
একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা ইসলাম। শান্তির ধর্ম ইসলামে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি অতিথি আপ্যায়নের প্রতিও অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মেহমানদারির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সব নবী ও রাসুলই অতিথিপরায়ণ ছিলেন। মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) আতিথেয়তায় ছিলেন অনন্য।
হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কাছে পুত্র হজরত ইসহাক (আ.)-এর জন্মের সুসংবাদ এবং তাঁর বংশে হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর আগমনের বার্তা নিয়ে কয়েকজন ফেরেশতা মেহমানরূপে এসেছিলেন। তিনি গরু জবাই করে তাঁদের জন্য মেহমানদারির আয়োজন করেছিলেন। বিষয়টি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সুরা হুদের ৬৯ আয়াতে এরশাদ হয়েছে: “আমার ফেরেশতারা সুসংবাদ নিয়ে ইব্রাহিমের কাছে গেল। তারা বলল ‘সালাম’। তিনিও বললেন, ‘সালাম’। তিনি অবিলম্বে একটি কাবাবকৃত গোবৎস পরিবেশন করলেন।”
অতিথি আল্লাহর রহমত নিয়ে আসেন ও তাঁর জন্য বরাদ্দ রিজিকই আহার করেন। অতিথির উছিলায় আল্লাহতায়ালা আমাদের রিজিক বৃদ্ধি করে দেন, বিপদ-আপদ দূর করেন। বান্দার ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়।
বাড়িতে মেহমান এলে তাঁকে হাসিমুখে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো মুমিনের বৈশিষ্ট্য। মেহমানকে স্বাগত জানানো মেজবানের দায়িত্ব। রাসুলে পাক (সা.)-এর কাছে কোনো মেহমান কিংবা প্রতিনিধি দল এলে তিনি স্বাগত জানাতেন। ‘মারহাবা’ বলতেন। এ বিষয়ে হাদিস শরিফে বর্ণিত, রাসুলে পাক (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের ওপর বিশ্বাস রাখে সে যেন মেহমানের প্রতি সদাচরণ করে।’ (সহিহ মুসলিম)
অতিথি বা মেহমানকে যথাযথ সম্মান করা, তাঁদের আপ্যায়ন করা ইসলামের বিধান। এক দিন এক রাত মেহমানের জন্য উত্তম ব্যবস্থাপনা করা ওয়াজিব। তিন দিন তিন রাত সাধারণ ব্যবস্থাপনা করা সুন্নত। এ বিষয়ে হাদিস শরিফে বর্ণিত, রাসুলে পাক (সা.) এরশাদ করেন, ‘মেহমানের সম্মান এক দিন ও এক রাত। আর সাধারণ মেহমানদারি তিন দিন ও তিন রাত। এর পরে তা হবে সদকা। মেজবানকে কষ্ট দিয়ে তাঁর কাছে মেহমানের অবস্থান করা বৈধ নয়।’ (সহিহ বুখারি)
হাদিস শরিফে বর্ণিত, একবার বনু গিফার গোত্রের এক লোক মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মেহমান হলেন। নবীজি (সা.) আগের দিন অভুক্ত ছিলেন। যেদিন মেহমান এলেন, সেদিন ঘরে ছাগলের দুধ ছাড়া আর কিছু ছিল না। নিজে অনাহারী হয়েও মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সেই মেহমানকে ছাগলের দুধটুকু খাওয়ালেন। কিন্তু অতিথিকে বুঝতে দিলেন না– তিনি ক্ষুধার্ত।
মেজবান ও তাঁর বাড়ির জন্য কিছু হাদিয়া বা উপহার নিয়ে যাওয়া মেহমানের জন্য সুন্নত। মেজবান যা আপ্যায়ন করাবেন তাতে সন্তুষ্ট থাকা সুন্নত। খাবারের দোষ বর্ণনা না করা এবং আপ্যায়নের ত্রুটি না ধরা সুন্নত। এমন কোনো আচরণ না করা, যাতে মেজবান বিরক্ত বা বিব্রত হন।
মেহমানের দায়িত্ব দৃষ্টি সংযত ও অবদমিত রাখা।
খাবার শেষ হলে মেহমান এ দোয়া পাঠ করবেন– আল্লাহুম্মা বারিক লাহুম ফিমা রাজাকতাহুম ওগফির লাহুম ওয়ারহামহুম। অর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনি তাঁদের রিজিকে বরকত দান করুন, তাঁদের ক্ষমা করুন এবং তাঁদের ওপর অনুগ্রহ করুন। (মুসলিম)
খাবার শেষ হলে মেহমানের কোনো কাজ না থাকলে চলে যাবেন। অহেতুক বসে থেকে মেজবানের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করবেন না। মহানবী (সা.)-এর এক ঘটনা বর্ণনা করে আল্লাহতায়ালা সুরা আহযাবের ৫৩ আয়াতে এরশাদ করেন– খাওয়া-দাওয়া শেষে তোমরা চলে যাও। তোমরা কথাবার্তায় মশগুল হয়ে পড়ো না। কারণ তোমাদের এই আচরণ নবীকে পীড়া দেয়। সে তোমাদের উঠিয়ে দিতে সংকোচ বোধ করে।
মেহমানকে হাদিয়া বা উপঢৌকন দেওয়াও সুন্নত। মেহমানদারিতে অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য বিনীতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করা, মেহমানের কাছে দোয়া চাওয়া।
ইসলামে অতিথি আপ্যায়নের এ শিক্ষা ধরে রাখতে আমাদের সবাইকে আরও আন্তরিকতার পরিচয় দিতে হবে। তাহলেই আমাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও পারস্পরিক বন্ধন আরও সুদৃঢ় হবে, ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন। আমিন।
ড. মো. শাহজাহান কবীর: চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
বিষয় : ইসলাম ও সমাজ মো. শাহজাহান কবীর
মন্তব্য করুন