- শিক্ষা
- বাজেট যেন পিছিয়ে পড়া মানুষের পক্ষে যায়
বাজেট যেন পিছিয়ে পড়া মানুষের পক্ষে যায়

জাতীয় বাজেট নিয়ে সোমবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সিপিডি-নাগরিক প্ল্যাটফর্ম সংলাপে আলোচকরা -সমকাল
সমতাভিত্তিক ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠার জাতীয় আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ থাকতে হবে আগামী বাজেটে। আর্থসামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে বৈষম্য চলছে, তা দূর করতে বাজেটকে পিছিয়ে পড়া মানুষের পক্ষে নিতে হবে। না হলে সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করা সম্ভব হবে না।
আগামী বাজেট সামনে রেখে এক নীতি সংলাপে এমন মতামত দিয়েছেন বক্তারা। ‘আইএমএফের সময়কালে অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের কথা জাতীয় বাজেটে কীভাবে প্রতিফলিত হতে পারে’– শিরোনামের এ সংলাপ গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম যৌথভাবে এর আয়োজন করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সংলাপ আয়োজনে সহযোগিতা দেয়।
সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেল এবং সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বিশেষ অতিথি ছিলেন। নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এবং সিপিডির বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল সংলাপে সভাপতিত্ব করেন। অসুবিধাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা সংলাপে তাঁদের মতামত তুলে ধরেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, আগামী বাজেটে প্রতিবন্ধী মানুষের ভাতা বাড়বে।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। অনেক বেশি হয়তো বাড়বে না। তবে এটি যাতে একটি অবলম্বন হিসেবে তাঁদের উপকারে আসে, সে চেষ্টা করছে সরকার। তিনি বলেন, ঐতিহাসিকভাবেই সমাজের দরিদ্ররা বঞ্চিত। আইনি অধিকার থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই যা সত্য। সরকারি অর্থ সব সময় ঠিকমতো তাঁদের হাতে পৌঁছায় না।
সংলাপের শিরোনাম নিয়ে আপত্তি তুলে মন্ত্রী বলেন, ‘বাজেট প্রণয়নে আইএমএফের হাত নেই। তারা কোনো ফ্যাক্টর নয়। সমস্যা সমাধানে তারা পরামর্শ দেয়। আমরা মরে যাইনি যে, তারা আমাদের বাঁচাতে এসেছে। তারা দাতাও নয়, ঋণদাতা।’ তিনি উল্লেখ করেন, আসলে আইএমএফ কোনো শর্ত দেয়নি। প্রয়োজনে কিছু পরামর্শ দিয়েছে। ভর্তুকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মন্দ ভর্তুকি ভালো ভর্তুকিকে খেয়ে প্রণোদনার নামে উন্মাদনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ভর্তুকির বোতলে দুধ খেয়ে যারা অভ্যস্ত, তারা বোতল ছাড়তে চায় না । মা হিসেবে সরকার বোতল ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।
তিনি আরও বলেন, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের বিপরীতে সরকার আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে। তার পরও সরকার হুন্ডির কাছে হেরে যাচ্ছে। ৩০ বিলিয়ন ডলার মন্দ নয়, যা চার থেকে পাঁচ মাসের খাদ্য আমদানি ব্যয়ের সমান। মন্ত্রী বলেন, ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকার এখন কৃচ্ছ্রতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বড় কর্মকর্তার বড় গাড়ি, বড় বাড়ি– এসব জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে। এগুলো ব্রিটিশ আমলে প্রয়োজন ছিল। কারণ এসব সুবিধা না পেলে কর্মকর্তারা এ দেশে আসতে চাইত না।
বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতির আলোকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও আগামী জাতীয় বাজেট থেকে তাদের প্রত্যাশা নিয়ে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় সুপারিশ সংগ্রহ করে। সংলাপে এসব সুপারিশ উপস্থাপন করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, যেসব দেশে আইএমএফের কর্মসূচি চলে, সেসব দেশের অর্থনীতির ওপর সংস্থাটি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতির কারণে বাজেট এখন অনাথ আর আইএমএফ পালক পিতা। দেশে আগে থেকেই চলে আসা সামাজিক বৈষম্য আরও বেড়ে যেতে পারে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির কারণে। সংস্থার শর্ত পরিপালনের কারণে বৈষম্য বেড়ে যেতে পারে। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তার মতে, ভর্তুকি ভালো এবং খারাপ দুই ধরনেরই হয়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বিদ্যুতে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হচ্ছে, তা সার কিংবা বীজে দিলে ভালো হতো। সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো যেত। মোট কথা, ভর্তুকি সব সময়ই গরিব মানুষের পক্ষে যাওয়া উচিত।
দেবপ্রিয় বলেন, আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রাজস্ব আয় বাড়াতে সম্পদের ওপর কর বাড়ানো উচিত। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সরকার সে দিকে যাবে কিনা প্রশ্ন রয়েছে। সুদের হার উন্মুক্ত করার আইএমএফের শর্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সুদের হার করিডোর ব্যবস্থাপনা সঠিক না হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যান্য শর্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আইএমএফের এসব শর্ত বাস্তবায়ন করার আগে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামত নিতে হবে। তাদের মতামত ছাড়া শর্ত কার্যকর করতে গেলে সব ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও বাড়বে। এমন প্রেক্ষাপটে আগামী বাজেট সংবেদনশীল হওয়া উচিত, যাতে পিছিয়ে পড়া মানুষের পক্ষে যায়। কারণ, পিছিয়ে পড়া মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে।
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, গত কয়েক দিন ধরে বিদ্যুতের দেশব্যাপী লোডশেডিংয়ের অর্থ হচ্ছে, গ্যাস কেনার মতো অর্থ নেই সরকারের হাতে। অথচ কর ফাঁকির অর্থ যারা বিদেশে পাচার করেছে, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। লাখ লাখ কোটি টাকার ঋণখেলাপিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আগামী বাজেট নির্বাচনের বছর; অথচ উন্নয়ন ব্যয় বেশি ধরা হচ্ছে না। এর অর্থ সরকারের কাছে টাকা নেই। অথচ বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ আছে। তিনি বলেন, ব্যর্থতা ঢাকার জন্য তিন নন্দঘোষ পেয়ে গেছে সরকার। করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট। ব্যর্থতার জন্য এগুলোকেই কারণ হিসেবে বলে যাচ্ছে সরকার। তিনিও বলেন, ভর্তুকি তুলে দিলে সাধারণ জনগণই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কর ফাঁকি দিয়ে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার সুযোগ আগামী বাজেটে রাখা উচিত হবে না। কারণ এ ধরনের সিদ্ধান্ত নীতি-নৈতিকতার বিচার কিংবা রাজনৈতিক বিচারে গ্রহণযোগ্য নয়। উপরন্তু এ সুবিধায় একটি টাকাও দেশে আসেনি। গরিব মানুষের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাজেটে নীতি-সিদ্ধান্ত থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন তিনি।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহিমদা খাতুন বলেন, ভর্তুকি তুলে দেওয়া হলে কৃষি উৎপাদনে সমস্যা হবে। তখন খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে। সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জাতীয় আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে বাজেটে ব্যবস্থা থাকতে হবে। যাদের আয় বেশি, তাদের কাছ থেকে বেশি কর আদায় করতে হবে। তা না হলে সমাজ থেকে বৈষম্য দূর হবে না।
সংলাপে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন– ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) নির্বাহী পরিচালক ফেরদৌস আরা বেগম প্রমুখ।
মন্তব্য করুন