প্রিয় কবির যে কোনো একটি বিখ্যাত কবিতা বেছে নিতে পারতাম। কবি আল মাহমুদের এমন কবিতাও অসংখ্য। কিন্তু আমি তো সেই কিশোর বয়স থেকে মার্চের গুমোট বাতাসে হাই তোলা অনুপস্থিতির প্রেমে পড়ে আছি। কেমন সে অনুপস্থিতি? বাতাসে তিরতির করে কাঁপা মার্চ মাসের রোদ। হয়তো ধুলো উড়ছিল তখন শহরের ছুটির দিনে ঝড়ের আশঙ্কা নিয়ে। কেউ কোথাও হারিয়ে গেছে সেই কবেকার অশান্ত এক দিনের প্রান্তে।
কবিতাটা প্রথম পড়ি যখন স্কুলের শেষ ধাপের ছাত্র। বাড়িতে 'সোনালী কাবিন' বইটা ছিল। একদিন পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ 'আমার অনুপস্থিতি' কবিতাতে আটকে গেলাম। ওই গ্রন্থে সোনালী কাবিনের সনেটগুচ্ছও উপস্থিত। কিন্তু আমি কেন যেন আল মাহমুদের এই প্রেমের কবিতাটিতে আটকে গিয়েছিলাম সেদিন। সেই আটকে যাওয়ার অনুভূতিটা আজও আছে। কেন জানি না, বিখ্যাত সব কবিতার ঝড়ের মুখে এই কবিতাটিও আমি ধরে রেখেছি আমার একান্ত ভালো লাগার খাতায়। কোথায় যেন শূন্যতার অনুভূতি আছে কবিতাটিতে। আছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে বিস্ম্ফোরক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কুশলী ছবিও।
তোমার খোঁপার ফুল ঝরে যায় পিঠে- আল মাহমুদ ছবি এঁকেছেন না বলে ছবি তুলেছেন ক্যামেরায় বললে ভুল হবে না। আমি বহুদিন চোখ বন্ধ করে দেখেছি এমন পিঠ যেখানে ফুল ঝরে পড়ছে খোঁপা থেকে। ফুলের সুবাসে পাগল হয়ে কোনো এক বিকেল। কিন্তু তারপরেই আল মাহমুদ তৈরি করেছেন শূন্যতা আর ছেড়ে যাওয়ার আবহ। কে কাকে ছেড়ে যাচ্ছে? দুপুর ফুরিয়ে বিকেল একদিন। সেটাও রোববার, ছুটির দিন। কেমন এক নির্ভার সময়ের একটা পূর্ণ ছবি একটু একটু করে তৈরি হতে শুরু করে আমার দৃষ্টিসম্মুখে।
এরপর বহুবার পাঠ করেছি এই কবিতা। সেই ছবিগুলো নতুনভাবে দেখা দিয়েছে। ছুটির দিনের বিকেলে অভিমান দিয়ে মোড়া দু'জন মানুষের ছবি একটি-দুটি লাইনে চকিতে অথচ গভীরভাবে তুলে এনেছেন।
'আমি ভালোবাসি নদী, তাই হাসতে হাসতে সেও
হয়ে যেত নদী।'
কী সহজ অথচ গভীর ব্যবহার! একজন নারীর ভালোবাসা আর লাস্যকে আমি দেখতে পাই কবিতার এই একটি চরণেই। কিন্তু কবি যখন কবিতার অন্তিমে এসে উচ্চারণ করেন-
'আজ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারীদের মতো পরেছি পোশাক
আমার অনুপস্থিতি হাই তোলে মার্চের গুমোট বাতাসে'
তখন রাজনীতি, দেশকাল আর ভালোবাসার মানুষের কাছে অনুপস্থিত হয়ে যাওয়ার ছবিটা ঝট করে মনে বিষাদ তুলে আনে। মনে হয়, আর যদি দেখা না হয় তাদের দু'জনের?