শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সুরক্ষা বলয়ের কথা আমরা জানি। ইমিগ্রেশনসহ বিমানবন্দরের নানা পর্যায়ে নিরাপত্তার নামে রীতিমতো হয়রানি করা হয়– এই অভিযোগ ভিআইপি ছাড়া বেশির ভাগ সাধারণ যাত্রীর। বিমানবন্দরে কঠোর নিরাপত্তা নজরদারির মধ্যে সাধারণ যাত্রীদের বারকয়েক জুতা, ঘড়ি, বেল্ট খুলে যেভাবে বেষ্টনীর পর বেষ্টনী পার হতে হয়; এর মধ্যে সাম্প্রতিক একটি সংবাদ একই সঙ্গে গভীর বিস্ময় ও চরম উদ্বেগ তৈরি করে। মঙ্গলবার আনুমানিক রাত ৪টা ১০ মিনিটে জুনাইদ মোল্লা নামের ১২ বছরের এক শিশু বিমানবন্দরের ১৪ স্তর নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে কুয়েতগামী বিমানে উঠে পড়ে। পাসপোর্ট, টিকিট, বোর্ডিং পাস ছাড়া শিশুটি কীভাবে কুয়েত এয়ারওয়েজের কেইউ-২৮৪ ফ্লাইটে উঠে আধঘণ্টা যাবৎ বসে ছিল, তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। বিমানটিতে ৩৩০ জন যাত্রী ছিলেন, জুনাইদ যে আসনে বসেছিল, সেই আসনের যাত্রী এসে সেখানে বসতে চাইলে ধরা পড়ে, আসনসংখ্যার চেয়ে বিমানে একজন যাত্রী বেশি– শিশু জুনাইদ মোল্লা, যাত্রীর তালিকায় তার নাম নেই।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁকে বহনকারী ভিভিআইপি ফ্লাইটটি বিমানবন্দর ছাড়ার মাত্র ১০ ঘণ্টা পর এই ঘটনা পুরো বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। সংশয় জাগে, এটি কি শুধুই শিশুমনের অ্যাডভেঞ্চার? অজ পাড়াগাঁয়ের একটি শিশু [জুনাইদের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর থানার বরইহাটি গ্রামের বাঁশবাড়িয়ায়] বিমানবন্দরের এতগুলো গেট কীভাবে নির্বিঘ্নে পার হলো? বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ঘটনার পরে তৎপর হয়, ইমিগ্রেশন ও সিকিউরিটির সঙ্গে জড়িত সবাইকে সাসপেন্ড করে জানায়, পুরো ঘটনা তদন্ত করে দেখা হবে!

২.

নিশ্চয়ই তদন্ত হবে, নতুনতর ঘটনায় আমরা ভুলেও যাব শিশু জুনাইদের রোমাঞ্চকর বিমানযাত্রার কথা। তবে সুশক্ত নিরাপত্তা বলয় শিশু জুনাইদের সামনে যেভাবে ভেঙে পড়ল, তাতে ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’ আপ্তবাক্যের কথা আমাদের বারবার মনে পড়বে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনও বর্তমানে বজ্র আঁটুনি দিচ্ছে, আমাদের মনে পড়ছে– এই বজ্র আঁটুনির পেছনেও ‘ফসকা গেরো’র উপস্থিতি আছে। বুধবার নির্বাচন কমিশন [ইসি] আয়োজিত ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন : প্রত্যাশা ও বাস্তবতা’ শীর্ষক কর্মশালায় নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্টজন দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। তাদের প্রত্যাশা– সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। কর্মশালায় বক্তব্য আসে, ৩৩ শতাংশ জনসমর্থন থাকা একটি বড় দল নির্বাচনে না এলে আর ৩০০ দল থাকলেও তা অংশগ্রহণমূলক হবে না। বক্তাদের অনেকেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার সংকটের কথা জানিয়েছেন। কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন এর আগেও প্রচুর আড়ম্বরের সাথে সংলাপের আয়োজন করে। তবে সংলাপ থেকে প্রাপ্ত কোনো পরামর্শ এ পর্যন্ত ইসি কার্যকর করেনি তো বটেই, বরং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ [আরপিও] সংশোধন ও নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেওয়ার ব্যাপারে বর্তমান কমিশনের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা আছে। সর্বশেষ নির্বাচনের তিন মাস আগে যে কর্মশালার আয়োজন করল ইসি, তা থেকে প্রাপ্ত পরামর্শ আদৌ ইসি বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী কিনা, এ নিয়েও সংশয় আছে অনেকের।

অবশ্য সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বুধবারের কর্মশালায় বলেছেন, ‘জনগণ ধারণা করে, সরকারকে জেতাতে ইসি দস্তখত করে ফেলেছে। এতটা কাপুরুষ হইনি।’ সিইসির এই উচ্চারণে অনেকেই আশাবাদী হয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘সংকট আছে। ... এর মধ্যে অনেকগুলো সংকট নিরসন করতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে। নির্বাচন ভালো হবে কিনা, সেটা নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।’ [সমকাল, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২৩]

এবারসহ আগের প্রতিটি সংলাপে নির্বাচনকালীন সরকারে কোনো না কোনো পরিবর্তন আনার প্রস্তাব আসে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের এখতিয়ার ইসির নেই। তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা একটি যুক্তি সামনে নিয়ে এসেছেন– ইসি যদি মনে করে, নির্বাচনকালীন সরকার প্রস্তাবের বাস্তবায়ন না হলে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়, তাহলে তাদের দায়িত্ব বিষয়টি সরকারকে জানানো। কর্মশালায় ইসির প্রতি আরেকটি আহ্বান আসে। একটি কেন্দ্রে ভোটে অনিয়ম হলে এবং সেই অনিয়ম অস্ত্র ও পেশিশক্তির মুখে ঠেকাতে ব্যর্থ হলে প্রিসাইডিং অফিসার সেই কেন্দ্রের ভোট বাতিল করার এখতিয়ার রাখেন। একইভাবে সারাদেশের ভোটে অনিয়ম হলে এবং তা ঠেকাতে ব্যর্থ হলে সিইসিও সে ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারেন!

জাতীয় নির্বাচন সুরক্ষা বলয়ে রাখবার দায়িত্ব ইসির। তাই নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের এত প্রত্যাশা, বলা যায়– নির্বাচন আয়োজনের জন্য রীতিমতো ‘বজ্র আঁটুনি’ প্রত্যাশা– এর মধ্যে বাস্তবতার ফসকা গেরোগুলো ভুললে কি চলবে!

৩.

বড় দলটি নির্বাচনে না এলে বাকি ৩০০ দল নির্বাচনে এলেও তা অংশগ্রহণমূলক হবে না– এই যুক্তিগ্রাহ্য কথাটি বলছেন বিশিষ্টজন, সেই বড় দল বিএনপির আসলে নির্বাচনে আসবার প্রস্তুতি কী রকম? আর মাত্র দেড় মাসের মধ্যে তারা নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এক দফা আন্দোলন কীভাবে সফল করবে? সমকালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এই প্রশ্নের উত্তরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সরকার পতনে আমাদের এক দফার যুগপৎ আন্দোলন চলছে। ... তপশিল নিয়ে আমাদের চিন্তা নেই। ... আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকারের দাবি মেনে নিতে সরকারকে বাধ্য করব।’

২০১৪ ও ২০১৮– গত দুই সংসদ নির্বাচনের আগেও বিএনপির একই অবস্থান ছিল। নির্বাচন দুটো অংশগ্রহণমূলক হয়নি, এটি যেমন সত্য, এ-ও মিথ্যা নয় যে, দুটি নির্বাচনেই বিএনপি নেতৃত্বের কৌশলগত দুর্বলতা তাদের ভরাডুবি নিশ্চিত করে। প্রতিপক্ষ চাইবেই বিরোধী পক্ষকে নেতৃত্বশূন্য করে দিশেহারা করে তুলতে, উল্টোদিকে কৌশল ঠিক করা জরুরি– কোন পরিস্থিতিতে কোন কৌশল কাজে লাগবে! বছরের পর বছর স্থানীয় পর্যায়ের সকল নির্বাচন, মেয়র নির্বাচনসহ একের পর এক নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ওয়াকওভার দিয়ে বিএনপি নিজের ক্ষতি করেছে; আওয়ামী লীগের ‘নিজেরা করি’র পাল্টা কোনো কৌশলও দলটি উপস্থাপন করতে পারেনি।

২০১৪-তে নির্বাচন বয়কট করে নির্বাচনের মাঠ শূন্য করে কী পেয়েছে বিএনপি? ২০১৮-তে? এমনই এক জোট বাঁধল তারা, নির্বাচনের পরদিন থেকে সেই জোটের নেতারা কেউ কাউকে চিনলেন না! এর পর গত পাঁচ বছরে বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সরকারের মামলার সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ, এই বিপুল শক্তির দলটি নির্বাচন নিয়ে তারপরও অপ্রস্তুত! এর মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকারের পক্ষে গণআন্দোলনের লক্ষ্যে তারা ১৫ দিনের কর্মসূচির ডাক দিয়েছে; একের পর এক জনদুর্ভোগ, নিত্যপণ্যের লাগামছাড়া দাম, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-চাকরিসহ নানা খাতে সাধারণ মানুষের সীমাহীন কষ্ট-দুর্ভোগ কিংবা রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ইত্যাদি নিয়ে বিএনপি আদৌ আন্দোলন বা প্রতিরোধ গড়তে পেরেছে? সাফল্য পেতে হলে বিএনপিকে আত্মসমীক্ষায় দাঁড়াতেই হবে।

৪.

এবং বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও দেশের বাজারে তা বেড়েই চলেছে ‘ব্যবসায়ীরা লাভ করতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে একে লাভ করা বলে না, লুট করা বলে!’ বাজারে জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতাকে এক বন্ধু এভাবেই আখ্যায়িত করলেন। তাঁর যুক্তি, কথায় কথায় ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ দেখানো হয়। ডিমের দাম কেন লাফিয়ে ১৩ টাকায় পৌঁছুল? মুরগি কি সব ইউক্রেন চলে গেছে? সেখানে বসে ডিম পাড়ছে? দেশের মুরগি দেশেই তো আছে! ডিম আমদানিও করা হয় না। যাতায়াতের খরচ এমন কিছু বাড়েনি। তো ডিমের দাম কেন এত বাড়ল? আলু? যে আলু গতবারও কৃষকরা দামের অভাবে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছে, সেই আলুর কেন অগ্নিমূল্য?

সরকার এই অবস্থায় দাম বেঁধে লাগাম টানার ব্যবস্থা করেছে; অবশ্য তার সুফল ক্রেতা পর্যন্ত পৌঁছেছে, এমন খবর মেলে না। জেলা প্রশাসকরা বাজার তদারক করবেন বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। বাজার ব্যবস্থাপনায় ‘বজ্র আঁটুনি’ই দেখা যাচ্ছে। অবশ্য এর ‘ফসকা গেরো’ সম্পর্কে দামের চাপে পিষ্ট হওয়া সাধারণ মানুষ জানে না, এমনও নয়।

মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল ও সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com