
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭-১৪ মে ২০২০)
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যার যখন প্রয়াত হন তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলছিল ভয়াবহ করোনাদুর্যোগ। আমরাও এর বাইরে ছিলাম না। ২০২০ সালের ১৪ মে শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমান পরপারে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তর-পর্বে মুক্তিযুদ্ধ অর্থাৎ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের এই প্রতিটি অধ্যায়ের সঙ্গেই তিনি ছিলেন যুক্ত। স্বাধীনতা-উত্তর দেশে প্রায় প্রতিটি গণতান্ত্রিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাঁকে আমরা সবসময় অগ্রভাগে দেখেছি। তাঁর পরামর্শ ও পথনির্দেশনা আন্দোলনকারীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। স্বাধীন দেশে ড. কুদরাত-এ-খুদা জাতীয় শিক্ষা কমিশনের তিনি ছিলেন সদস্য। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা তাঁর বিশেষ উল্লেখযোগ্য কাজ। শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য দেশ-বিদেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদকধারী, সম্মাননাপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কর্মময় অধ্যায় আমাদের সামনে হয়ে আছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
দেশের সীমানার বাইরেও তিনি তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলো ছড়িয়েছিলেন। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট ডিগ্রি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক ও দুইবার আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃক প্রদত্ত আনন্দ পুরস্কার তাঁর জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার ব্যাপ্তিই তুলে ধরেছে। তিনি ওপার বাংলায় জন্মগ্রহণ করলেও স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই চলে আসেন এই ভূখণ্ডে। শিক্ষাজীবন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁর কর্মজীবন। কর্মসূত্রে কিছুকাল কাটে তাঁর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও কিন্তু পরে আবার ফিরে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইমেরিটাস অধ্যাপক ছিলেন সেখানেই। শিক্ষা ও শিক্ষকতা জীবনে তিনি আলো ছড়িয়েছেন তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করে। আমরা অনেকই জানি, তিনি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ (কলকাতা), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন।
ত্রৈমাসিক পত্রিকা 'যামিনী' এবং মাসিক শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক ম্যাগাজিন 'কালি ও কলম'-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর আশি-ঊর্ধ্ব বছর জীবনের কর্মময় অধ্যায়গুলোই বলে দেয় তাঁর জীবন কত বর্ণাঢ্য ছিল। তাঁর প্রায় ২০টি ইংরেজি-বাংলা গবেষণা গ্রন্থ গবেষণার ক্ষেত্রে অনন্য সহায়ক হয়ে আছে। ইংরেজি-বাংলায় রয়েছে বেশ কিছু যৌথ সম্পাদনা গ্রন্থও। সমাজ, নারী এবং কালের খণ্ড খণ্ড চিত্রও চিত্রিত হয়েছে তাঁর ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থে। আমার মনে পড়ছে, সম্ভবত তাঁর ৮০তম জন্মদিনে আমাদের আরেক প্রয়াত নক্ষত্রসম কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ হাসান আজিজুল হক 'বন্ধুবৎসল আনিসুজ্জামান' শিরোনামে একটি নিবন্ধ সমকালের এই কলামেই লিখেছিলেন। তিনি তাঁর অগ্রজ অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে যেভাবে মূল্যায়ন করেছেন তা শুধু একজন বড়মাপের মানুষের পক্ষেই সম্ভব অন্য আরেক বড় মানুষকে এভাবে মূল্যায়ন করা।
হাসান আজিজুল হক ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান দু'জনেরই জন্ম ওপার বাংলায়। হাসান আজিজুল হক ওই নিবন্ধে লিখেছিলেন, 'বাংলাদেশে দৃষ্টান্তযোগ্য, অনুসরণযোগ্য মানুষের সংখ্যা ক্রমেই কমছে। কিন্তু আমাদের মাঝে একজন আনিসুজ্জামান এখনও সচল আছেন অনুসরণযোগ্য হিসেবে। আমি আজ কৃতজ্ঞচিত্তে এ কথাটা উল্লেখ করতে চাই, তাঁকে নিয়ে আমি যা লিখেছি আমাকে নিয়ে তিনি লিখেছেন এর চেয়ে অনেক বেশি।' কী বিনয়, কী মহত্তের প্রকাশ! স্বীকার তো করতেই হবে আমাদের সমাজ ও সমকাল উভয়ের জন্যই অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও হাসান আজিজুল হকরা অনুসরণযোগ্য হয়েই থাকবেন। তাদের সৃষ্টি থেকে আমরা যাব আরও সৃষ্টির পথে তাঁদের শ্রদ্ধায় ধারণ করে।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের আদর্শ ও জীবনকর্ম আমাদের গর্বিত করে। দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম অগ্রবর্তীজন আনিসুজ্জামানের অর্জনের ঝুলি পূর্ণ। দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক দায়িত্বভার তাঁর ওপর বর্তেছে এবং সব ক্ষেত্রেই তিনি নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে কর্মযজ্ঞ চালিয়েছেন, সম্পন্ন করেছেন দায়িত্ব। আনিসুজ্জামান স্যার সৃষ্টিশীলতা-সৃজনশীলতার পথে হেঁটে গেছেন দৃঢ়-দৃপ্ত পায়ে। একজন গুণী মানুষের পূর্ণাঙ্গতা নিয়ে তিনি যে আলো ছড়িয়ে গেছেন তা আমাদের যুগ যুগ অনুপ্রাণিত করবে। মুক্তচিন্তক, বহুত্ববাদী, সংস্কৃতজন, ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক ও প্রগতিশীল চিন্তাস্নাত এই জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবানকে আমরা যত বেশি চর্চায় রাখব ততই সমৃদ্ধ হবো। বরাবর নীতিনিষ্ঠ অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে এই ছোট্ট পরিসরে লিখে শেষ করার অবকাশ আছে কি? অন্তত আমার কাছে তা মনে হয় না। কারণ যাঁর কর্মের খ্যাতি এত বিস্তৃত তাঁকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে পূর্ণাঙ্গভাবে তুলে আনা দুরূহ।
বহুগুণের অধিকারী আনিসুজ্জামানের জীবনের চরিতার্থতা দেওয়ার জন্য একত্রযোগের এই সমাহার বিরল। পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের মাধ্যমে আনিসুজ্জামান তৎকালীন খ্যাতিমান লেখক, সাহিত্যিক, কবিদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার যে সুযোগ পেয়েছিলেন এবং নিজেও তখন থেকেই যেভাবে লেখালেখিতে নিমগ্ন হন এর বহুমুখী সুফলভোগী আমরা। এ কারণেই তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁকে নিয়ে বিশদ গবেষণা ও চর্চার সূত্রপাত। তাঁকে নিয়ে আমার অতলান্ত অনুভূতি অবিরত প্রকাশ হতে থাকলেও শেষ হবে না। আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে আমার সরাসরি কাজের সংযোগ হয় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন রচনাবলির সম্পাদনার সূত্রে। স্যারের সৌজন্য আমাকে বিশেষভাবে শিখিয়েছে কীভাবে বিনয়ের সঙ্গে কাজের মর্যাদা রাখতে হয়। স্যারের সঙ্গে যখন নিবিড়ভাবে কাজ করতে শুরু করি, তখন নানা কারণেই আমার বিস্ময় জেগেছে। এই বিস্ময়ের কারণ স্যারের বিনয়ী আচরণ, জ্ঞানের ব্যাপ্তি ও তার অনুসন্ধিৎসুতা।
আমার পুরো শিক্ষাজীবন কেটেছে রাজশাহীতে। প্রিয় রাজশাহী আমার আমি হয়ে ওঠার শহর। ষাটের দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হই। তখন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ক্লাসে পড়ানোর সময় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের 'মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য' বইটির বিভিন্ন অংশ উল্লেখ করেন। তিনি নানা ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণে বইটি সম্পর্কে আমাদের বলেন। তখন থেকেই অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে ভালো করে জানা শুরু হয়। দেশ-বিদেশের বিদ্বজ্জন আনিসুজ্জামান স্যারের মানবিক বোধ ও পাণ্ডিত্যকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখেছেন। এই বিশিষ্টতায়ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান নন্দিত এবং বরণীয়। তিনি ছিলেন একজন পূর্ণ আধুনিক মানুষ। আধুনিকতার প্রতিটি বিষয় তাঁর চরিত্রের ভেতরে গভীরভাবে বিরাজিত।
আমি মনে করি যে কেউ তার সৃষ্টি থেকে নিতে পারেন আধুনিকতার পাঠ। এর জন্য শ্রেণিকক্ষের দরকার নেই। তাঁর রচনাভান্ডার থেকেই এই শিক্ষা নেওয়া যায়। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার স্তরে স্তরে রেখেছেন মেধার উজ্জ্বল স্বাক্ষর। তিনি আজ আমাদের মাঝে শারীরিকভাবে নেই বটে, কিন্তু তার জীবনদর্শনের বিষয়টি চর্চা করলে বর্তমান প্রজন্মের মাঝে চেতনাবোধ সমৃদ্ধ হবে। আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তাঁকে আমাদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখব জীবন পরিচর্যার বাতিঘর করে।
সেলিনা হোসেন: কথাসাহিত্যিক ও সভাপতি, বাংলা একাডেমি
মন্তব্য করুন