সে তাকিয়ে থাকে, চারপাশে প্রস্টম্ফুটিত আলো, কিন্তু সে দেখতে পায় না। মুখোমুখি তাকিয়ে কথাগুলো শুনতে শুনতে তার মাথার শিরাগুলো স্তব্ধ হয়ে আসতে থাকে। এটাই তাহলে পাক্কা- তার মুখ যে কথা বলতে গিয়ে নির্মম হয়ে উঠছে তা তার হুঁশে থাকে না। ফের বলে, যে সম্পর্কে প্রগাঢ়তা নেই তাকে টানার কোনো মানে নেই, অনুভূতিসম্পন্ন তুমি, আমার চেয়েও ভালো বুঝবে। কষ্ট পেয়ো না এই আশা করি।
একটানা কতক্ষণ যে রংতুলি ভরা পলেস্তারা ওঠা ঘরটায় ধপাস বসেছিল নীলিমা, নিজেও জানে না।
কোমরে টাটানি ধরলেও চেতনার জাগরণ হয় না। এমন অনায়াসে কথাগুলো বলল ও?
যেভাবে প্রেমের কথা বলত?
বিচ্ছেদ উচ্চারণও তেমন সহজাত?
কম্পমান রাত্রির প্রগাঢ়তা বাড়তে থাকে।
এক সময় দাঁড়ায়।
যেন অর্ধেক শরীর প্রস্তর হয়ে গেছে। নিজেকে যেন হেঁচড়েও টানা যায় না।
ফের ছেলেটির মুখ মনে করতে চায়।
হাজার রং এসে সবকিছু ঢেকে দেয়।
পূর্বপুরুষের ভাগাভাগিতে এই একটি রুম পেয়েছিল সে। স্যাঁতসেঁতে, চামড়া ওঠা ওঠা। তার মধ্যেই নিজের সমস্ত খরচ করে রংতুলি ইজেল কিনেছে।
তক্তপোশটা একেবারে দেয়াল-ঠাসা।
দিন-রাত্রি এখানেই কাটে নীলিমার। বাড়ি ভাড়ার কিছু ভাগ পায়। মাঝেমধ্যে আলো তার মুখ দেখে, সে যখন বাজারে যায়।
বেশ কয়েকটা অর্ধ আঁকা শিট পড়ে রয়েছে।
কিছুতেই কোনোটা সম্পূর্ণ করতে পারছে না। কোমরে ব্যথা নিয়েও একটা অসম্পূর্ণ পেইন্টিং ক্যানভাসে সেট করে। একটি বিষণ্ণ নারী, দূর ছায়াপথে তার দৃষ্টি, সেখানে আসমানের গায়ে কঙ্কাল লটকে আছে। পেইন্টিংয়ে কিছুতেই সূর্য আর বাতাসকে মূর্ত করতে পারছে না সে; যা ছবির জন্য জরুরি।
কঙ্কালটা কেন?
বিড়বিড় করে নীলিমা, শিল্পী কখনও তার কাজের ব্যাখ্যা দেয় না। কঙ্কালটির পাশেও আরও কিছু কাজ বাকি। কী এক জেদে তুলি নয়, মুঠো মুঠো রং নিয়ে ঠেসে দেয় ক্যানভাসে, আর নিজে শরীরে মেখে হয়ে ওঠে জবরজং।
চারপাশে বৃষ্টির নহর বইছে।
বাতাসের দাপটে নাজুক ঘরটি প্রায়ই হুড়মুড় ভাঙি ভাঙি করছে। আত্মার তীব্র বেদনারাশি জলে ভাসতে চায়। পারে না।
জানে সে, ছেলেটি বিয়ে করছে দু'দিন পর। বিয়ে বাজার, অন্যসব আয়োজনও নাকি সচকিত তার সামনেই হয়েছে, সে নাকি দেখেও দেখতে চায়নি- বন্ধুরা এত বোকা বলে তাকে।
অবশ্য বন্ধুরাও বলেছিল। কিন্তু নীলিমা এসব এড়িয়ে চোখ বন্ধ করে প্রায় ছেলেটির সঙ্গে চলেছে।
কিন্তু কী প্রগাঢ় নিবিড় প্রেমে ছেলেটিও তাকে বৃক্ষের মতো ঢেকে রেখেছিল, এই সত্যের কী জানে ওরা?
একটা রূপ হারা গতিবেগে সমূলে এগোতে চায়, মেঝেতে লেপটে কাঁদতে চায়, হায় আমি বৃক্ষহীন হলাম। কিন্তু জল আসে না চোখে।
সমস্ত ঘরের কাঁপনে কাঁপনে দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে দেয় নীলিমা। অথচ কী অন্তর দিয়েই না ভালোবাসত ছেলেটি নীলিমার এই ঘরকে, এই রংতুলি ছবিকে!
বলত-
এখানে এলে অন্য এক জীবনে আসার স্বাদ পাই।
সারি সারি কাল্পনিক প্রজাপতি উড়ে ওর সুন্দর স্মৃতিগুলোর ওপর।
কিন্তু এই মহা স্বপ্নভাঙা হৃদয় নিয়ে সে কোথায়, কার কাছে যায়? দু'দিন পর ফুলশয্যায় সে আরেকটা মেয়েকে- মাথাটা টলে ওঠে।
অসীম হতাশা থেকে সবেগে ঘুরে দাঁড়াতে চায়, পারে না।
আরেকটা শিট ক্যানভাসে রাখে, নিবিড় জোসনার বিমূর্তে দুটি ছেলেমেয়ে হাওয়ায় উড়ছে। মেয়েটি একদিকে, তার চেহারা মূর্ত নয়, ছিন্নভিন্ন হয়ে দু'জনের বিভিন্ন অংশ ক্যানভাসে ছড়িয়ে থাকলেও নীলিমার মুনশিয়ানায় দু'জনকেই স্থিত মনে হয়। মনে হয় কোনো ভাঙচুর নেই। তবে অনেক কড়া রঙের খেলা আছে পেইন্টিংটিতে।
নিচ অংশটা ফাঁকা।
কমপ্লিট করতে পারেনি নীলিমা।
ভাবে সূর্যের স্টম্ফটিক আলো এঁকে দেয় নিচটায়।
কিন্তু আত্মা নয়, যেন ভূমণ্ডলের পাঁজর ফুঁড়ে ক্রন্দন ধেয়ে উঠছে।
তুমি তোমার বুকের সবচেয়ে নিভৃত অংশটিতে আমাকে আঁকড়ে রাখো। সারাক্ষণ যেন তোমার সঙ্গে থাকতে পারি।
বলেছিল ছেলেটি।
মুহুর্মুহু স্থিত আর্তনাদে নীলিমা নিজের মধ্যেই বারবার গুঁড়ায় আর নিজেকে দাঁড় করাতে ক্যানভাসের সামনে যায়।
সমস্ত কাপড় ধেয়ে রঙের গন্ধ যেন কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে।
আরেকটা অসম্পূর্ণ শিট-
সমস্ত ক্যানভাসজুড়ে নীল রঙের দাপট। সূর্যের রংও নীল। সেই বিচ্ছুরিত আলোয় এক নগ্নিকা প্রকৃতির কাছে প্রার্থনায় নতজানু- ফিরিয়ে দাও অরণ্য।
ছবির এক কোণের দিকে থেকে থাকা সবুজ রংটি কিছুতেই ঠিকভাবে মূর্ত করতে পারছে না নীলিমা। যেন এক ছলকে কালো মেঘ তার মুখ ছুঁয়ে চলে গেল। বৃষ্টি থেমেছে। বাইরে রাত না দিন? ক্ষুুধায় আ-নখ কাঁপছে।
ভাগ্যিস পৃথিবীতে মানুষ এত ভালো, পাশের প্রতিবেশিনী বাক্সে করে খাবার এনে বলল-
টানা দিনরাত ঘরে পড়ে আছ। এভাবে মানুষ বাঁচে! লাত্থি দিয়ে উড়িয়ে দাও তাকে যে তোমার মর্যাদা বোঝেনি। তোমাকে অসম্মান করে। ভেতরে হাতুড়ির ঘা পড়লে হাতজোড় করে সে, থাক এসব। সে চলে গেলে নীলিমা রাক্ষসের মতো খায়।
অদ্ভুত! ঠিকমতো ক্ষুধাটা না লাগলে বোঝাই যায় না এর সামনে মানুষ কত অসহায়। শক্তিমানও বটে, নীলিমা ভাবে-
খাওয়ার সময়টায় আমার ত্রিসীমানায় ছেলেটির কোনো ছায়া ঘেঁষতে পারেনি।
এইভাবে দিন যায়।
অনেক বলেছিল ছেলেটি তাকে আঁকতে।
কিন্তু অদ্ভুত এক বোধ থেকে মেয়েটি নিশ্চিত জানত, ছেলেটিকে একবার ক্যানভাসে এঁকে ফেললে বাস্তবে মেয়েটির কাছে তার আর ছায়ামাত্র রবে না।
ক্যানভাসের ছবিটিই নীলিমার কাছে হয়ে যাবে মূল মানুষ।
এ ক'দিন অনেক ভেবেছে সে।
ছেলেটিকে ক্যানভাসে মূর্ত করে জীবন থেকে চিরতরে সরিয়ে দিক সে।
এরপর ছবিটিকে কুটি কুটি করে ছিঁড়বে সে।
বিশেষত ছেলেটির হানিমুনের দিন।
এক অদ্ভুত ধূসরতম বোধে বিমূর্ত হয়ে পড়েছিল সে, কিন্তু এই কাজটি করতে শিল্প আত্মা সায় দেয়নি।
করোটির ছায়াপাতে কত যে রঙের খেলা।
ঘৃণা করতে চায় তাকে, সে দিব্যি বিয়ে করে হানিমুনে যায় নীলিমাকে আমূল ভুলে।
ভুলেছে কী?
বিদায় নিতে থাকার সময়ের স্বার্থপর মুখটি যতবার মনে পড়ে, অদৃশ্য কাঁপনে তড়পায় নীলিমা।
নাহ! আর পারছে না।
সপ্রতিভ দাঁড়ায় সে। নতুন একটি শিট চাপায় ক্যানভাসে, কিন্তু যত তীব্রতায় সে ক্যানভাস সাজায় তারচেয়েও বেশি গুণ বিবশতায় সে নেতিয়ে পড়ে।
খোলা দরজার পাল্লা কাঁপছে।
দরজার পাল্লাটি দেখলে মনে হয় শত শকুনে আঁচড় কেটেছে।
রং নয় যেন তুলি দিয়ে সে ভূতুড়ে জীবাশ্ম তোলে।
নাহ! এই জীবনে তার দ্বারা আর পেইন্টিং হবে না। নিবিড় মুহূর্তগুলো পার হয়।
একসময় দরজায় ছায়া।
কম্পিত সচকিত বোধে বিমূঢ় হয়ে দেখে, একজন পরাজিতের মতো মাথা নত করে তার রুমে ঢুকেছে ছেলেটি।
ছেলেটিকে দেখে বাকরুদ্ধ বোধেও সচেতন হয়, সে কি নীলিমাকে ছেড়ে থাকতে পারছে না বলে বউকে তুচ্ছ করে দিয়ে আমূল চলে এসেছে?
ছি, কী ভাবছি! এভাবে সে এলেইবা খুশির কী? কম্পিত নীলিমার সত্তার ছায়াপথ উন্মুখ চোখে তাকায়।
ছেলেটি কাঁদছে, আমার স্ত্রী অন্য একজনকে তুমুল ভালোবাসে, আমাকে ধিক্কার দেয়, তার প্রোপার্টির কারণে নাকি বিয়ে করেছি। এই সবই সে বলেছে হানিমুনে গিয়ে।
নীলিমার অনন্ত হৃদয় ভাবলেশহীন।
সমস্ত ঘরে চক্কর খাচ্ছে রংধনু।
ছেলেটি আকুল হাত ধরে নীলিমার-
একা হয়ে গেছি যখনই ভেবে আত্মাটা ফালাফালা হবে, তখনই মনে হয়েছে, আমার এই পৃথিবীতে অন্তত তুমি আছ। কেউ না থাকলে একমাত্র তুমিই-।
রাত্রি প্রগাঢ় হয়।
ক্যানভাসের সামনে টানটান দাঁড়ানো নীলিমা, বুকের পাথরটা নেমে গেছে। এভাবে ছবি আঁকা ছাড়াই ছেলেটি তার মধ্যে মারা যাবে এত কুৎসিতভাবে, সে কল্পনাও করেনি।
একটি ভালোবাসা অনন্তে হারিয়েছে বলে বুকে হুহু তোলপাড় উঠলেও নীলিমার সতেজ তুলি এদ্দিন যা পারেনি তা আঁকতে আঁকতে সম্পূর্ণটার দিকে সবেগে ধাবিত হয়।

বিষয় : নীলাভ প্রেতাত্মা

মন্তব্য করুন