ঠাকুরগাঁও পিটিআই স্কুলে প্রথম ভর্তি হই। তখনই আমার ভেতরে শিল্পীসত্তা প্রকাশ পায়। এতে পিটিআই স্কুলের একটা ভূমিকা রয়েছে। টিচার্স ট্রেনিং স্কুলের টিচাররা প্রাইমারিতে এসে ট্রেনিং দিত। স্কুলে যেহেতু শিক্ষকতা করবে, যেজন্য শিক্ষকদের সব বিষয়ে ট্রেনিং দেওয়া হতো। সে সময় তো আর প্রাইমারি স্কুলে বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা টিচাররা যেত না। ওই ট্রেনিং থেকে যতটুকু জ্ঞান আহরণ করত, তার ভিত্তিতে সৃজনশীল ক্লাসগুলো নিত। খেলাধুলা না করে সে সময় বিভিন্ন আঁকাআঁকির দিকে নজর দিতাম। স্কুলে অন্যদের সঙ্গে মাটি দিয়ে পুতুল, ঘর এসব বানাতাম। তখন দেখতাম যে, স্যারদের থেকে আমারগুলো ভালো হচ্ছে। সে সময় মাত্র দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। এটি আমার পরিবার থেকে এসেছে। শিল্প ভুবনে আসার পেছনে বাবার একটা বড় অবদান রয়েছে। যদিও তিনি প্রথমে চাননি যে আমি এ পথে আসি। আমার বাবা প্রথম জীবনে শিক্ষকতা করেছেন। এর পর পাকিস্তান হলো। তখন সেনাবাহিনী গঠনের আগে পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ড গঠিত হয়। সেখানে তিনি লেফটেন্যান্ট পদে যোগ দেন। সেখানে তিন বছর চাকরি করেন। এরপর প্রমোশন হয়। চাকরি করতে গিয়ে আব্বা শৃঙ্খলাবোধ খুব ভালোভাবে রপ্ত করেন। আব্বার চাকরিতে শিল্পকলার চর্চাগুলো অন্যভাবে হতো।
আব্বার বয়স যখন ৪১-৪২, তিনি আবার স্কুলে ফিরে আসেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর যে ট্রেনিং, সেটি তিনি ভুলতে পারেননি। ঠাকুরগাঁও স্কুলে স্কাউটের প্রথা আব্বাই চালু করেন। দিনাজপুর বিভাগে আব্বাই প্রথম স্কাউট ট্রেনিং নিয়ে আসেন। স্কাউটিংয়ের ভেতর শিল্প-সংস্কৃতির অনেক কিছু পাওয়া যায়। ছোট ছোট নাটিকা হয়, গান হয়। আব্বার ভেতরে সেটি ছিল, যেটি তিনি রপ্ত করেছিলেন। আমার রক্তের ভেতরেই সেটি ছিল।
শিল্পচর্চা, শিল্পসংস্কৃতির প্রতি আমার যে আকর্ষণ এগুলো পরিবার থেকে আসা। আমার মা আমাদের ওখানে (ঠাকুরগাঁওয়ে) মেলায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি ট্যাপেস্ট্রির আদলে একটি জায়নামাজ বানিয়েছিলেন। তিনি আবার সেটি শিখেছিলেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে। এগুলো বংশপরম্পরায় চলে আসে। তারপর স্কাউটিংয়ে আমাদের যে ব্যাজ, সেগুলোতে সেলাই করে নাম লেখা, মাছের আঁশ দিয়ে ফুল বানানো- এগুলো সব সময় বাড়িতে দেখতাম। শিল্পী যে হবো, এটি ভেতরে কখনও ছিল না। তবে অনুপ্রেরণাগুলো আস্তে আস্তে আমার ভেতর দানা বাঁধছিল। তা অস্বীকার করার কিছু নেই। স্কুলে ফার্স্ট বেঞ্চে কখনও বসিনি। কারণ খাতার মধ্যে ছবি-টবি আঁকতাম।
এর পর আস্তে আস্তে বড় হওয়া। তখন ঠাকুরগাঁওয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রচলন ছিল খুব। বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি হতো। আমাদের ওখানে সে সময় বিহারিরা ছিল, ওরা ঘুড়িগুলো বানাত। আমাদের বাসার পাশেই ওরা ছিল। তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণিতে থাকাকালীন সময়ে ওদের দেখে দেখে আমিও ঘুড়ি বানাতাম। বন্ধুদের উপহার দিতাম। ওদের থেকে ভালো ডিজাইনের ঘুড়ি বানাতাম। যখন ক্লাস ফোরে পড়ি, তখন পিটিআই স্কুলের ট্রেনিংরত শিক্ষকদের অঙ্কন করে দিতাম, বিনিময়ে কিছু অর্থ যোগ হতো। গ্রামের বাড়িতে পুকুরপাড়ে মাটি দিয়ে ঘর বানানো, বিভিন্ন জীবজন্তু ও ফলমূলের অবয়ব তৈরি করে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে দেওয়া ছিল এক ধরনের অর্থ ছাড়া ফরমায়েশি কাজ।
আব্বা স্কুলে চাকরি করতেন। আমাদের বেশ কিছু দোকান ছিল। এক দোকানে সাইনেবোর্ড আঁকা হতো। ওগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম, ওরা কীভাবে আঁকে। মনে মনে ভাবতাম, আমি যদি এ রকম পেইন্টার হতে পারতাম। ওখানকার পেইন্টারকে নানান প্রশ্ন করতাম, উত্তরও পেতাম।
আমি ভেবেছিলাম মেডিকেলে ভর্তি হব। আব্বা আমার জন্য একটা চেম্বারও করে রেখেছিলেন। তখনকার বাবা-মায়েরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া অন্য কোনো পেশাগত পড়াশোনার কথা কল্পনাও করতে পারতেন না। অবশ্য সে সাধ আমার পূরণ হয়েছিল ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পর- আমাদেরই আরেকটি দোকানে 'মডার্ন আর্ট গ্যালারি' নামে একটি সাইনবোর্ডের দোকান দিয়ে রং নিয়ে রংবাজি করার। সে সময় ফিগার সংবলিত যাত্রাপালার ব্যানার, মুক্তিযুদ্ধের নাটকের ব্যানার ছাড়াও সিনেমার স্লাইড অঙ্কন, রবীন্দ্র-নজরুলের পোর্ট্রেট কত যে করেছি। তবে সবই করতাম গ্রাফ করে।
বিচিত্র ধরনের সাইনবোর্ড আঁকাআঁকির এক পর্যায়ে ঢাকা আর্ট কলেজে অধ্যয়নরত ঠাকুরগাঁওয়ের শিল্পী সাইফুর রহমান (আমার দুই বছরের সিনিয়র) একদিন বললেন-
'তুমি ভালো আঁকাআঁকি করো, তুমি আর্ট কলেজে ভর্তি হও।'
আর্ট কলেজ যে আছে তাও জানতাম না। তখন মাথার ভেতরে এটুকু কাজ করল যে, মেডিকেলে পড়লে তো দিনাজপুরে গিয়ে পড়তে হবে। ঢাকা-দিনাজপুর, ঢাকা-দিনাজপুর এটি নিয়ে মাথার ভেতরে ঘুরপাক খেতে লাগল।
রেজাল্ট ভালো করলাম। ম্যাট্রিকে দুটি লেটার মার্কসসহ ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিলাম। এর পর দিনাজপুর কলেজে ভর্তির কথা বলে ঢাকায় চলে এলাম। গন্তব্য আর্ট কলেজের শহিদ শাহনেওয়াজ ছাত্রাবাস। উদ্দেশ্য আর্ট কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ। ছাত্রাবাসের ২নং রুমের রংপুরের জি এম রাজ্জাকের গেস্ট হিসেবে (ফ্লোরিং করার অনুমতি মেলে হোস্টেল সুপারের অগোচরে)।
মাসাধিককাল অপেক্ষার পর এলো সে মাহেন্দ্রক্ষণ- ভর্তি পরীক্ষা। মেধাতালিকার তিন নম্বরে আমার নাম। কিন্তু আব্বাকে তো বলিনি। নোটিশ বোর্ডের কাগজ ছিঁড়ে আব্বাকে পাঠালাম, আব্বা দেখলেন। দেখার পর তো আব্বা পাগলের মতো হয়ে গেলেন! কিছুদিন আব্বা টাকাপয়সা দিতেন না। বুঝতে পেরে আবার দেওয়া শুরু করেন। প্রথম বর্ষে আমার ছবি প্রদর্শনীতে দামে ওঠে। আব্বা সেটি আমাকে না জানিয়ে দাম করেন। এরপর দ্বিতীয় বর্ষের সময় জানতে পাই, আব্বা চিটাগং থেকে চিত্রশিল্পের ওপর শর্ট কোর্স করছিলেন। আব্বা তো ড্রয়িং টিচারও ছিলেন। বাংলা টিচার ছিলেন, আরবিতেও অসাধারণ দক্ষতা ছিল। আবার ইতিহাসেও ছিলেন সমান পারদর্শী। আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আব্বা আমাকে বললেন-
'তুমি যখন ভর্তি হয়েছই, ভালো কিছু করার চেষ্টা করো। তুমি আর্টেই শাইন করো।'
আমিও সেটাই করার চেষ্টা করেছি। আব্বা বলতেন শিক্ষকদের বাড়ি গিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে, তাঁদের উপদেশ নিতে। আমি এ কাজটি দেশেই শুধু নয়, জাপানে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার সময়ও করেছি।
সে সময় দুই বছরের (ফাউন্ডেশন কোর্স) অর্থাৎ প্রি-ডিগ্রি পাস করার পর সাতটি বিভাগের যে কোনো একটিতে তিন বছর মেয়াদি বিএফএ ডিগ্রি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদান করা হতো। প্রি-ডিগ্রিতে শিক্ষক হিসেবে আনোয়ারুল হক স্যার, মাহবুবুল আমীন স্যার, শহিদ কবির স্যার, কাজী গিয়াসউদ্দিন স্যার ক্লাস নিতেন। মাহবুবুল আমীন স্যার কিন্তু সে সময় থেকে আমার কাজে বিরাট অনুপ্রেরণার জায়গা হয়ে আছেন। তিনি মারা গেছেন। তিনি শিক্ষকের দায়িত্বের পাশাপাশি, অভিভাবকের দায়িত্বও পালন করতেন- আমরা কী করতাম, না করতাম। আমরা যে রুমে থাকতাম সে রুমের নিচে তিনি থাকতেন। মাহবুব স্যার প্রতিদিন ১০টার আগেই ক্লাসে এসে বসে থাকতেন। কেউ ১০টার পর এলে এবং প্রতিদিন স্কেচ খাতা জমা না দিলে ক্লাসে ঢুকতে দিতেন না। প্রতিদিন ক্লাসের কাজের ফাঁকে প্রত্যেককে আলাদাভাবে ডেকে স্কেচ খাতায় ভুল সংশোধন করে দিতেন। আমরা প্রতি রাতে দলবেঁধে কমলাপুর স্টেশন, কখনওবা সদরঘাট, নিউমার্কেটের কাঁচাবাজারে যেতাম ড্রইং করার জন্য। দুটি সেকশন থাকায় আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো- কে কত ভালো কাজ স্যারকে দেখাতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ড্রইংয়ের হাতেখড়ি মাহবুব স্যারের হাত ধরেই। আজও ড্রইংক্লাসে ক্লাস নেওয়ার সময় স্যারের কথা অনেক মনে পড়ে। তবে এখনকার ছাত্রছাত্রীরা ড্রইংয়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত অমনোযোগী- এ কথা নির্দি্বধায় বলা যায়।
ফিগার ড্রয়িংয়ে আমি খুব পাকা ছিলাম। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আঁকতাম। তৃতীয় বর্ষে উঠলাম। তখন পলিটিক্যালি জড়িয়ে গেলাম ছাত্রলীগে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের সব ডেকোরেশনের কাজ আমি করতাম। ঢাকায় হেন স্কুল-কলেজ নেই, যেখানে আমি যাইনি। ঢাকার বাইরেও গিয়েছি। প্রতিদিনই অনেক কাজ থাকত। এটি ৭৩-৭৪ সালের কথা। পোস্টার লেখা, চিকা মারা (দেয়াল লিখন), বিভিন্ন অনুষ্ঠানের স্টেজ ডেকোরেশন, গেট তৈরি- এসব করতে থাকি। এ ছাড়া অনেক কমার্শিয়াল কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি। এবং সে সময় প্রচুর অর্থ আহরণের পথ প্রসারিত হয়। সে সময় রেসকোর্স ময়দানে একটা মেলা হতো। আমি মেলায় রেস্টুরেন্টের ডেকোরেশন করেছিলাম। সে পুরস্কারও আমি পেয়েছিলাম। কোনো কাজ করে জীবনে কাজে লাগেনি, এমন নয়। জীবনের প্রতিটি কাজই শিল্পচর্চার প্রতি আকৃষ্ট এবং অনুপ্রাণিত করেছে। আমার যখনই সময় হতো, বিশেষ করে ছুটির দিনে অনেক কাজ করতাম; যা পেইন্টার হওয়ার পেছনে বড় অবদান রেখেছে।
প্রি-ডিগ্রিতে ভালো রেজাল্ট করা সত্ত্বেও ঘটনাচক্রে তৎকালীন কমার্শিয়াল বিভাগে বিএফএ ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হই। অথচ আমার আগ্রহ ছিল পেইন্টিংয়ে। বন্ধের দিনগুলোতে আউটডোরে ল্যান্ডস্কেপ করতাম, এভাবে একই সঙ্গে কমার্শিয়ালের এবং ড্রইং পেইন্টিংয়ের যাবতীয় বিষয়ের ওপর পারদর্শিতার স্বীকৃতিস্বরূপ বার্ষিক প্রদর্শনীতে তৃতীয় বর্ষে কমার্শিয়ালের মিডিয়া বেস্ট, চতুর্থ বর্ষে পেইন্টিং মিডিয়া বেস্ট এবং পঞ্চম বর্ষে পেইন্টিং করে জয়নুল আবেদিন শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করি। পেইন্টিং করার পেছনে অধ্যাপক শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, অধ্যাপক শিল্পী সমরজিৎ রায়ের অবদান অনস্বীকার্য। সে সময় হোস্টেল সুপারের দায়িত্ব পালন করছিলেন আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী। ছাত্রাবাসে আমার রুম নং ১৩-এর পাশেই সমরজিৎ স্যারের আবাসস্থল ছিল। কাইয়ুম স্যার প্রায়ই সমরজিৎ স্যারের বাসায় আসতেন। সে সুবাদে আমি আমার আঁকা পেইন্টিং স্যারদের দেখাতাম এবং তাঁরা আমাকে পরামর্শ দিতেন। আমি সব শিক্ষকের বাসায় যেতাম। স্যারদের বাসায় গিয়ে কাজ দেখাতাম। সাজেশন নিতাম। স্যাররা আমাকে মনে রাখতেন। যত্ন করে দেখতেন। মতামত দিতেন। স্যারদের সঙ্গে যোগাযোগও কিন্তু অনুপ্রেরণা।
১৯৭৯ সালে বিএফএ ডিগ্রির রেজাল্ট হওয়ার পর একদিনও হোস্টেলে ছিলাম না। তখনকার দিনে ছাত্ররা অনেকেই পাস করার পরও চাকরি কিংবা বিয়েশাদি না করা পর্যন্ত হোস্টেলে অবস্থান করত। আমার বেলায় সেটি ঘটেনি। আমি মোস্তাফিজ, মতি ও স্বপন জিগাতলায় একটি বাসায় নতুন জীবন শুরু করি এবং একই বছর সাজু আর্ট গ্যালারিতে প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী করি।
১৯৮০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সিনিক পেইন্টার হিসেবে যুক্ত হই। টেলিভিশনে জয়েন করার আগে সাজু আর্ট গ্যালারিতে প্রথম ছবি প্রদর্শন করি। সেখানে আমার পেইন্টিং সর্বাধিক মূল্যে বিক্রি হয়। আমার ছবি ৮০ হাজার টাকার বিক্রি হয়। কোনো শিক্ষকের ছবিও এত টাকায় বিক্রি হয়নি। আবার চারুকলাতে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে তিনটা ছবি বিক্রি করেছি। তখন চিত্রকর্ম বিক্রি করার একমাত্র জায়গা ছিল চারুকলা। ওখানে অনেক বিদেশির সঙ্গে পরিচয়, একজন বিদেশি আমার কাজের খুব প্রশংসা করতেন। সম্পর্ক ভালো হয়। এখন পর্যন্ত যোগাযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি আমার জন্য দু'বার ভিসার ব্যবস্থা করেছেন। তখন আমেরিকান দূতাবাসের সঙ্গে একটা ভালো যোগাযোগ ছিল, দূতাবাস ছিল মতিঝিলে। অবাধ যাতায়াত ছিল, আমাকে সবাই চিনত। মার্কিন বন্ধু লারসনের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। লারসনের দ্বারা আমি খুবই অনুপ্রাণিত ছিলাম। লারসন তখন দূতাবাসে কাজ করত।
এমএফএ ভর্তি হলেও তা শেষ করা হয়নি। টেলিভিশনে চাকরি করি চার বছর। চাকরি, পড়াশোনা, ছবি আঁকা, সংসারের দায়িত্ব- সবকিছু একসঙ্গে পালন করা কষ্টকর হয়ে উঠেছিল দিনে দিনে। এরই মধ্যে পত্রিকায় জাপান সরকারের একটি বৃত্তির (মনবুশো স্কলারশিপ) বিজ্ঞাপন দেখে সেখানে আবেদন করি। উচ্চশিক্ষার জন্য জাপানে যাই ১৯৮৪ সালের অক্টোবর মাসে।
এমএফএ প্রথম পর্বে শিল্পী অধ্যাপক কাইয়ুম চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে নিরীক্ষামূলক পোস্টারের আওতায় ঋতুর ওপর ভিত্তি করে আধা-বিমূর্ত ছয়টি পোস্টার ডিজাইন করি। সম্ভবত সেটিই ছিল আমার রিয়ালস্টিক থেকে সেমি-অ্যাবস্ট্রাক্ট পদার্পণের প্রথম সোপান। জাপানে যাওয়ার আগে এরই মধ্যে রিয়ালিস্টিক এবং সেমি-অ্যাবস্ট্রাক্ট-এর ওপর ভিত্তি করে লারসনের বাড়িতে আরও ছয়টি হাউস শো অনুষ্ঠিত হয়। হাউস শো থেকে কোনো ছবি ফেরত আসত না। প্রথমে জাপানের ওসাকায় অবস্থিত বিদেশি ভাষা শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় মাসের জাপানি ভাষা শিক্ষা পরীক্ষায় আমার সেকশনে প্রথম স্থান অধিকার করায় সরাসরি টোকিওর তামা আর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈলচিত্রের ওপর মাস্টার্স ডিগ্রিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ লাভ করি। যদিও নিয়ম অনুযায়ী ভাষা শিক্ষা সমাপ্ত করে আরও দেড় বছর রিসার্চ করতে হয়। জাপানের আধুনিক শিল্পকলার পাইওনারিং শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম অধ্যাপক মিয়াজাকি সুসুমির তত্ত্বাবধানে অধ্যয়ন শুরু করি। তাঁর কাছ থেকে প্রচুর অনুপ্রেরণা পেয়েছি। আমার কো-গাইডে ছিলেন আরেক স্বনামধন্য শিল্পী অধ্যাপক তোশিইউকি তানাকা।
প্রথম বর্ষের প্রথম দুই সেমিস্টার মোটেই সুখকর ছিল না। পেইন্টিংয়ের জগতে দুই বছরের মধ্যে নতুন একটি ভাষা তৈরি করা সত্যিই একটি অসাধ্য সাধন করা। কারণ রিয়ালিস্টিক কাজ থেকে বিমূর্ততায় আসাটা ছিল একরকমের কঠিন চ্যালেঞ্জ আমার জন্য। আমার গাইড মিয়াজাকি সুসুমি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-
'তুমি কেমন কাজ করতে চাও?'
তিনি এক্সপ্রেশনিজম নিয়ে কাজ করতে বললেন। আমি বললাম- রিয়েলিস্টিক কাজ অনেক করেছি। আমি যা দেখছি, তা-ই আঁকছি।
কিন্তু আমি তো এর ভেতরে ঢুকতে চাই। ভেতরের গল্পটা আঁকতে চাই। তিনি তখন আমাকে বিমূর্ত চিত্রকর্মে কাজ করার কথা বললেন। আমি রিয়েলিস্টিকে একটা মুহূর্তকে ধরতে পারি। ধরুন, আমি একটি গাছের ছবি আঁকব- এখানে একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে যা দেখছি রিয়েলিস্টিকে তা ফুটিয়ে তুলছি। কিন্তু সেই গাছটি কীভাবে বড় হলো- তার বেড়ে উঠার বিভিন্ন পর্যায়, সেই অনুভূতিগুলো উপলব্ধি করে ক্যানভাসে তুলে ধরা যায় অ্যাবস্ট্রাক্ট চিত্রে।
প্রতি সপ্তাহে শিক্ষকরা একসঙ্গে আসতেন। আমাদের কাজগুলো দেয়ালে লাগাতে হতো। এরপর তারা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে হতো। প্রথমেই নকল করলাম আমার কয়েকজন স্যারের কাজ। কিন্তু আমার কাজ দেখেই তাঁরা বললেন-
'এটা তো তোমার কাজ না, তুমি এটা কপি করেছ।'
এরপর নিজের মতো করে শুরু করলাম, কিন্তু হয় না। আমার শুধু মনে হতো, আমি যে এখানে আসছি, কী নিয়ে যাব বাংলাদেশে! প্রথম বর্ষটা আমার ভালো যায়নি। বছর শেষে আমি বি প্লাস পেয়েছিলাম। আমি তখন পাশের পাহাড়ে গিয়ে কাঁদতাম। এখানে এসেছি; কিন্তু কী নিয়ে যাব দেশে! আমার শিক্ষক মিয়াজাকি সুসুমি বলেছেন-
'এমন কিছু করো, যা নতুন, যা তোমার এবং যা অভিনব।'
মিয়াজাকি সুসুমি আমাকে বিভিন্নভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন।
এরপর নিজের মতো কিছু আঁকি। শিক্ষকরা দেখতে আসবেন। আমি ছবিটা তৈরি করছি। কেমন করে যেন তারপিনের বোতলটা ক্যানভাসের ওপর পড়ে গেল। এক অদ্ভুত টেক্সচার তৈরি হলো। তা দেখে তো আমার মাথা আরও গরম হয়ে গেল। শিক্ষকরা এলেন। তাঁরা দেখে বললেন-
'এটাই তো চাচ্ছি আমরা। এটা তোমার নিজস্ব কাজ। এটা করো না কেন?'
এরপর আমাকে আমার গাইড ৬ ফুট বাই ৪ ফুটের ক্যানভাসে এ কাজটা করতে বললেন। যেগুলো এর আগে ছোট ক্যানভাসে করতাম। এর পরের সপ্তাহে এসে আমার পিঠে হাত রেখে স্নেহ করে বললেন-
'এটাই চাচ্ছি আমরা।'
এরপর ওই ছবিটা আমার গাইড কোদো এক্সিবিশনে পাঠালেন। এটাই মোড় ঘোরার সময়। পুরস্কার পেলাম। তার পরের বছরও পুরস্কার পেলাম। বাংলাদেশে আমিই প্রথম রঙের ছিটেফোঁটা দিয়ে কাজ শুরু করি। যেহেতু আমার ছবি বিক্রি হয়, সেহেতু অন্যরাও রং ছিটিয়ে কাজ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু শুধু ছিটালে তো হবে না। তা অর্থপূর্ণও হতো হতে হবে।
দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রাবস্থায় কোদো আর্ট এক্সিবিশন থেকে সিন জিন পুরস্কার লাভ আমাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। পেইন্টিংয়ের পাশাপাশি ম্যাটেরিয়াল অ্যান্ড টেকনিকের ওপর ক্লাস করার সুবাদে ম্যাটেরিয়াল এবং টেকনিকে প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ হয়। ম্যাটেরিয়ালের ব্যবহারে জাপানি শিল্পীরা অনেক পরিপকস্ফ। সরাসরি না হলেও আদর্শগতভাবে আমি তাঁদের কাছ থেকেও অনুপ্রাণিত হয়েছি।
এরপর প্রতি বছরই যেতাম জাপানে, ১৩ বছর এভাবে কন্টিনিউ করছি। ওখানকার আর্টিস্টদের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ হয়, ওখানকার মেম্বার হয়ে যাই। এরপর ওখানকার জুরি বোর্ডের মেম্বার হয়ে যাই। সে বয়সে জুরি বোর্ডের মেম্বার হওয়া ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১৯৯৬ পর্যন্ত যাতায়াত ছিল। সেখানে বিভিন্ন মিউজিয়াম দেখার পাশাপাশি জাপানি এবং বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শনী দেখার সুযোগ হয়। বিশেষ করে এন্টনি তাপিস, এন্টনি ক্ল্যাব, মিরোর বড় বড় কাজের প্রদর্শনী থেকে আমি অনুপ্রাণিত হই। নবীন আর্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড পেলাম। তারপর জাতীয় শিল্পকলা বেস্ট অ্যাওয়ার্ড পেলাম। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে এক্সিবিশনে বেস্ট অ্যাওয়ার্ড পেলাম। জুরি আওয়ার্ড পেলাম, ইরান থেকে একটা অ্যাওয়ার্ড পেলাম। অনেক পুরস্কার পেয়েছি। এগুলো অনুপ্রেরণা।
১৯৮১ সালে আমি আর্ট কলেজের ছাত্রী রিফাত ইউসুফ লিতার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। যদিও সেটি ছিল প্রেম প্রণয়। পাঁচ দিনের প্রেমে আমি কাজি ডেকে বিয়ে করি। আমার স্ত্রীর কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হই। কারণ তিনি হলেন আমার প্রথম ও প্রধান সমালোচক, ছবির জগতে। সেটা জাপান, বাংলাদেশ যেখানেই হোক। সে বলত-
'তোমার ছবি হচ্ছে না।'
যখন হয়ে যেত, তখন বলত-
'ভালো হয়েছে।'
বাংলাদেশের যে কোনো সমালোচকের চেয়ে সে আমার ছবি ভালো বুঝে এবং রং, লাইন, টোন কোথাও কোনো গোলমাল হলে সে আমাকে পরিস্কার করে বলে। আমার স্ত্রী অনুপ্রেরণার সবচেয়ে বড় জায়গা।

বিষয় : প্রেরণার রঙ

মন্তব্য করুন