
নাসের এজাজ বিজয়, সিইও, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, বাংলাদেশ এবং প্রেসিডেন্ট, এফআইসিসিআই
সমকাল: নতুন অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন শুরু হলো। ব্যবসা-বাণিজ্যে বাজেটের প্রভাব কেমন হবে?
নাসের এজাজ: বৈশ্বিক এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট দেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি, মোটা দাগে বাজেটটি ব্যবসাবান্ধব। তবে কিছু জায়গায় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। প্রথমেই উল্লেখ করতে চাই, এনবিআর চেয়ারম্যান দীর্ঘ সময় ধরে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) বাজেট প্রস্তাবনা শুনেছেন। বাজেটে আমাদের সংগঠনের বেশ কিছু প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করায় আমরা সরকারকে বিশেষত এনবিআর চেয়ারম্যান এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টাকে বিশেষ ধন্যবাদ দিতে চাই। আমরা সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ, ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডে (ডব্লিউপিপিএফ) কোম্পানির অবদানের ওপর কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছিল, যা অর্থবিল পাসের সময় প্রত্যাহার করা হয়েছে। অন্যদিকে করপোরেট কর কমানোর শর্ত হিসেবে সর্বোচ্চ ১২ লাখ টাকা নগদ লেনদেনের শর্ত সংশোধন করে ৩৬ লাখ টাকা করা হয়েছে। এই সংশোধনও ইতিবাচক। কিন্তু এতে সবাই হ্রাসকৃত করপোরেট করের সুবিধা নিতে পারবে না। কারণ অনেককেই বাস্তব কারণে এর চেয়ে বেশি নগদ লেনদেন করতে হয়। এর ফলে কার্যকর করের হার বেড়ে যাবে। আমরা মনে করি, কোম্পানির টার্নওভার এবং ব্যয়ের শতাংশ হিসেবে নগদ লেনদেনের সীমা থাকা উচিত। কেননা কারও ব্যবসা অনেক বড়, কারও ছোট। আমাদের প্রস্তাব ছিল টার্নওভারের ৫০ শতাংশ এবং ব্যয়ের ১০ শতাংশ নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেনের সুযোগ থাকা উচিত। আমরা চাই, ক্যাশ লেনদেন কমে আসুক। তবে তা রাতারাতি বাদ দেওয়া সম্ভব হবে না। এর জন্য আরও অনেক প্রস্তুতি দরকার। আমাদের সুপারিশ হলো- অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য অর্জনে একটি কার্যকর পন্থা এবং নগদ লেনদেন ক্রমান্বয়ে কমানোর জন্য একটি কার্যকর রোডম্যাপ থাকা উচিত।
সমকাল: নতুন অর্থবছরের আউটলুক বা দৃশ্যকল্প আপনার কাছে কেমন মনে হয়?
নাসের এজাজ: এ মুহূর্তে তিনটি ইস্যু নিয়ে উদ্বেগ আছে- মূল্যস্ফীতি, মুদ্রার বিনিময় হার এবং সুদের হার। তিনটির মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। আমার প্রথম সুপারিশ, সুদের হার এবং বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। ডলারের দর কৃত্রিমভাবে ধরে রাখতে গেলে বাজারে এমন স্পেকুলেশন থাকবে যে, আরও হয়তো বাড়বে। বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে আমদানি ব্যয় আরেকটু বাড়বে। তবে একটা পর্যায়ে ব্যয়বৃদ্ধিজনিত কারণে অনেক পণ্যের চাহিদা কমবে। তখন আমদানি কম হবে। অন্যদিকে রপ্তানি আরও প্রতিযোগী সক্ষম হবে। আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স উৎসাহিত হবে। বাজারকে ভূমিকা পালন করতে দিলে এক পর্যায়ে 'ইকুলিবিরিয়াম লেভেল' চলে আসবে। অন্যদিকে সুদের হার কৃত্রিমভাবে ধরে রাখলে অপ্রয়োজনীয় ঋণ তৈরি হবে। সারাবিশ্বে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য এখন সুদের হার বাড়ানো হচ্ছে। সুদের হারে সীমা থাকায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসএমই খাত। ঋণে ৯ শতাংশে সীমা এবং আমানতে মূল্যস্ফীতির সমান সুদহার দেওয়ার শর্ত থাকায় নতুন ঋণ বিতরণে স্প্রেড ২ শতাংশের নিচে আসবে। এর ফলে ব্যাংকগুলো পরিচালন ব্যয় কমাতে বড় গ্রাহকদের ঋণ দেওয়ায় উৎসাহ দেখাবে। এসএমইর দিকে তাদের মনোযোগ কমবে।
সমকাল: সামষ্টিক অর্থনীতির বর্তমান চাপ মোকাবিলায় আমাদের কী করতে হবে?
নাসের এজাজ: দেখুন, বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী ৬ মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ (ক্রিটিক্যাল)। ফলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার এবং বেসরকারি খাতকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। এরই মধ্যে অনেক দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে খাদ্য কেনার বাইরে অন্য পণ্যের চাহিদা কমবে। এ বিবেচনায় আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অর্ডার থাকতে পারে, কিন্তু শিপমেন্ট দেরি হতে পারে। ফলে রপ্তানিতে বর্তমানের প্রবৃদ্ধি নাও থাকতে পারে। এ অবস্থায় খুব প্রয়োজনীয় নয় এমন পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করতে হবে। অন্তত ৬ মাসের জন্য বড় ধরনের ব্যয় সংকোচনের দিকে যেতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, স্থানীয় চাহিদা বাড়ায় এমন প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দিয়ে কম অগ্রাধিকারের প্রকল্প স্থগিত রাখা যেতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে কম সুদের বিদেশি ঋণ একটু বেশি করে নিয়ে রাখা যেতে পারে। কেননা এখনও আমাদের ঋণ-জিডিপি অনুপাত অনেক কম এবং ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার রেটিং ভালো।
সমকাল: নতুন অর্থবছরে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা কেমন যাবে বলে মনে করছেন?
নাসের এজাজ: ব্যাংকিং খাতের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং বছর হবে। ভেবেছিলাম, কভিড মনে হয় চলে গেছে। কিন্তু আবার সংক্রমণ শুরু হয়েছে। এতে করে ব্যাংক খাতের ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে যে মরেটোরিয়াম বা বিশেষ ছাড় ছিল, তার সময় বাড়ানো হয়েছে। যখন এই মরেটোরিয়াম চলে যাবে, তখন অনেকেই ঠিকমতো ঋণ পরিশোধ করতে চাইবে না। কারণ অনেকের এ সময়ে পরিশোধের অভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। দীর্ঘ সময় ঋণ অনাদায়ী থাকলে ব্যাংকিং খাতের সংকট আরও বাড়বে। অন্যদিকে বাজেটে ক্রেডিট কার্ড এবং ৫ লাখ টাকার বেশি ঋণ আবেদনের জন্য ট্যাক্স রিটার্নের প্রমাণ দাখিলের যে শর্ত দেওয়া হয়েছে, তাতে ব্যাংকের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমরা কর প্রতিপালন বাড়াতে নীতিগত দৃষ্টিকোণ থেকে এ পদ্ধতিকে সমর্থন করি। কিন্তু ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে ধীরে ধীরে হ্রাসের পদ্ধতি গ্রহণের প্রস্তাব করছি এবং অন্তত এর ভেরিফিকেশনটা জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো একটা পোর্টালের মাধ্যমে করা হোক। একটা অনলাইন ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাংক শুধু জানতে পারবে যে, গ্রাহক রিটার্ন দাখিল করেছেন। কারণ অনেকই আছেন তাঁরা কত কর পরিশোধ করেছেন, তা ব্যাংকে জমা দিতে চাইবেন না।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাকির হোসেন
মন্তব্য করুন