- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- বৈশ্বিক অস্ত্র ব্যবসাকে খুশি রেখে বেপরোয়া মিয়ানমার
প্রতিবেশী
বৈশ্বিক অস্ত্র ব্যবসাকে খুশি রেখে বেপরোয়া মিয়ানমার

অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, মিয়ানমারের সামরিক সরকার মূলত রাশিয়া ও চীনের সমর্থন-সহযোগিতার ওপর দাঁড়িয়ে। দুই দেশের কাছ থেকেই সেখানকার সামরিক জান্তা পর্যাপ্ত সুরক্ষা পাচ্ছে। বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে। যুগান্তকারী ওই প্রতিবেদনে বিশদভাবে বলা হয়েছে, চীন ও রাশিয়া থেকে কী পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ ইতোমধ্যে মিয়ানমারে স্থানান্তরিত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে দীর্ঘকাল ধরে সামরিক শাসন চলছে; মাঝখানে বিজলির চমকের মতো কিছুদিন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থাকলেও বাকি বিশ্ব থেকে সার্বিক বিচ্ছিন্নতাই দেশটির ললাট লিখন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও দেশটির প্রতি বরাবর উদাসীন থেকেছে। প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান জেনারেলরা ক্ষমতায় আসার আগেও মিয়ানমারের জান্তাচক্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সমালোচনা থেকে সুরক্ষা পেয়ে আসছে।
এ প্রেক্ষাপটে গত সপ্তাহে জাতিসংঘের অধিকারবিষয়ক তদারকি সংস্থা ওএইচসিএইচআর ‘দি বিলিয়ন ডলার ডেথ ট্রেড: ইন্টারন্যাশনাল আর্মস নেটওয়ার্ক দ্যাট অ্যানাবল হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশন ইন মিয়ানমার’ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। সেখানে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার শিথিল প্রয়োগ হচ্ছে। সেই সুযোগে শীর্ষ সারির বিভিন্ন কোম্পানি নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে ধারাবাহিকভাবে অস্ত্র সরবরাহ করছে এবং শতকোটি ডলারের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এর জোরেই মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত থাকছে।
দেশটিতে বহু দশক পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক বাহিনী বন্দুকের নলের মুখে উৎখাত ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। মূলত তখন থেকে দেশটির জান্তা সরকার কী পরিমাণ এবং কী প্রকারে দেশের বাইরে থেকে মারণাস্ত্র পেয়েছে, তারই হিসাব তুলে ধরেছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি। এর আগে আর কোনো গবেষণায় এত বিশদভাবে বিষয়টির ওপর আলোকপাত করা হয়নি।
দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে উন্নত অস্ত্র সরবরাহকারীদের মধ্যে রাশিয়া ও চীনের অবস্থান বরাবরই শীর্ষে। অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশ দুটি যথাক্রমে ৪০০ এবং ২৬০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র সরবরাহ করেছে। এর বেশিরভাগ বাণিজ্য হয়েছে রাশিয়া ও চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে।
প্রতিবেদনটিতে প্রকাশ পায়, সিঙ্গাপুরের কয়েক ডজন সংস্থার মাধ্যমে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৫৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্র মিয়ানমারের সেনা শাসকদের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে। শত মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র স্থানান্তর বাবদ দাম পরিশোধ করা হয়েছে সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে। যদিও প্রতিবেদন অনুসারে, অস্ত্র সরবরাহ কাজের বেশিরভাগ সম্পন্ন হয়েছে সিঙ্গাপুরের বাইরে থেকে।
উল্লেখ্য, সিঙ্গাপুরের সরকারি নীতি হলো, ‘মিয়ানমারে অস্ত্র হস্তান্তর নিষিদ্ধ করা।’ এমনকি সিঙ্গাপুর এ সিদ্ধান্তও নিয়েছে, ‘সামরিক কাজে ব্যবহৃত হতে পারে এমন দৈনন্দিন ব্যবহার অর্থাৎ দ্বৈত ব্যবহারিক জিনিসপত্রও মিয়ানমারে স্থানান্তরের অনুমোদন দেওয়া হবে না। অথচ পরিহাসজনক হলো, চীনা ও রুশ অস্ত্র মিয়ানমারের জান্তার হাতে পৌঁছল সিঙ্গাপুরের ভূমি ও অবকাঠামো ব্যবহার করে। এ কারণে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক সিঙ্গাপুর সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে বাধা দিতে সম্ভব সর্বাধিক মাত্রায় তাদের নীতি প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং তার অস্ত্র ব্যবসায়ীরা খুঁজে বের করেছে, কীভাবে সিস্টেমটি নিয়ে খেলতে হয়। জান্তার সঙ্গে যুক্ত অস্ত্র ব্যবসায়ীরা শেল বা নামসর্বস্ব কোম্পানি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
গত ১১ এপ্রিল মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সাগাইং অঞ্চলের পাজি গি গ্রামে হামলায় ১৭০ জনকে হত্যা করে, যাদের মধ্যে ৪০ জন শিশু ছিল। এ হামলায় রাশিয়ার সরবরাহকৃত ইয়াক-১৩০ বিমান থেকে বোমা ফেলা হয়। এমআই-৩৫ টাইপ হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছুড়ে বেসামরিক মানুষ হত্যা করা হয়। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলা যায়, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছে রাশিয়ার বিক্রীত ৩৭০ ডলার মূল্যের অস্ত্রের মধ্যে ছিল এসইউ-৩০ ফাইটার জেট, মিগ-২৯ ফাইটার জেট, ইয়াক-১৩০ যুদ্ধবিমান এবং সামরিক বিমান বা হেলিকপ্টারের খুচরা যন্ত্রাংশ। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাশিয়ার ক্রমাগত অস্ত্র হস্তান্তর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কাছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করেছে।’
অভ্যুত্থানের পর থেকে, হংকংসহ চীনে অবস্থিত ৪০টিরও বেশি রাষ্ট্রচালিত এবং বেসরকারি সরবরাহকারী মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে ২৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দামের অস্ত্র ও উপকরণ দিয়েছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ফাইটার জেট, ফাইটার জেটের যন্ত্রাংশ, ট্যাঙ্ক এবং সামরিক হেলিকপ্টারের খুচরা যন্ত্রাংশ হস্তান্তরের মাধ্যমে চীনও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করেছে।’
মিয়ানমারের সঙ্গে অস্ত্র ব্যবসা এতটাই লাভজনক যে, ভারত ও থাইল্যান্ডের মতো দেশও দেশটির সামরিক বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে। ভারত মিয়ানমারে ৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের অস্ত্র এবং সামরিক-বেসামরিক উভয় কাজে ব্যবহারের সামগ্রী পাঠিয়েছে। থাইল্যান্ড পাঠিয়েছে ২৮ মিলিয়ন ডলারের খুচরা যন্ত্রাংশ এবং কাঁচামাল। সর্বশেষ অভ্যুত্থানের আগেও মিয়ানমার ১৯৬২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা প্রায় অর্ধশতাব্দী সামরিক শাসন সহ্য করেছিল। সেখানকার শাসকগোষ্ঠী শান নৃগোষ্ঠী এবং কারেন খ্রিষ্টান সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের নির্যাতন নিপীড়নে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
প্রশ্ন হতে পারে, এর সমাধান কী? নিষেধাজ্ঞাগুলো কঠোর করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো বৈদেশিক মুদ্রার মূল উৎসগুলোর দিকে যথেষ্ট লক্ষ্য করেনি, যা জান্তা সরকার অস্ত্র কেনার জন্য ব্যবহার করে। এ উৎসগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাষ্ট্রীয় সংস্থা মিয়ানমার তেল ও গ্যাস এন্টারপ্রাইজ।
অবশ্য, সম্পদসমৃদ্ধ দেশটিতে চীনের পাশাপাশি রাশিয়ার কৌশলগত স্বার্থ থাকার কারণে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে চাপ দেওয়া সহজ নয়।
জন জে মেজলার: ব্যাংকক পোস্টের জাতিসংঘ প্রতিনিধি; ভাষান্তর সাইফুর রহমান তপন
মন্তব্য করুন