, পা, মুখ সবকিছু স্যানিটাইজ করে আসেন। তারপর গাড়িতে গিয়ে আবার বসেন। ছেলের সাথে কথা শেষ হওয়ার পর সেই যে তার বুকটা ভার হয়ে আছে। কিছুতেই সেটা কাটছে না। বড় মেয়ের সাথে তার আজকে কথা হয়নি। কারো সাথেই কেন জানি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। দুপুরের দিকে হক সাহেব লক্ষ্য করলেন তার তীব্র মাথা ব্যথা। প্রেসারটা কি বেড়ে গেলো। নাক দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে। হক সাহেব গাড়ির এসি বন্ধ করে জানালা খুলে দিলেন। বিকেলের দিকে বুঝতে পারলেন তার শরীর মেজমেজ করছে। মনে হয় জ্বর আসছে। সন্ধ্যার পর হক সাহেব যখন বাড়ি ফিরলেন তখনো শরীরটা কেমন ভারী হয়ে ছিল। বাসায় ফিরে গোসল করলেন গরম পানি দিয়ে। তারপর নামাজ পড়লেন আর তার মনে হলো শরীরটা একদম হালকা হয়ে এসেছে। কোনো জ্বর নেই শরীরে।
রাতের খাবার না খেয়েই হক সাহেব শুয়ে পড়লেন। খুব ঘুম পাচ্ছে তার। রুমমেট জসিম সাহেব বাসায় ফিরে দেখেন হক সাহেব শুয়ে আছেন। কপালে হাত দিয়ে দেখেন উথালপাতাল জ্বর। রাতেই হক সাহেবকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। হঠাৎ করে তার প্রেশার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে। অক্সিজেন লেভেল কমে গেছে। দুইদিন সময় লাগল হক সাহেবের সবকিছু স্বাভাবিক হতে। জ্বর কমেছে, প্রেসার নিয়ন্ত্রণে, শুধু নাকে অক্সিজেনের নল লাগানো। দুইদিন পর হুঁশ ফিরলে হক সাহেব বুঝতে পারলেন না তিনি কোথায়। বেশ কিছু সময় পর যখন জানতে পারলেন তিনি হাসপাতালে, তখন তার সমস্ত শরীরে ভয়ের কাঁপুনি শুরু হয়ে গেলো। ছেলেমেয়েদের সাথে তার কথা হয়নি। ডাক্তার তীব্রভাবে নিষেধ করেছেন কারো সাথে যেন কথা না বলে। দুপুরের দিকে হক সাহেবের কাছে মোবাইল দেয়া হলো। মোবাইল খুলে দেখেন বাড়ি থেকে অসংখ্যবার ফোন এসেছে হক সাহেবের নাম্বারে। হক সাহেব যেই ওয়ার্ডে থাকেন সেখানে রোগীর ভিড় খুব একটা বেশি না। কিন্তু ডাক্তার-নার্স সবাই ভয়ংকর চেহারার পোশাক পরা। বাইরের কারো এখানে ঢোকার সুযোগ নেই। এই হাসপাতালে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তিনি। কখনো এইরকম ভীতিকর অবস্থা দেখেননি। সুদূর লন্ডন থেকে হক সাহেবের মেজো মেয়ে ফোন করল।
হক সাহেব ফোন রিসিভ করেই শুনতে পেলেন মেয়ে কাঁদছে।
‘আব্বা, আব্বা। যা ভয় পেলাম তাই হলো।’
ফুঁপিয়ে কান্নার ধাক্কায় মেজো মেয়ে ঠিকমতো কথা বলতে পারছিল না।
হক সাহেব লক্ষ্য করলেন তার কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু মেয়েদের সাথে কথা না বলে তো তিনি থাকতে পারবেন না।
‘মাইও কাঁদে না। আমার কিছু হয় নাই। চিন্তা কইরো না মা।’
‘আব্বা আপনাকে বারবার বললাম সাবধানে থাকতে।’
‘মা আমার শরীর এখন অনেক ভালো। চিন্তা কইরো না।’
মেয়ে ফোন কেটে দিলো। তারপর সাথে সাথেই ভিডিও কল দিলো। হক সাহেব একটু ইতস্তত করে ফোনটা ধরলেন। আহারে আমার মেয়েটা। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলায় ফেলেছে।
‘আব্বা আপনার নাকে অক্সিজেনের নল দেয়া। আব্বা, আব্বা..।’ মেজো মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলল। কোনো কথাই বলতে পারছে না। হক সাহেব ফোন কেটে দিলেন। এই মেয়েটারে তিনি অন্যরকম পছন্দ করেন। খুব দায়িত্ববান আর খুব আবেগি আর আদুরে। মেয়েটা আবার ফোন দিচ্ছে। হক সাহেব ফোন রিসিভ করলেন।
‘আব্বা অক্সিজেন নেয়ার পর ভালো লাগছে এখন আপনার?’
‘হ মা। এখন শরীলডা ভালোই। তুমি চিন্তা কইরো না।’ মেজো মেয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে।
‘আপনার জামাই এই হাসপাতালের ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। সুস্থ হওয়ার সাথে সাথে আপনে দেশে রওনা দিবেন। সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ বন্ধ হতে অনেক সময় লাগবে।’
‘মা আমি একদিনও দেরি করব না। সুস্থ হওয়ার সাথে সাথে দেশে চলে যাবো।’
মেজো মেয়ে ফোন রেখে দেওয়ার পর হক সাহেব লক্ষ্য করলেন তার শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। দেশের জন্য, বাড়ির জন্য হঠাৎ করে তার মনটা আনচান করে উঠল। অশরীরি এক আতংক সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। ঠিক এক বছর আগে তিনি দেশ থেকে এসেছেন। প্রবাসজীবনের এই এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। বিদেশ থাকলে সারাদিন শুধু দেশের কথা মনে হয়। আবার দেশে ফিরে গেলে সপ্তাহ দু’এক যাওয়ার সাথে সাথে আবার বিদেশবিভুঁইয়ের জন্য মন পুড়তে থাকে। ত্রিশ বছর সৌদি আরব থাকার পর নবীর এই পবিত্র দেশের জন্য মনের ভেতর কী একটা যেন শুধু ছোটাছুটি করে।
সর্ব শেষ এক বছর আগে দেশে ফিরে যাওয়ার পর হক সাহেবের অভিজ্ঞতা খুব ভালো ছিলো না। ছেলেমেয়েরা বাড়ি, জায়গা-জমি নিয়ে খুব যন্ত্রণা দিলো। আত্মীয়স্বজনরা বিরক্ত করল। হক সাহেবের বারবার ইচ্ছে করছিল তিনি এবার যদি সৌদি ফিরে যান তাহলে আর দেশে আসবেন না। সারাটা জীবন যেই বাচ্চা-কাচ্চার জন্য বিদেশে কাটালেন, তারাই যখন সম্পত্তি নিয়ে এরকম করে তখন আর দেশে ফিরে কী হবে। তার চেয়ে নবীর পবিত্র ভূমিতে মারা গেলেই ভালো হয়। দেশ থেকে বিদায় নেয়ার সময় তার ছোট মেয়ে বলল, ‘আব্বা আপনি এমনভাবে বিদায় নিচ্ছেন যে, মনে হয় আর কোনো দিন ফিরে আসবেন না আমাদের কাছে। আপনাকে এত তাড়াতাড়ি মরতে দিচ্ছি না আব্বা। আমার বিয়াশাদি, বাচ্চা-কাচ্চা না দেইখা আপনে মরতে পারবেন না।’
হক সাহেবের এখন শুধু ছোট মেয়েটার কথা মনে পড়ছে। হক সাহেব ভিডিও কল দিলেন বাড়িতে। বড় মেয়ে ফোন ধরেছে।
‘আব্বা, আব্বা। আপনের কী হইছে। দুইদিন ধরে আপনার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। জসিম আংকেলরে ফোন দিলাম। আংকেল বলল আপনে হাসপাতালে।’
‘তেমন কিছু হয় নাই মা। একটু জ্বর আর ঠান্ডা।’
‘আংকেল বলল, আপনার করোনা হয়েছে। আব্বা এরকম হলো কেন। আপনার কিছু হলে আমরা কী নিয়ে থাকব।’
বড় মেয়েটা কাঁদতে শুরু করেছে। হক সাহেবের বুকের ওপর কিছু একটা যেনো চেপে বসেছে। শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কতদূরে মেয়েগুলো এখন। আদরের এই মেয়েগুলোরে রেখে তিনি কীভাবে এতদিন এই বিদেশবিভুঁইয়ে পড়ে থাকলেন। হক সাহেব শ্বাসকষ্টের জন্য কথা বলতে পারছিলেন না। সেজো মেয়েটা ফোনের স্কিনে আসল। বাবার নাকে অক্সিজেনের নল দেখে সেও কাঁদতে শুরু করল।
‘আব্বা আপনের কিছু হয় নাই। আপনে ভালো হয়ে যাবেন আব্বা। ভালো হইতেই হইবো।’
হক সাহেব কষ্ট করে মৃদু হেসে মাথা দোলান। সেজো মেয়ে আবার বলে, ‘আব্বা আল্লাহ এত বছর পর আমার মুখের দিকে চাইছে। আপনে নানা হইবেন আব্বা। আমার বাচ্চা-কাচ্চারে না দেখে আপনে মরতে পারবেন না।’
মেয়ের কথা শুনে হক সাহেবের চোখে পানি চলে আসে। মেয়েটার বিয়ে হওয়ার পর দীর্ঘদিন কোনো সন্তান হয় নাই। মেয়েটা সন্তান হারা থাকবে এই কষ্ট হক সাহেব কিছুতেই নিতে পারছিলেন না। কাবা শরিফের গিলাফ ধরে অনেক কান্নাকাটি করেছেন হক সাহেব মেয়ের সন্তানের জন্য। আল্লাহ তোমার কাছে লাখো শুকরিয়া। হক সাহেব চোখের পানিতে গাল ভিজিয়ে অনেক কষ্টে বললেন আলহামদুলিল্লাহ। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে। ছোট মেয়েটা ফোনের স্কিনে আসে। হক সাহেব আকুল হয়ে মেয়েকে দেখার চেষ্টা করতে থাকেন। কিছুতেই মেয়েটার মুখ তিনি দেখতে পারেন না। কী এক তীব্র কুয়াশার সাদা চাদর হক সাহেবকে চারপাশ দিয়ে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
আজ পবিত্র শুক্রবার। মদিনার মসজিদে মসজিদে জুমার আজান শোনা যাচ্ছে। মুয়াজ্জিন খুব দরদ দিয়ে আজান দিচ্ছেন। যেনো আজানের পবিত্র শব্দ দিয়ে মুয়াজ্জিন সাহেব সমস্ত অশুভ ভাসিয়ে দিতে চান।
বিষয় : গল্প রাফিক হারিরি
মন্তব্য করুন