স্মৃতির পাতা উল্টাই। আজ থেকে ২০-৩০ বছর আগের কোনো একটি সন্ধ্যায় ফিরে যাই কিংবা চোখ বুলাই সেই পারিবারিক অ্যালবামটিতে যেখানে দাদা, দাদি, মা, ফুফু ও খালাদের ছবি দেখা যায়। শুধু ছবি দেখা যায়, তা নয়; স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় সেই সময়ের পোশাক ও ফ্যাশন সম্পর্কেও। কেমন ছিল সে সময়ের ফ্যাশন ও স্টাইল? তারপর কীভাবে আমরা এ সময়ের ফিউশন ফ্যাশনে পৌঁছেছি, কী কী পরিবর্তন এসেছে- ইত্যাদি সম্পর্কে বলেছেন প্রখ্যাত তিন ফ্যাশন ডিজাইনার। গ্রন্থনা ::মেহনাজ আক্তার
চন্দ্র শেখর সাহা
স্বাধীনতার সময়ের অনেক ছবিতে দেখা যায় ওই সময়কার পোশাক কেমন ছিল। মানুষের পারিবারিক ছবি, বিয়ের ছবি দেখেও অনেক আগের পোশাক ও ফ্যাশন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মানুষ ও সময় মূলত পরিবর্তনশীল। শাড়ি সবসময় রেডিমেড পোশাক ছিল। তাঁতি ছাড়া মানুষ শাড়ি বানাতে পারত না। আগে মানুষ ঘরে-বাইরে সবসময় শাড়ি পরলেও সালোয়ার কামিজ আসার পর থেকে শাড়ি পরার প্রচলন অনেকটা কমে যায়। এখন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারীদের ফ্যাশনে জায়গা করে নিয়েছে শার্ট-প্যান্টও।
পুরুষরা এখন যেমন শার্ট ও প্যান্ট পরছে এটি তাদের পোশাক ছিল না। পুরুষরা ধুতি-পাঞ্জাবি পরত। এরপর তারা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরতে শুরু করল। পুরুষরা লুঙ্গিও পরত ঘরে-বাইরে। সেখান থেকে পরিবর্তিত হয়ে পুরুষরা এখন শার্ট, প্যান্ট, শর্টস পরছে। এই সময়ের মধ্যে সারা পৃথিবীতে ডেনিম ঢুকেছে। ডেনিম ফ্যাশনে এখন ছেঁড়া ডেনিমও ঢুকেছে। ফ্যাশনটা এমন হয়ে গেছে, যত ছেঁড়া ততই যেন ফ্যাশনেবল।
পাঞ্জাবি আগে থেকে প্রচলিত থাকলেও এতে এত রঙের বৈচিত্র্য ছিল না। কিন্তু এখন রঙের বৈচিত্র্য এসে গেছে। ফ্যাশন হাউসগুলোতে সব রঙের পাঞ্জাবি পাওয়া যায়। আগেকার পাঞ্জাবিতে পকেট থাকলেও, এখন অনেক পাঞ্জাবিতে তা দেখা যায় না। তবে অনেক আগে থেকেই পাঞ্জাবিতে বোতাম, এমব্রয়ডারি, হাতের কাজ ইত্যাদির প্রচলন ছিল; এখনও আছে।
এখন আসি ফতুয়ার কথায়। এটি অনেক আগেও ছিল। পাকিস্তান আমলেও ছিল। টি-শার্ট জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকে ফতুয়া পরার প্রচলন কমে গেছে। এখন কিন্তু ফতুয়া পরার প্রচলন খুব একটা দেখা যায় না। আছে তবে কম। মূলত মানুষ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রুচি বদলায় এবং আরাম খোঁজে। আরামের বিষয়টির কারণেই নতুন কিছুকে গ্রহণ করছে। এই বিবর্তনের আরও একটি কারণ হলো বিশ্বায়ন। এখন পৃথিবী যেন হাতের মুঠোয়। চাইলেই বিভিন্ন দেশের পোশাক ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা যায়। ইন্টারনেটে বিভিন্ন কিছু দেখা যায়। ডিজাইনাররাও অনেক কিছু ডিজাইন করে থাকেন, অন্যদের সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে।
এখনকার তরুণরা কিন্তু শার্ট-প্যান্টও পরছে আবার হিজাব, হাত মোজা, পা মোজাও বেছে নিচ্ছে। এগুলো যার যার ব্যক্তিগত পছন্দ। আমরা মোটামুটি সবার কথা মাথায় রেখেই পোশাক ডিজাইন করে থাকি। একটা সময় ফ্রক খুব প্রচলিত ছিল। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফ্রক ফিরে এসেছে থ্রি পিসের মতো করে। জামাটা ফ্রক হলেও এর সঙ্গে সালোয়ার ও ওড়না থাকে। অনেকে আনারকলি, জিপসি এসব নামকরণও করেছে। আনারকলি, জিপসি এগুলো সালোয়ার-কামিজের অন্য প্যাটার্ন। কিন্তু কোনো ব্র্যান্ড এগুলোকে আনারকলি, জিপসি বলে নাই। বলেছে সালোয়ার-কামিজ।
এখন যেমন হারেম প্যান্ট নিয়ে এসেছে অনেক ফ্যাশন হাউস ও ব্র্যান্ড। এর নাম আসলে হারেম প্যান্ট ছিল না। এগুলো মূলত ধুতি সালোয়ার। এটি অনেক আগেও ছিল। হারেম শব্দের অর্থ অন্দরমহল। যে অন্দরমহলে উপপত্নীরা থাকে। টার্কিস ফারসি অথবা উর্দু এরকম একটা শব্দ থেকে এ শব্দটি এসেছে। এখন মানুষ ধুতি সালোয়ার না বলে হারেম প্যান্ট বলে থাকে। বিক্রির জন্যই মূলত ডিজাইনাররা এ ধরনের নামকরণ করে থাকে। একটা নতুন আকর্ষণ তৈরি হয়েছে।
লেখক :কিউরিয়াসের স্বত্বাধিকারী ও ফ্যাশন ডিজাইনার
শাহীন আহমেদ
ফ্যাশনের পরিবর্তনটা সব সময় থাকে। আমরা সবসময় খেয়াল রাখি পোশাকের ফিটিং, লেন্থ, হাতার ডিজাইন ও নেক লাইন কেমন হবে ইত্যাদি। এগুলো প্রায়ই পরিবর্তিত হয়। দেখা যায়, পুরোনো থেকে কিছু ফিরে আসে, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুন সংযোজন হয়। যে পরিবর্তনটা ফিরে আসে সেটা কিন্তু পরিপূর্ণভাবে আগেরটা ফিরে আসে না। আমরা যদি ২০০০ সালের প্রথম দিকের দিকে তাকাই তখন শর্ট কামিজের প্রচলন বেড়েছিল। ১৯৬০-৭০ সালের সিনেমা দেখলেও বুঝতে পারবেন সে সময় শর্ট কামিজের প্রচলন ছিল। সেই শর্ট কামিজের চল ফিরে এসেছিল ২০০০ সালের শুরুর দিকে। যে পরিবর্তনটা দেখা যায় তা হলো ওই সময়ের কামিজ আর এ সময়ের কামিজের লেন্থ এক রকমের হলেও, পায়জামা ও ওড়নার ধরন একরকম নয়। জামায় কাজের ধরনও ভিন্ন। ২০০৪-০৫ সালের পরের দিকে আমরা দেখলাম কামিজের লেন্থ বাড়তে থাকল। সেমি লং কামিজের চাহিদা বাড়ল। পরে দেখা গেল, লং কামিজের প্রচলন এলো। ২০১২-১৫ সালের দিকে লং কামিজের চল বেড়েছে। দেখা গেল সবাই লম্বা পোশাক পরছে। কিছুটা গাউনের মতো পোশাকও পরছে। এখন এসে আমরা দেখি লং কামিজ চলছে না। মাঝারি লং কামিজগুলো বেশি চলছে। আমরা ভাবছি, সামনের দিনে কামিজের লেন্থ ছোট হয়ে যাবে। শর্ট কামিজের চাহিদা হয়তো আবার তৈরি হবে। সময়ের চাহিদার কারণে কামিজের ডিজাইনে এমন পরিবর্তন আসে।
ছেলেদের পোশাকের ক্ষেত্রেও আমরা দেখি ফিটিং বিভিন্ন ধরনের থাকে। কখনও দেখি ফিটিং পোশাক, স্কিন সিটিং কিংবা স্লিম ফিটিং ইত্যাদি আসছে। রেগুলার ফিট আসছে। পাঞ্জাবির ক্ষেত্রে আমরা দেখি একটা সময় শর্ট পাঞ্জাবি বেশ চলেছে। এখন আবার লং পাঞ্জাবি চলছে। গত ২০ বছরের মধ্যে মোটামুটি সব ধরনের পরিবর্তন আমরা দেখেছি। পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গলার ডিজাইন, হাতার ডিজাইন, প্যাটার্ন ইত্যাদিতে পরিবর্তন আসে। গত তিন-চার বছর ধরে বোট নেক অনেক জনপ্রিয়। একসময় স্কয়ার গলার ডিজাইন, রাউন্ড শেপের ডিজাইন জনপ্রিয় ছিল। হাতার ক্ষেত্রে দেখি একসময় মেয়েদের শর্ট হাতার জামা ব্লাউজ পছন্দের ছিল। এখন মেয়েরা হাফ স্লিভ, ফুল স্লিভের পোশাক বেছে নেন।
গত কয়েক বছর খেয়াল করলাম, থ্রি পিসের তুলনায় সিঙ্গেল কামিজ, ওয়ান পিস, কুর্তি ইত্যাদির চাহিদা বেড়েছে। এগুলোতে ট্র্যাডিশনাল, ফিউশন টাইপের ডিজাইন করা হচ্ছে।
এই সময়ে সারা বিশ্বেই আরামদায়ক পোশাকের গুরুত্ব বাড়ছে। পোশাকের ফিটিং এমন হবে যেন দেখতে তাকে ভালো লাগে এবং পোশাকটা আরামদায়ক। এক সময় জর্জেট কাপড়ের খুব চাহিদা ছিল। মাঝখানে জর্জেটের চাহিদা ছিল না। আবার এখন জর্জেট ও সিনথেটিক মিক্সড কটন কাপড়গুলো জনপ্রিয় হচ্ছে। বাংলাদেশে আমরা দেখি কটন কাপড় সবসময় জনপ্রিয়। এখন পোশাকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত হচ্ছে লিনেন কাপড়। কারণ এই কাপড়ে ভালোভাবে ডিজাইন করা যায়।
আমাদের দেশের অন্যতম একটা পোশাক শাড়ির প্রসঙ্গে এলে দেখা যায়, একসময় বাংলাদেশের সব মেয়ে শাড়ি পরত। পরে শাড়ির পাশাপাশি সালোয়ার-কামিজ জায়গা করে নিয়েছে। তরুণীদের পাশাপাশি বয়স্করাও বেছে নিচ্ছেন সালোয়ার-কামিজ। এখন সালোয়ার-কামিজের চেয়েও সিঙ্গেল কামিজের চাহিদা বেশি।
এখন মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। মানুষ সময়োপযোগী পোশাক পরতে চায়। এ কারণে এই সময়ে শাড়ির চাহিদা বেড়েছে। যে কোনো অনুষ্ঠানে তারা শাড়ি পরে যাচ্ছে। সুতি, সিল্ক্ক, মসলিন, জামদানি সব ধরনের শাড়ির চাহিদা আগের তুলনায় বেড়েছে।
লেখক :অঞ্জন'স-এর স্বত্বাধিকারী ও ফ্যাশন ডিজাইনার
বিপ্লব সাহা
ফ্যাশন স্থির থাকে না। এটি নদীর মতো বহমান। ধীরগতিতে হোক, দ্রুতগতিতে হোক, ফ্যাশন তার আপন গতিতে চলতে থাকে; এবং এই যে তার চলমান গতি এটি কখনও কখনও ঘুরে ঘুরে আসে। অর্থাৎ পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। হিসাব করে দেখা গেছে, ২০-২৫ বছর পরে ঘুরেফিরে একটা ফ্যাশন আসে এবং তার সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ হয়। আমি কাজ শুরু করেছিলাম ১৯৯৪-এ। অর্থাৎ ২৭-২৮ বছর ধরে কাজ করছি। সে সময় আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, একই সঙ্গে কাজ করতাম। সেই যে নব্বই দশকে আমরা যে ধরনের কাজ করতাম এখন ২০২২-এ এসেও সেই একই ধরনের কাজ আমরা করছি। তখন যেমন ফ্রক টাইপ কাপড় ছিল, এখন আমরা আবারও এ ধরনের কাপড় নিয়ে কাজ করছি। তখন সবাই লং তথা লম্বা পোশাক পরত। আশির দশকে ফিটিং শার্ট পরত। এখন যেটিকে আমরা স্লিম ফিটেট শার্ট বলি সেটি তখনও প্রচলিত ছিল। আমাদের চলচ্চিত্র, নাটক কিংবা বাস্তবজীবনের স্মৃতির পাতায় তাকালে আমরা এর প্রমাণ দেখতে পাব। সেই আশির দশকের পোশাক আমরা ঘুরেফিরে পাচ্ছি। সেটার সঙ্গে হয়তো ২০-৩০ শতাংশ নতুন জিনিস যুক্ত হয়ে বাজারে আসছে। নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে এবং মানুষ সেটিকে সাদরে গ্রহণ করছে।
এখন শর্ট স্লিভ ব্লাউজ পরছে। ষাটের দশকে সত্তরের দশকের নারীরা শর্ট স্লিভের ব্লাউজ পরত। সেই সত্তরের ব্লাউজ ফ্যাশন কিন্তু এখন আবারও চলছে। আগেও আমরা যেসব স্লিভলেস ব্লাউজ দেখতাম এখন সেগুলো আবারও দেখছি এবং ডিজাইন করছি। যদি আমি শাড়ির ধরনের কথা বলি তাহলে বলতে হয় ওই সময়ে তাতে বোনা কাপড় ছিল। মাঝখানে স্ট্ক্রিনপ্রিন্ট, ব্লক প্রিন্ট নানান ধরনের ভ্যালু অ্যাড হয়েছে। এখন কিন্তু আমরা দেখতে পারছি তাঁতের শাড়ি, জামদানি শাড়ির চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়ছে। এই শাড়ির চাহিদা মাঝে আবার কমে গিয়েছিল। একটা সময় পাঞ্জাবি ছিল ধর্মীয় পোশাক। হয়তো নামাজের জন্য, ঈদের জন্য গায়ে পাঞ্জাবি জড়াতেন। মুরব্বিরা অধিকাংশ সময় পাঞ্জাবি পরতেন। বোদ্ধাশ্রেণির পোশাক ছিল এটি। এটি কিন্তু এখন ক্যাজুয়াল পোশাকে পরিণত হয়েছে। আরামদায়ক ও আকর্ষণীয় পাঞ্জাবির জন্য বিভিন্ন ডিজাইনার কাজ করছেন। আমরাও কাজ করছি। আমাদের দেখে দেখে আরও অনেকে কাজ করছে। প্রত্যেকে নতুন ভাবনা নিয়ে হাজির হচ্ছে। পরে আরও অনেকে আসবে। প্রত্যেকের কাজের ধারা থেকেই নতুন নতুন ভাবনা, নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে।
এখন সবাই পালাজ্জো পরে। স্কার্ট পরে। প্যান্ট কাটের সালোয়ার পরে। এগুলো সত্তর-আশির দশকে সবাই পরতেন। দিদিদের পুরোনো সাদাকালো ছবিতে তা দেখেছি। এখন আবার ঘারারা দিয়ে শর্ট কামিজ পরার চল এসেছে। এটি অনেকেই পরছে। শর্ট কামিজ দিয়ে ঘারারা পরার প্রচলন সেই সত্তর-আশির দশকেও প্রচলিত ছিল। ঘারারা আমাদের এখানকার সংস্কৃতি না। এটা ভিনদেশি সংস্কৃতি। এটা আমাদের সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়ে গেছে। এরকম আমাদের কাজের সঙ্গে ভিনদেশি কাজ, ভিনদেশি কাজের সঙ্গে আমাদের কাজ, ভিন্ন ভিন্ন সোসাইটি অনুযায়ী আমাদের ফ্যাশনের পরিবর্তন ও উন্নয়ন ঘটেছে।
বাচ্চাদের পোশাক, বড়দের পোশাক সবখানেই পুরোনো ফ্যাশন ফিরে আসছে। এটি আবার ট্রেন্ড হিসেবেও জায়গা করে নিচ্ছে। স্লিভ (হাতা) বা নেক তথা গলার প্রসঙ্গে এলেও বলতে হয়, আগেও বড় ও গোল গলার কামিজ, ব্লাউজ পরা হতো। এখনও তাই। কিছু কিছু ফ্যাশন সব সময় থাকে। সব কালেই থাকে। আবার কিছু কিছু জিনিস ক্ষণিকের। হাওয়ায় ভেসে আসে, আবার উড়েও যায়। বাজারেও দেখা যায় ক্রেতাসাধারণদের মধ্যে কেউ ট্রেন্ডি লুক পছন্দ করে, আবার কেউ কেউ ট্র্যাডিশনাল বিষয় পছন্দ করে। কিছু ফ্যাশন সবসময় থেকে যায়, যা কখনও পুরোনো হয় না। তবে এতে পরিমার্জন হয় কিংবা নতুনত্ব যুক্ত হয়। এভাবেই বিবর্তন ঘটছে। এর পাশাপাশি অতীতের কাজগুলো পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে।
লেখক :বিশ্বরঙের স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার