পৃথিবীর দ্রুততম প্রাণী হিসেবে চিতার স্বীকৃতি ও সম্মান সর্বজনস্বীকৃত। গত শতকের আশির দশকেও বিশেষত তিন পার্বত্য জেলার বনাঞ্চলে এর দেখা মিলত। নানা কারণে আজ তা বিরলপ্রায়। ফলে চিতার দর্শনও বিরল হয়ে পড়েছে বাংলাদেশে। তবে বনের চিতা গেলেও আমাদের আছে আরেক চিতা, ইদানীং যাকে নিয়ে জনপরিসরে বেশ চর্চাও হচ্ছে। এই চিতা জঙ্গলের চিতা নয়; এলিট বাহিনী র‍্যাবের এক সহযোগী; বৈশিষ্ট্য কিংবা পরিচয়ে যে কুকুর বা সারমেয় গোত্রীয়। এই সারমেয় শাবক দুর্যোগ মোকাবিলায় বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০ মার্চ বাহিনীটির ১৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে র‍্যাবের মহাপরিচালক পদক পেয়েছে।

চিতার বয়স ৩ বছর ১ মাস। ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে ল্যাব্রাডর জাতের এ কুকুরটির জন্ম। তার বাবা-মা যুক্তরাজ্যের। সাত বছর আগে ইংল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসে র‌্যাবের ডগ স্কোয়াড। চিতারা তিন ভাই। তার দুই ভাইয়ের নাম টাইগার ও প্যান্থার। ‘চিতা’ মূলত র‍্যাবের ডগ স্কোয়াডের অন্যতম সদস্য। বহু বছর ধরেই ডগ স্কোয়াডের কুকুরগুলো নানা রকম উদ্ধার কার্যক্রম, অপরাধ তদন্ত কিংবা নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কাজ করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় ‘চিতা’ সম্প্রতি অংশ নিয়েছিল রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিস্ফোরণ-পরবর্তী উদ্ধারকার্যে। এই ভয়ংকর বিস্ফোরণে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে। উদ্ধারকাজের মধ্যে অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল মরদেহ খুঁজে বের করা। এ বিষয়ে ‘চিতা’কে জন্মের পর থেকেই নানা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল সুনিপুণভাবে। আর সে যেন তার প্রশিক্ষণের পূর্ণতা দেখাতেই এই উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিল দুর্দান্তভাবে। ধ্বংসস্তূপের নিচে থাকা তিনটি মৃতদেহকে খুঁজে বের করেছিল ‘চিতা’। উদ্ধারকাজের এই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘চিতা’ পাচ্ছে ‘মহাপরিচালক পদক’। বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘ডগ স্কোয়াড’-এর পদকপ্রাপ্তি কিংবা স্বীকৃতি এই প্রথম।

মানুষ হিসেবে সব সময় আমরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলেই দাবি করে থাকি। এই দাবির চূড়ান্ত রূপ দিতেই অন্যান্য প্রাণীকে হেয় বা অবজ্ঞা করার প্রবণতা একদম মজ্জাগত ব্যাপার যেন। অথচ আমরা ভুলে যাই, মনুষ্যরূপী বহু মানুষের চেয়ে এই প্রাণিকুল অনেক ক্ষেত্রে উপকারী ও গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া নানা ধরনের কৃত্রিম দুর্যোগের প্রায় সবই কোনো না কোনোভাবে ‘মানুষ’-এর হাতেই ঘটেছে। মানুষ ছাড়া অন্যান্য জীব প্রকৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটিয়ে প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়েই চলেছে যুগের হাত ধরে। এর মধ্যে সারমেয় প্রজাতিটি নানাভাবেই মানুষের অগ্রগতির ইতিহাসে অবদান রেখে চলেছে একনিষ্ঠভাবে।

১৯৫৭ সালে স্পুটনিক ২-এর অভিযান হয়েছিল। অর্ধশত বছর পার করেও মানব ইতিহাসে এই অভিযানের একমাত্র অভিযাত্রী হিসেবে ‘লাইকা’ আজও স্মরণীয় নাম। এই ‘লাইকা’ও ছিল একটি কুকুর। মানবের চন্দ্রাভিযানের গল্প যতবারই আসবে, ততবার ‘লাইকা’ উঠে আসবে ইতিহাস থেকে। তেমনি অনেক বছর পরও ‘চিতা’ বেঁচে থাকবে বাংলার মানুষের ইতিহাসে তার বীরত্বের জন্য।

চিতার আগেও ডগ স্কোয়াডের অনেক কুকুর নানা উদ্ধারকাজ করেছে বীরত্বের সঙ্গে। তাদের কাজ বা অবদানের স্বীকৃতি সেভাবে কখনোই পায়নি। হয়তো এমন ধারণা ছিল– কুকুরের আবার স্বীকৃতি কী? এই চিন্তার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয়, নিজেদের ছাড়া অপরাপর প্রাণীর প্রতি দায়িত্ব এবং তাদের কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার উদার মানসিকতার অভাব রয়েছে। আর এই মানসিকতার দীনতা ক্রমে সংকীর্ণ করে দেয় ব্যক্তির চিন্তা ও তার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিকে। চিন্তার সংকীর্ণতা আর যা-ই করুক, কাউকে বড় ও মহান করে তুলতে পারে না।

এমতাবস্থায় সারমেয় শাবক ‘চিতা’র এই বীরত্বগাথার স্বীকৃতি আমাদের মনে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার ঘটায়; চিন্তার গণ্ডির ক্ষুদ্র সীমা ছাড়িয়ে আমরা হয়তো সক্ষম হচ্ছি অন্যদের নিয়ে ভাবতে। একা বেঁচেবর্তে থাকার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে যত বেশি সামগ্রিক জীবনের দিকে মুখ তুলে তাকানো যায়– সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি ততই মানবিক হয়ে ওঠে। এর মাধ্যমেই মানুষ জীবজগতে নিজের উন্নত অবস্থান দাবি করতে পারে।

জোহরা ঝুমু: লেখক