
জীবনবোধের গভীরতা সৃষ্টিশীল মানুষকে বেদনার ঘোলাজলে সাঁতরে বেড়াতে বাধ্য করে। আবার জীবনের প্রতি তীব্র পিয়াস মাঝে মাঝে তাকে ঘোরতর সংকটেও ফেলে। এই সংকটের অপর নাম অতল শূন্যতা। তখন চারিদিকে শুধু হাহাকারের তীব্র শিস বাজে। মনোবেদনার ধূসর আঙিনায় কেবলই ঝরা শিউলির দল পড়ে থাকে। বাতাসের কানাকানিতেও পূর্ণ থাকে অনিঃশেষ ক্রন্দনের সুগভীর আহাজারি।
তবে জীবনের স্তরগুলো পাড়ি দিতে দিতে অভিজ্ঞতার মহাময়দান যখন ছাপিয়ে যায় নানা ঘাতপ্রতিঘাতে, তখন শূন্যতার ভারও কমে যেতে থাকে ক্রমাগত। বরং জীবনের বাস্তবতা মেনে নিতে মনও যেন অনেকটাই প্রস্তুত হয়ে ওঠে। তখন স্বপ্নপিয়াসী রোমান্টিক হৃদয়েও বাজে জীবন বাস্তবতার সকরুণ দ্রিমি।
এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের প্রিয় কবি রফিক আজাদের কাব্য যাত্রাতেও এ ধরনের এক সরলতম নির্দেশনাই যেন কাজ করে গেছে।
মাধবী এসেই বলে : 'যাই' কবিতাটি কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'অসম্ভবের পায়ে'র একটি কবিতা। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। তখন দেশ সদ্য স্বাধীন। স্বাধীনতা পেতে আমাদের ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক। এ কারণে স্বাধীনতা লাভের আনন্দের পাশাপাশি এতে সৃষ্টিমুখী হৃদয়ে যে অন্যতর রিক্ততার ঢেউও জন্ম নেবে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই আপাদমস্তক কবি রফিক আজাদ তাঁর প্রথম দিককার কবিতায় বোহেমিয়ানিজম, অস্থিরতা, প্রেম, রিরংসা, শূন্যতা আর বেদনার ধূপকাঠি জ্বালিয়েছেন সহজাত ভঙ্গিমায়। এ কবিতাটিও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়।
শূন্যতার নির্জনতায় বন্দি কবি অধীর আগ্রহে উন্মুখ হয়ে বসে আছেন হৃদয় পূর্ণ করবেন বলে। হয়তো প্রিয় কোনো নারীর জন্য। অথবা অন্যকিছু কিংবা এই নারীই কি কবিতার উল্টো কোনো পিঠ? কবিতাই নারী, নাকি নারীই কবিতা হয়ে এখানে একাকার মিশে গেছে? যে যা-ই হোক, যাকে তিনি চাচ্ছেন তা যে কবির পরম আরাধ্য তা তো নিঃসন্দেহে বলা যায়।
রোমশ বালুকাবেলা খেলা করে রৌদ্রদগ্ধ তটে;
অস্তিত্বের দূরতম দ্বীপে এই দুঃসহ নির্জনে
কেবল তোমার জন্যে বসে আছি উন্মুখ আগ্রহে-
যার জন্যে এত উন্মুখতা সেই কাঙ্ক্ষিতকে কি তিনি পাচ্ছেন? কবির বয়ান বলে তিনি আসেন, তাকে কাছে পান। তবে সেই কাঙ্ক্ষিত সুন্দর স্থায়ী নয়। কারণ তিনি ক্ষণিকের। 'সুন্দর সাম্পানে চড়ে মাধবী এসেই বলে- যাই।' অনেক প্রতীক্ষার পর তিনি আসেন ঠিকই। আবার পরক্ষণে চলেও যান। তার অবস্থান স্বল্প সময়ের। অতৃপ্ত কবি আত্মা তা মেনে নিতে পারেন না। যেমনটা কবি জীবনানন্দ দাশ বেশ নির্মোহ ভঙ্গিতে চলে যাওয়ার বিষয়টি মেনে নিয়ে বলেছেন, 'যেতে হবে বলে তুমি গেছ চলে/ সবাই চলিয়া যায়/ সকলের যেতে হয় বলে'
এই যাওয়াই তো স্বাভাবিক। আসলে কেউ কি যেতে চায়? যেতে হয়, তাই যায়। কিন্তু এতে মনে যে খেদ, যে হাহাকার তৈরি হয় তা কি সকলের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একটি গানে বলেছেন, 'মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এল ফাগুন-দিনের স্রোতে-/এসে হেসেই বলে, যা-ই যা-ই যা-ই।'
গানটিতে এক ধরনের রোমান্টিক দোলা রয়েছে। কিন্তু রফিক আজাদের কবিতায় রয়েছে কবির অনন্ত শূন্যতার সীমাহীন বাস্তবতা। তিনি অধরাকে ধরার আপ্রাণ চেষ্টায় রত। সেই অধরা যে লোকশ্রুত পুরাতন অবাস্তব পাখি, যে ডানা ঝাপটালে ঝরে পড়ে আনন্দ, টাকার থলি, ভীষণ সৌরভ!
এ সৌরভে ডুবে যাওয়ার নেশায় আচ্ছন্ন কবি-মনে বাজে ক্রমাগত ক্রন্দনের ধ্বনি।
এ ক্রন্দন সুন্দরকে কাছে পাওয়ার আর্তি। অবচেতনের অবতলে থাকা হাহাকারকে দুমড়েমুচড়ে দূরে ছুড়ে ফেলার এক অনন্য মনোজাত ভঙ্গি।
তবে জীবনের স্তরগুলো পাড়ি দিতে দিতে অভিজ্ঞতার মহাময়দান যখন ছাপিয়ে যায় নানা ঘাতপ্রতিঘাতে, তখন শূন্যতার ভারও কমে যেতে থাকে ক্রমাগত। বরং জীবনের বাস্তবতা মেনে নিতে মনও যেন অনেকটাই প্রস্তুত হয়ে ওঠে। তখন স্বপ্নপিয়াসী রোমান্টিক হৃদয়েও বাজে জীবন বাস্তবতার সকরুণ দ্রিমি।
এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের প্রিয় কবি রফিক আজাদের কাব্য যাত্রাতেও এ ধরনের এক সরলতম নির্দেশনাই যেন কাজ করে গেছে।
মাধবী এসেই বলে : 'যাই' কবিতাটি কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'অসম্ভবের পায়ে'র একটি কবিতা। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। তখন দেশ সদ্য স্বাধীন। স্বাধীনতা পেতে আমাদের ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক। এ কারণে স্বাধীনতা লাভের আনন্দের পাশাপাশি এতে সৃষ্টিমুখী হৃদয়ে যে অন্যতর রিক্ততার ঢেউও জন্ম নেবে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই আপাদমস্তক কবি রফিক আজাদ তাঁর প্রথম দিককার কবিতায় বোহেমিয়ানিজম, অস্থিরতা, প্রেম, রিরংসা, শূন্যতা আর বেদনার ধূপকাঠি জ্বালিয়েছেন সহজাত ভঙ্গিমায়। এ কবিতাটিও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়।
শূন্যতার নির্জনতায় বন্দি কবি অধীর আগ্রহে উন্মুখ হয়ে বসে আছেন হৃদয় পূর্ণ করবেন বলে। হয়তো প্রিয় কোনো নারীর জন্য। অথবা অন্যকিছু কিংবা এই নারীই কি কবিতার উল্টো কোনো পিঠ? কবিতাই নারী, নাকি নারীই কবিতা হয়ে এখানে একাকার মিশে গেছে? যে যা-ই হোক, যাকে তিনি চাচ্ছেন তা যে কবির পরম আরাধ্য তা তো নিঃসন্দেহে বলা যায়।
রোমশ বালুকাবেলা খেলা করে রৌদ্রদগ্ধ তটে;
অস্তিত্বের দূরতম দ্বীপে এই দুঃসহ নির্জনে
কেবল তোমার জন্যে বসে আছি উন্মুখ আগ্রহে-
যার জন্যে এত উন্মুখতা সেই কাঙ্ক্ষিতকে কি তিনি পাচ্ছেন? কবির বয়ান বলে তিনি আসেন, তাকে কাছে পান। তবে সেই কাঙ্ক্ষিত সুন্দর স্থায়ী নয়। কারণ তিনি ক্ষণিকের। 'সুন্দর সাম্পানে চড়ে মাধবী এসেই বলে- যাই।' অনেক প্রতীক্ষার পর তিনি আসেন ঠিকই। আবার পরক্ষণে চলেও যান। তার অবস্থান স্বল্প সময়ের। অতৃপ্ত কবি আত্মা তা মেনে নিতে পারেন না। যেমনটা কবি জীবনানন্দ দাশ বেশ নির্মোহ ভঙ্গিতে চলে যাওয়ার বিষয়টি মেনে নিয়ে বলেছেন, 'যেতে হবে বলে তুমি গেছ চলে/ সবাই চলিয়া যায়/ সকলের যেতে হয় বলে'
এই যাওয়াই তো স্বাভাবিক। আসলে কেউ কি যেতে চায়? যেতে হয়, তাই যায়। কিন্তু এতে মনে যে খেদ, যে হাহাকার তৈরি হয় তা কি সকলের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একটি গানে বলেছেন, 'মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এল ফাগুন-দিনের স্রোতে-/এসে হেসেই বলে, যা-ই যা-ই যা-ই।'
গানটিতে এক ধরনের রোমান্টিক দোলা রয়েছে। কিন্তু রফিক আজাদের কবিতায় রয়েছে কবির অনন্ত শূন্যতার সীমাহীন বাস্তবতা। তিনি অধরাকে ধরার আপ্রাণ চেষ্টায় রত। সেই অধরা যে লোকশ্রুত পুরাতন অবাস্তব পাখি, যে ডানা ঝাপটালে ঝরে পড়ে আনন্দ, টাকার থলি, ভীষণ সৌরভ!
এ সৌরভে ডুবে যাওয়ার নেশায় আচ্ছন্ন কবি-মনে বাজে ক্রমাগত ক্রন্দনের ধ্বনি।
এ ক্রন্দন সুন্দরকে কাছে পাওয়ার আর্তি। অবচেতনের অবতলে থাকা হাহাকারকে দুমড়েমুচড়ে দূরে ছুড়ে ফেলার এক অনন্য মনোজাত ভঙ্গি।
বিষয় : জুনান নাশিত
মন্তব্য করুন