
শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর একটি জ্বালানি স্টেশনে রোববার তেল কেনার জন্য গাড়ির দীর্ঘ লাইন। রেকর্ড মুদ্রাস্ম্ফীতি, খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের ঘাটতির কারণে দেশটির ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে -এএফপি
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট দ্বীপরাষ্ট্রটিতে সহিংসতার বিস্ম্ফোরণ ঘটিয়েছে। দেশটির সরকার সংখ্যালঘু তামিল এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ না করলে এই সহিংসতার শেষ হবে না। ক্রমবর্ধমান সামরিক বাজেটও দেশটিকে ব্যাপকভাবে পিছিয়ে দিয়েছে, বাড়িয়েছে দুর্ভোগের মাত্রা।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী বর্ণবাদী মতাদর্শ ধারণ করেছে। তারা সুশীল সমাজ ও অর্থনীতির কেন্দ্রে অনুপ্রবেশ করেছে এবং নাগরিকদের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে দমন করেছে। বিশেষ করে দেশটির উত্তর-পূর্বে সংখ্যালঘু অসিংহলি জনগোষ্ঠী যেমন তামিল এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে তারা নির্মমতা চালিয়েছে।
২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর যখন প্রেসিডেন্ট পদে গোটাবায়া রাজাপাকসে শপথ নেন তখন কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেনি যে এক সময় তার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ হবে। সাবেক এই প্রতিরক্ষামন্ত্রী তার নির্বাচনী প্রচারণায় সামরিক পরিচয়ের সঙ্গে চরম সিংহলি জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়েছিলেন।
গোটাবায়া ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে বলেছিলেন, 'এটা কোনো গোপন বিষয় নয় যে আমাকে যারা ভোট দিয়েছে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই সিংহলি। তারা আমাকে সমর্থন করেছিল কারণ তাদের যুক্তিসংগত ভয় ছিল সিংহলি জাতি, আমাদের ধর্ম, জাতীয় সম্পদ এবং ঐতিহ্য ধ্বংস করা হতে পারে। বিচ্ছিন্নতাবাদ, চরমপন্থা এবং সন্ত্রাসবাদকে সমর্থনকারী বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি শক্তি এবং মতাদর্শ এ কাজ করতে পারে।'
তিনি তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানজুড়ে বারবার আগের প্রশাসনকে আক্রমণ করেন এই বলে যে, তারা মুসলিম এবং তামিলদের প্রতি অতি সমঝোতামূলক ছিল। শ্রীলঙ্কায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানের জন্য ২০১৫ সালের জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল প্রস্তাব গ্রহণ করলে তিনি তার সমালোচনা করেন। রাজাপাকসেরা দাবি করেন, জবাবদিহিতার প্রতি এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় নিরাপত্তাকে বিপন্ন করবে। ২০১৯ সালের ইস্টার সানডেতে বোমা হামলায় ২৬৯ জনের মৃত্যু হলে তাকে সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেন রাজাপাকসেরা। ইসলামপন্থি চরমপন্থি গোষ্ঠী এ হামলা চালালেও মুসলিমবিদ্বেষ উস্কে দেন তারা।
এর জেরে ২০২০ সালের আগস্টের নির্বাচনে গোটাবায়া রাজাপাকসের দল সংসদীয় নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন। এরপর দেশটির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও সুদৃঢ় করেন।
সিংহলি জাতীয়তাবাদ এবং টেকনোক্র্যাট সামরিক শাসনের প্ল্যাটফর্মে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পর তিনি দ্রুততার সঙ্গে তার ক্ষমতাকে আরও মজবুত করেন। তিনি সামরিক কমান্ডারদের মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদ দেন। রাজাপাকসে শ্রীলঙ্কার সংবিধানের বিংশতম সংশোধনী পাস করে প্রেসিডেন্ট পদকে নির্বাহী ক্ষমতা দেন। ফলে গণতান্ত্রিক সুরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। আগের সরকারগুলোর ধারাবাহিকতায় তিনিও সামরিক বাজেট বাড়িয়ে দিতে থাকেন। তার স্বৈরাচারী শাসনের ফলে বর্তমান সংকট সৃষ্টি হয়।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি গ্রাস করে সামরিক বাহিনী ক্রমশ স্ম্ফীত হয়েছে। তামিল বিদ্রোহীদের অজুহাত দেখিয়ে একে ন্যায্যতা দেওয়া হয়। চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা এবং তারপর মাহিন্দা রাজাপাকসের শাসনে সামরিক ব্যয় আরও বাড়ানো হয়।
সিংহলি জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়ে ২০০৫ সালে মাহিন্দা রাজাপাকসে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন। দেশটি তখন তামিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে ছিল। তা সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কা দ্রুত তার সামরিক সম্প্র্রসারণ করেছিল। ২০০৫ সালে দেশটির সৈন্য সংখ্যা ছিল এক লাখ ২০ হাজার। তবে ২০০৯ সালে এই সংখ্যা ৩ লাখে পৌঁছায়।
শ্রীলঙ্কার নেতারা দীর্ঘদিন ধরে একমত হয়েছিলেন যে সশস্ত্র সংঘাত শুধু সামরিক বিজয়ের মাধ্যমেই শেষ হবে। এরপর সশস্ত্র সংঘাতের অবসান ঘটলেও শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী এখন সংখ্যায় ব্রিটেনের প্রায় দ্বিগুণ। ২০২২ সালের জন্য শ্রীলঙ্কার জাতীয় বাজেটের ১২.৩ শতাংশ সামরিক খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে।
গোটাবায়ার শাসনামলে কাস্টমস, বন্দর কর্তৃৃপক্ষ, উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং এমনকি মহামারি সামাল দেওয়ার দায়িত্বও জেনারেলদের ওপর দেওয়া হয়। শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী এখন বিলাসবহুল হোটেল এবং রিসোর্টের পাশাপাশি অসংখ্য গলফ কোর্স, এয়ারলাইন্স এবং প্রকৃতি সংরক্ষণাগার পরিচালনা করছে। সশস্ত্র সংঘাতের অবসানের ১৩ বছর পরও শ্রীলঙ্কার সামরিক খাতে অপ্রতিরোধ্য সরকারি ব্যয় বন্ধ হচ্ছে না। সূত্র : তামিল গার্ডিয়ান।
মন্তব্য করুন