উচ্চারণের বিপরীতে
সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে কয়েকটি শঙ্কা ও প্রশ্ন

মাহবুব আজীজ
মাহবুব আজীজ
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:৩১ | আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৩ | ১৫:৫০
২৮ অক্টোবর থেকে ১৯ নভেম্বর (রোববার) পর্যন্ত মোট ১৪৪টি যানবাহনে (ট্রেন ছাড়া) আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রাজধানীতে আগুন দেওয়া হয়েছে ৯২টি যানবাহনে (প্রথম আলো, ২০ নভেম্বর)। তবে বিগত ২৩ দিনে দেশজুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে যানবাহনে কে বা কারা আগুন লাগাচ্ছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ এখন পর্যন্ত হাজির করতে পারেনি পুলিশ বা গোয়েন্দা সূত্র।
অবশ্য সরকারি প্রচারযন্ত্রে বারবার বলা হচ্ছে, নির্বাচন যারা চায় না, তারাই জ্বালাও-পোড়াও করছে। সরকারি অভিযোগ, বিএনপি এই অপকর্ম করছে এবং ২০১৪ নির্বাচনের আগেও তারা একই অপকর্ম করেছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা জ্বালাও-পোড়াও করছেন, তার অকাট্য প্রমাণ হাজির করা কঠিন কাজ নয়। আমাদের প্রশাসন– নানা ধরনের বাহিনীর তৎপরতায় বর্তমানে বিএনপির নেতাকর্মীর বেশির ভাগই হয় জেলে, না-হয় ঘরছাড়া, অন্তত ৪০ লাখ কর্মীর নামে মামলা চলছে; এ অবস্থায় রাস্তায়-যানবাহনে জ্বালাও-পোড়াও করছে কারা? কেন তাদের হাতেনাতে ধরা হচ্ছে না? জ্বালাও-পোড়াওকারীদের হাতেনাতে ধরবার ব্যর্থতায় এই অপকর্মের মূল হোতা কারা– এ নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ দেখা দেয়।
হরতাল-অবরোধে ঘরে আটকে থাকা নিম্ন আয়ের মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। নির্বাচনের এখনও ৪৭ দিন বাকি। প্রশ্ন উঠেছে, আরও দেড় মাস এভাবে হরতাল-অবরোধ চললে মানুষ খাবে কী? বাঁচবে কীভাবে?
ন্যায্য প্রশ্ন। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের অধিকাংশ মানুষ কাজে যেতে না পারলে তাদের জীবন চাকা বন্ধ হবার উপক্রম হয়, এই নিয়ে তর্কের কোনো অবকাশ নেই। আবার হরতাল-অবরোধের অস্ত্র বারবার ব্যবহারে ভোঁতা হয়ে যায়, বিগত দু’বারের নির্বাচন অভিজ্ঞতা সে কথাই বলে। জ্বালাও-পোড়াওতে মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়। ২০১৪ ও ২০১৮-এর পর আরেকটি নির্বাচন আসন্ন; যেখানে একপেশে নির্বাচন অবধারিত হয়ে উঠেছে, সেখানে বিএনপি যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, তার সব পথ চূড়ান্ত করা হয়েছে। এই অবস্থায় দেশের মানুষের অন্তত এক-তৃতীয়াংশের সমর্থন নিয়ে বিএনপি কেন নির্বাচনে অনুপস্থিত, এ প্রশ্ন না করে বরং বলা ভালো, বিএনপির এখন কী করা উচিত! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে টানা দেড় বছর অহিংস আন্দোলন করে, শীর্ষ নেতৃত্ব নাশকতার অভিযোগে জেলবন্দি হবার পর এখন বিএনপি হরতাল-অবরোধ করে চলছে। নির্বাচনও ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে বলে ইসিসহ সরকার প্রস্তুত। এ অবস্থায় বিএনপিকে নিজেদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করে দ্রুত নতুন অবস্থানে আসতে হবে। গেল দু’বারের ‘এই ধরনের’ নির্বাচন অভিজ্ঞতা বিএনপিকে নির্বাচনের ৪৭ দিন আগে কী বার্তা দেয়? বিএনপির মূল নেতৃত্বকে এই প্রশ্নের উত্তর তাড়াতাড়ি বুঝে উঠতে হবে, হিসাব করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
২.
বিএনপি ছাড়াই নির্বাচনের সকল আয়োজন করে বসে আছে নির্বাচন কমিশন [ইসি]। এমনকি নির্বাচন বর্জনকারী কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল প্রশাসনিক হয়রানির মুখোমুখি হলে ইসি এর দায় নেবে না বলেও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব কারাগারে, কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ। সমকালের ১৯ নভেম্বর সংবাদে বলা হচ্ছে, ‘মনোনয়ন ফরম বিক্রির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও এর শরিক দলগুলো নির্বাচনী যাত্রা শুরু করে দিল। অন্যদিকে গতকাল শনিবারও বিএনপির অফিসে তালা ঝুলতে দেখা গেছে।’ মনোনয়নপ্রত্যাশীর ভিড়ে যখন আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ঈদ নেমে এসেছে, তখন বিএনপির মহাসচিব নাশকতার ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগে কারাগারে বন্দি, অন্যান্য শীর্ষ নেতারও একই অবস্থা।
আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে মনোনয়নপ্রার্থীর বিপুল ভিড়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের প্রধান কার্যালয়ে প্রবেশ করতে না পেরে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে গেছেন। নৌকা প্রতীক চাইছে শরিক দলগুলো, আওয়ামী লীগ জোটগতভাবে নির্বাচন করবার কথা ইসিকে জানিয়েছে। জাতীয় পার্টির মধ্যে বিরোধ শুরু হয়েছে, কিংস পার্টিগুলোর তৎপরতা প্রতিদিন বাড়ছে। নির্বাচনমুখী এরকম একটি হাওয়ার মধ্যে নৈতিকতার বিষয়টি পুরোপুরি উপেক্ষিত হয়ে আছে।
যে গণতান্ত্রিক কাঠামো একটি দেশের মেরুদণ্ড, তাতে যথার্থ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন অর্থহীন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তর্কাতীতভাবে এ দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ৪৪টি কি ৪৪৪, তাতে কিছুই যায় আসে না, প্রধান দুটি দলের অংশগ্রহণেই কেবল এ দেশে নির্বাচন অর্থবহ হতে পারে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পরিবেশের অনুপস্থিতির কারণে যেহেতু বিএনপি তা বয়কট করছে, তাহলে এই প্রশ্ন অবশ্যই গ্রাহ্য করতে হবে– কেন সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না? কে এর দায় নেবে? কেন নির্বাচন কমিশন গুরুতর এই প্রশ্ন সম্পর্কে নির্লিপ্ত থাকছে? এই নির্লিপ্তি ও দায়হীনতার পরম্পরা অবশ্যই জাতিকে বহন করতে হবে।
দেশের কয়েক কোটি মানুষের মতামতের প্রতিফলন একটি জাতীয় নির্বাচনে প্রতিফলিত না হলে তার প্রভাব নিশ্চিতভাবেই সমাজের নানা কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। উদাসীন নির্বাচন কমিশন সব শঙ্কা ও প্রশ্নের বিষয়ে নির্বিকার। কিন্তু অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ থাকে না; তাই সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রশ্নে নির্বাচন কমিশন এখনও পারে নিজেদের দায়িত্বে প্রধান দুই পক্ষকে পরস্পরের সঙ্গে সংলাপের ব্যবস্থা করতে। প্রতিপক্ষের মূল নেতৃত্বকে জেলে পুরে, সভা-সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ করে, নেতাকর্মীকে ঘরবাড়ি ছাড়া করে সুষ্ঠু নির্বাচন কোনো প্রক্রিয়াতেই সম্ভব নয়। বিরোধী দলের নেতৃত্বকে নানা প্রলোভনে দলবিচ্ছিন্ন করে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে, খণ্ড-উপখণ্ড নামসর্বস্ব দলকে মাঠে নামিয়ে, বিরোধীদলীয় কয়েক নেতাকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিয়ে জোড়াতালির নির্বাচন দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও বিকাশকে চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
৩.
তারপরও নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। একই আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী, শরিক ১৪ দল, জাতীয় পার্টি-কিংস পার্টির মধ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে প্রচুর দরবার চলছে। এদিকে সমকালে ২০ নভেম্বর প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, ‘মামলা-হামলা আর গ্রেপ্তার আতঙ্কে (ছাত্রদল নেতা) অনেকেই এখন এলাকা ছেড়ে ঢাকামুখী। ... ঢাকায় এসে লুকিয়েছেন, ধরেছেন ছদ্মবেশ। রাজধানীর রাজপথে একবেলা চালান রিকশা, আরেকবেলা হকারি করে বেচেন পান-সিগারেট। ... ছাত্রদল নেতা ইসমাইল হোসেন মিঠু জানান, এলাকায় থাকলে পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও হয়রানি করেন।’
বিএনপি কি নিষিদ্ধ কোনো রাজনৈতিক সংগঠন? তার নেতাকর্মীকে এলাকা ছেড়ে ছদ্মবেশ ধারণ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে? সমাজে কী বার্তা এর মধ্য দিয়ে দেওয়া হচ্ছে! বিরুদ্ধ মত বা পক্ষকে আমরা কতদূর পর্যন্ত অগ্রাহ্য করতে চাই আমাদের রাজনীতিতে, তারও নিশানা এইসব ঘটনায় স্পষ্ট হয়। আওয়ামী লীগসহ শরিক দল, কিংস পার্টিরা– নিজেরা নিজেদের মধ্যে নির্বাচন করে একপক্ষীয় একটি সমাজ কাঠামো তৈরি করে নেবে! পরমতসহিষ্ণুতা কেবল বইপত্রের বিষয় হয়ে থাকতে পারে না।
প্রতিপক্ষকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করবার চিন্তা প্রকৃতই পশ্চাৎপদ ও সারশূন্য নিশ্চয়ই। সময় এখনও আছে, আমাদের প্রধান দুই প্রতিপক্ষের পারস্পরিক সহাবস্থান সমাজের ভারসাম্যের জন্যই জরুরি। কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতেই হবে। কে এগিয়ে আসবে? আওয়ামী লীগ নির্বাচনে মনোযোগী, বিএনপি নেতৃত্ব জেলে। নির্বাচন কমিশন? সুশীল সমাজ? বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন? গণমাধ্যম?
আমরা তা বলতে পারি না। কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, সময় আছে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য সব পক্ষ এগিয়ে আসুন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাধা হবেন না। অযৌক্তিক আচরণ সমাজে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায় হয়েই থাকে।
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল ও সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com