
১৯৯২ সালে কলকাতায় আর্ট ক্যাম্পে বাঁ থেকে বসা শিল্পী মাহমুদুল হক, শিল্প সমালোচক সন্দীপ সরকার, শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ এবং কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
চারদিকে আন্দোলন। মানুষ স্বপ্ন দেখছে নতুন কিছু পাওয়ার। এমন সময় ১৯৬৮ সালে ঢাকায় আর্ট কলেজে (চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হই। এ সময় থেকেই আমি শিল্পী মাহমুদুল হককে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে যাই। প্রথমে তিনি আমাদের শিক্ষক; এর পর বন্ধু। এমন যুগলবন্দি সম্পর্ক সত্যিই আনন্দের। শিল্পী হিসেবে তার অবদান নিয়ে আরও অনেকে বলবেন। অবশ্য তিনি আমাকে মাঝেমধ্যে তার কাজ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। তার সঙ্গে এসব নিয়ে আমার আলাপও হয়েছে। বরং আমি তার সম্পর্কে ভিন্ন কিছু বলতে চাই।
আমার মনে পড়ে সেই সময়ের কথা। আমাদের শিক্ষক ও শিল্পী মাহমুদুল হক আর্ট কলেজের করিডোরে নিজের করা ছাপচিত্র দেখাচ্ছিলেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ ও শিল্পী আনোয়ারুল হক। তখনই আবুল বারক আলভী মানে আমাদের আলভী ভাইকে প্রথম দেখলাম। সদ্য তারা পাকিস্তান থেকে প্রদর্শনী করে ফিরেছেন। দ্বিতীয় বর্ষে আমরা শিক্ষক হিসেবে শিল্পী রফিকুন নবীকে পাই। এর পরও বলি, শিক্ষক হিসেবে শিল্পী মাহমুদুল হক ছিলেন অনেক আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান।
বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার পর রাজনৈতিক কারণে মাহমুদুল হককে আরেকভাবে দেখার সুযোগ হয়। তখন আমি আর্ট কলেজের ভিপি। নানা কাজের সঙ্গে জড়িত। মাহমুদুল হকের কাছে কোনো অনুরোধ নিয়ে গেছি কিংবা কাউকে পাঠিয়েছি; তিনি ফিরিয়ে দেননি। আমার অনুরোধ তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে রেখেছেন। এমন অনেক অনুরোধই রেখেছেন তিনি। এমন চরিত্র ও উদারতা একজন শিল্পী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে খুব দরকার।
১৯৮১ সালে প্রথমবারের মতো ঢাকায় এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্যারিস থেকে আমি ঢাকায় এসেছি। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। নিজের মন আমার তখনও স্বাভাবিক হয়নি। প্রদর্শনী উপলক্ষে ঢাকায় পাকিস্তান থেকে একটি দল এসেছে। শিল্পী মাহমুদুল হক আমাকে নিয়ে গেলেন। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, আমার মধ্যে শিল্পী হয়ে ওঠার চেষ্টা ছিল। এ কারণেই বোধ হয় তিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। এ সময় ওইখানে ছিলেন সফিউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়াসহ অনেকে। তখন চেয়ারে বসা ছিলেন পাকিস্তান থেকে আসা দলটির নেতৃত্ব দেওয়া এক ভদ্রমহিলা। মাহমুদুল হক আমাকে চা পান করতে ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে বসতে বললেন। এ কথা শুনে রাগে আমার কান গরম হয়ে গেল। বললাম, আমি চললাম। এখানে আমি থাকব না। খুব রেগে গিয়ে হাত দিয়ে টেবিলে জোরে থাপ্পড় দিলাম। আরও বললাম, আমি মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি, তাদের সঙ্গে আলাপ হতে পারে না। এসব কথার মধ্যেও মাহমুদুল হক আমাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। আমি তার সঙ্গে কথা না বলে ওইখান থেকে চলে এলাম। ওই বছরই ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমিতে আমার একক চিত্রপ্রদর্শনী হচ্ছে। শিল্পী মাহমুদুল হক আমার প্রদর্শনী দেখতে এলেন। অনুতপ্ত হলেন। তিনি আমার জীবনসঙ্গিনী আনা ইসলামের বোন শিল্পী আতিয়া ইসলাম অ্যানির শিক্ষক। আনার সঙ্গে আমার বিয়ের উকিল বাবাও তিনি ছিলেন। এই ছিলেন আমাদের মাহমুদুল হক।
২০০০ সালে তৎকালীন ফ্রান্সের বাংলাদেশস্থ রাষ্ট্রদূত এবং আমার বন্ধু সার্জ দেগালের আগ্রহে ঢাকায় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের সহযোগিতায় ঢাকা-প্যারিসে বাংলাদেশের শিল্পীদের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। আমার কাছে তিনি এ প্রদর্শনীর প্রস্তাব নিয়ে এলেন। এ কথা শুনে আমি গ্যালারির সঙ্গে কথা বললাম। জানতে চাইলাম, তারা বাংলাদেশের শিল্পীদের প্রদর্শনীর আয়োজন করবে কিনা। গ্যালারিস্ট আমার বন্ধু ম্যাজঁ দে'জার্তের ডিরেক্টর সার্জ বার্নার এ কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে প্রদর্শনী করতে রাজি হলো। এ সময় আমি একজন শিল্পী, একজন শিল্প সমালোচক এবং শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালককে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য বললাম। প্যারিসের (শাতিঁ ওর) মেয়র ও প্রশাসনকে এ প্রদর্শনীতে যুক্ত করায় বিষয়টি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চলে গেল। ২০০০ সালে সেই প্রদর্শনী হলো প্যারিসে। ঢাকায় আমার সঙ্গে গিয়েছিলেন সার্জ। তাকে আমি বিশেষ করে শিল্পী রণজিৎ দাসের কথা বলেছিলাম। আর্ট কলেজেও গিয়েছিলেন। মাহমুদুল হকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল এবং হক স্যার তাকে চারুকলা অনুষদের বিভিন্ন ক্লাস ঘুরিয়ে দেখান। যদিও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে প্যারিসে আসার আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকা বদল হয়েছিল সেই সময়। সে এক বিরাট ইতিহাস!
এর পরও প্রদর্শনী হলো। শুরু হওয়ার তিন দিন আগেও প্রদর্শনীটি হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। প্রদর্শনীতে আমি দিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু ও গান্ধীর প্রতিকৃতি আর মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আঁকা ছবি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে ঢাকা থেকে জানানো হলো, প্রদর্শনীতে একটি আপত্তিকর ছবি আছে। ছবিটি ছিল আমার আঁকা বঙ্গবন্ধু। শিরোনাম ছিল 'ফ্রেন্ড অব বেঙ্গল'। সার্জ বার্নার আমার কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলেন। সবিস্তারে তাকে বিষয়টি খুলে বললাম। বিষয়টি তার ব্যক্তিত্বে খুব লাগল। প্রদর্শনী শুরু হওয়ার আগের দিন আরও জানানো হলো, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ঝোলানোর জায়গাটা খালি থাকবে। অথবা ছবিটি উল্টিয়ে রাখা হবে। আমি তীব্র প্রতিবাদ জানালাম। প্রদর্শনী বর্জন করার কথাও বললাম। সেই সময় বাংলাদেশস্থ ফরাসি রাষ্ট্রদূত বললেন, এটি একটি রাজনৈতিক বিষয়। কিন্তু তৎকালীন ফরাসি প্রধানমন্ত্রী জঁ-পিয়ের রাফারাঁ ও তার দপ্তর থেকে জানানো হলো, এটা ফ্রান্স। এটা প্যারিস। এটা মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তমতের দেশ। শাহাবুদ্দিন শিল্পী হিসেবে স্বাধীন। এর পর আমার আঁকা বঙ্গবন্ধু প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হলো।
প্রদর্শনীটির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে আসা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালক প্রয়াত সুবীর চৌধুরী প্রদর্শনীটির উদ্যোক্তা হিসেবে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল। এ প্রদর্শনী উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে অতিথি হিসেবে শিল্পী মাহমুদুল হক এসেছিলেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি তখন ক্ষমতাধর ব্যক্তি। এর পরও প্যারিসে থাকাবস্থায় তিনি আমাকে ফোন করেছিলেন। বাসায় এসেছিলেন। অনেকক্ষণ আলাপ হয়েছিল। এটাই শিল্পী মাহমুদুল হকের অন্যতম চরিত্র। রাজনৈতিকভাবে অন্য মতাদর্শের হয়েও তার বন্ধুরা ছিলেন প্রগতিশীল। জয় বাংলায় বিশ্বাসীরাই ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
আরেকটি ঘটনা বলি, ১৯৯২ সালে স্পেনে অলিম্পিক কমিটির আয়োজনে ফিফটি মাস্টার্স পেইন্টার অব কনটেম্পোরারি অব আর্টসে অংশগ্রহণ শেষে দেশে এসেছি। আর্ট কলেজে যাওয়ার পর শিল্পী জামাল আহমেদ যেখানে ক্লাস নিচ্ছিল, সেই কক্ষে গিয়েছি। ছাত্রছাত্রীদের কাজ দেখাচ্ছি, কথা বলছি। এটা মাহমুদুল হক দেখেছিলেন। এর পর প্যারিসে এসে অফিসিয়ালি তিনি বললেন, তুমি আর্ট কলেজে আমাদের ভিজিটিং প্রফেসর হবে। আমি রাজি হলাম। প্যারিস থেকে ফিরে ঢাকা থেকে আমাকে ও আনাকে চিঠি লিখলেন। ৮ এপ্রিল ১৯৯২ সালে তিনি চিঠিটি লিখেছিলেন। পাঠকদের উদ্দেশে চিঠিটি প্রকাশ করছি।
প্রিয় শাহাবুদ্দিন/আনা
আসার পর তোমাদের লেখা উচিত ছিল। দেরি করে ফেললাম। তোমাদের আতিথেয়তা ভুলবার নয়। সর্বোপরি তার মধ্যে যে আন্তরিকতা ছিল, তা মনে রাখবার মতো। ধন্যবাদ ছাড়া আর কিছু জানাবার নেই। কয়েকটি পত্রিকা পাঠালাম মাত্র। ইউনুসের কাছে শাহাবুদ্দিনের একটি বায়োডাটা ও একটা অ্যাপ্লিকেশন পাঠিও। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভিসিকে অ্যাডভার্ট করতে হবে ভিজিটিং লেকচারারশিপের জন্য। বাকিটুকু আমি এখান থেকে ব্যবস্থা করব। আর তোমরা তো আসছ ডিসেম্বরে। ইনশাল্লাহ দেখা হবে। কোনো কিছু প্রয়োজন হলে জানাতে দ্বিধা কোরো না। বাকি সব খবর এদের কাছে শুনতে পারবে। শুভেচ্ছা জেনো।
মা মণিদের স্নেহ রইল।
মাহমুদ ভাই
ওই সময় আর্ট কলেজের পেইন্টিং বিভাগের শেষ বর্ষ এবং মাস্টার্সের ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নিয়েছি। এক ঘণ্টার ক্লাস চার-পাঁচ ঘণ্টায় শেষ হতো না। বর্তমানে শিক্ষক মোহাম্মদ ইকবাল শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল। তখন মাহমুদুল হকের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হতো। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম, শিক্ষার্থীরা আমার ক্লাস করে খুশি। আমি স্বাধীনতা পদক পাওয়ার পর ফুলের তোড়া নিয়ে তিনিই ছাত্রছাত্রীসহ শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন।
এমন কিছু শুধু মাহমুদুল হকই করতে পারেন। অন্যদের পক্ষে এমন কিছু করা প্রায় অসম্ভবই বলতে হয়। মানুষকে সাহায্য করতে বন্ধু হিসেবে তিনি অসাধারণ-অতুলনীয়। তার স্মৃতির প্রতি আমার বিনীত শ্রদ্ধা।
শাহাবুদ্দিন আহমেদ :মুক্তিযোদ্ধা, প্লাটুন কমান্ডার ও বিশিষ্ট শিল্পী
আমার মনে পড়ে সেই সময়ের কথা। আমাদের শিক্ষক ও শিল্পী মাহমুদুল হক আর্ট কলেজের করিডোরে নিজের করা ছাপচিত্র দেখাচ্ছিলেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ ও শিল্পী আনোয়ারুল হক। তখনই আবুল বারক আলভী মানে আমাদের আলভী ভাইকে প্রথম দেখলাম। সদ্য তারা পাকিস্তান থেকে প্রদর্শনী করে ফিরেছেন। দ্বিতীয় বর্ষে আমরা শিক্ষক হিসেবে শিল্পী রফিকুন নবীকে পাই। এর পরও বলি, শিক্ষক হিসেবে শিল্পী মাহমুদুল হক ছিলেন অনেক আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান।
বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার পর রাজনৈতিক কারণে মাহমুদুল হককে আরেকভাবে দেখার সুযোগ হয়। তখন আমি আর্ট কলেজের ভিপি। নানা কাজের সঙ্গে জড়িত। মাহমুদুল হকের কাছে কোনো অনুরোধ নিয়ে গেছি কিংবা কাউকে পাঠিয়েছি; তিনি ফিরিয়ে দেননি। আমার অনুরোধ তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে রেখেছেন। এমন অনেক অনুরোধই রেখেছেন তিনি। এমন চরিত্র ও উদারতা একজন শিল্পী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে খুব দরকার।
১৯৮১ সালে প্রথমবারের মতো ঢাকায় এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্যারিস থেকে আমি ঢাকায় এসেছি। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। নিজের মন আমার তখনও স্বাভাবিক হয়নি। প্রদর্শনী উপলক্ষে ঢাকায় পাকিস্তান থেকে একটি দল এসেছে। শিল্পী মাহমুদুল হক আমাকে নিয়ে গেলেন। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, আমার মধ্যে শিল্পী হয়ে ওঠার চেষ্টা ছিল। এ কারণেই বোধ হয় তিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। এ সময় ওইখানে ছিলেন সফিউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়াসহ অনেকে। তখন চেয়ারে বসা ছিলেন পাকিস্তান থেকে আসা দলটির নেতৃত্ব দেওয়া এক ভদ্রমহিলা। মাহমুদুল হক আমাকে চা পান করতে ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে বসতে বললেন। এ কথা শুনে রাগে আমার কান গরম হয়ে গেল। বললাম, আমি চললাম। এখানে আমি থাকব না। খুব রেগে গিয়ে হাত দিয়ে টেবিলে জোরে থাপ্পড় দিলাম। আরও বললাম, আমি মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি, তাদের সঙ্গে আলাপ হতে পারে না। এসব কথার মধ্যেও মাহমুদুল হক আমাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। আমি তার সঙ্গে কথা না বলে ওইখান থেকে চলে এলাম। ওই বছরই ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমিতে আমার একক চিত্রপ্রদর্শনী হচ্ছে। শিল্পী মাহমুদুল হক আমার প্রদর্শনী দেখতে এলেন। অনুতপ্ত হলেন। তিনি আমার জীবনসঙ্গিনী আনা ইসলামের বোন শিল্পী আতিয়া ইসলাম অ্যানির শিক্ষক। আনার সঙ্গে আমার বিয়ের উকিল বাবাও তিনি ছিলেন। এই ছিলেন আমাদের মাহমুদুল হক।
২০০০ সালে তৎকালীন ফ্রান্সের বাংলাদেশস্থ রাষ্ট্রদূত এবং আমার বন্ধু সার্জ দেগালের আগ্রহে ঢাকায় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের সহযোগিতায় ঢাকা-প্যারিসে বাংলাদেশের শিল্পীদের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। আমার কাছে তিনি এ প্রদর্শনীর প্রস্তাব নিয়ে এলেন। এ কথা শুনে আমি গ্যালারির সঙ্গে কথা বললাম। জানতে চাইলাম, তারা বাংলাদেশের শিল্পীদের প্রদর্শনীর আয়োজন করবে কিনা। গ্যালারিস্ট আমার বন্ধু ম্যাজঁ দে'জার্তের ডিরেক্টর সার্জ বার্নার এ কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে প্রদর্শনী করতে রাজি হলো। এ সময় আমি একজন শিল্পী, একজন শিল্প সমালোচক এবং শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালককে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য বললাম। প্যারিসের (শাতিঁ ওর) মেয়র ও প্রশাসনকে এ প্রদর্শনীতে যুক্ত করায় বিষয়টি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চলে গেল। ২০০০ সালে সেই প্রদর্শনী হলো প্যারিসে। ঢাকায় আমার সঙ্গে গিয়েছিলেন সার্জ। তাকে আমি বিশেষ করে শিল্পী রণজিৎ দাসের কথা বলেছিলাম। আর্ট কলেজেও গিয়েছিলেন। মাহমুদুল হকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল এবং হক স্যার তাকে চারুকলা অনুষদের বিভিন্ন ক্লাস ঘুরিয়ে দেখান। যদিও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে প্যারিসে আসার আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকা বদল হয়েছিল সেই সময়। সে এক বিরাট ইতিহাস!
এর পরও প্রদর্শনী হলো। শুরু হওয়ার তিন দিন আগেও প্রদর্শনীটি হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। প্রদর্শনীতে আমি দিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু ও গান্ধীর প্রতিকৃতি আর মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আঁকা ছবি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে ঢাকা থেকে জানানো হলো, প্রদর্শনীতে একটি আপত্তিকর ছবি আছে। ছবিটি ছিল আমার আঁকা বঙ্গবন্ধু। শিরোনাম ছিল 'ফ্রেন্ড অব বেঙ্গল'। সার্জ বার্নার আমার কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলেন। সবিস্তারে তাকে বিষয়টি খুলে বললাম। বিষয়টি তার ব্যক্তিত্বে খুব লাগল। প্রদর্শনী শুরু হওয়ার আগের দিন আরও জানানো হলো, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ঝোলানোর জায়গাটা খালি থাকবে। অথবা ছবিটি উল্টিয়ে রাখা হবে। আমি তীব্র প্রতিবাদ জানালাম। প্রদর্শনী বর্জন করার কথাও বললাম। সেই সময় বাংলাদেশস্থ ফরাসি রাষ্ট্রদূত বললেন, এটি একটি রাজনৈতিক বিষয়। কিন্তু তৎকালীন ফরাসি প্রধানমন্ত্রী জঁ-পিয়ের রাফারাঁ ও তার দপ্তর থেকে জানানো হলো, এটা ফ্রান্স। এটা প্যারিস। এটা মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তমতের দেশ। শাহাবুদ্দিন শিল্পী হিসেবে স্বাধীন। এর পর আমার আঁকা বঙ্গবন্ধু প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হলো।
প্রদর্শনীটির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে আসা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালক প্রয়াত সুবীর চৌধুরী প্রদর্শনীটির উদ্যোক্তা হিসেবে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল। এ প্রদর্শনী উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে অতিথি হিসেবে শিল্পী মাহমুদুল হক এসেছিলেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি তখন ক্ষমতাধর ব্যক্তি। এর পরও প্যারিসে থাকাবস্থায় তিনি আমাকে ফোন করেছিলেন। বাসায় এসেছিলেন। অনেকক্ষণ আলাপ হয়েছিল। এটাই শিল্পী মাহমুদুল হকের অন্যতম চরিত্র। রাজনৈতিকভাবে অন্য মতাদর্শের হয়েও তার বন্ধুরা ছিলেন প্রগতিশীল। জয় বাংলায় বিশ্বাসীরাই ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
আরেকটি ঘটনা বলি, ১৯৯২ সালে স্পেনে অলিম্পিক কমিটির আয়োজনে ফিফটি মাস্টার্স পেইন্টার অব কনটেম্পোরারি অব আর্টসে অংশগ্রহণ শেষে দেশে এসেছি। আর্ট কলেজে যাওয়ার পর শিল্পী জামাল আহমেদ যেখানে ক্লাস নিচ্ছিল, সেই কক্ষে গিয়েছি। ছাত্রছাত্রীদের কাজ দেখাচ্ছি, কথা বলছি। এটা মাহমুদুল হক দেখেছিলেন। এর পর প্যারিসে এসে অফিসিয়ালি তিনি বললেন, তুমি আর্ট কলেজে আমাদের ভিজিটিং প্রফেসর হবে। আমি রাজি হলাম। প্যারিস থেকে ফিরে ঢাকা থেকে আমাকে ও আনাকে চিঠি লিখলেন। ৮ এপ্রিল ১৯৯২ সালে তিনি চিঠিটি লিখেছিলেন। পাঠকদের উদ্দেশে চিঠিটি প্রকাশ করছি।
প্রিয় শাহাবুদ্দিন/আনা
আসার পর তোমাদের লেখা উচিত ছিল। দেরি করে ফেললাম। তোমাদের আতিথেয়তা ভুলবার নয়। সর্বোপরি তার মধ্যে যে আন্তরিকতা ছিল, তা মনে রাখবার মতো। ধন্যবাদ ছাড়া আর কিছু জানাবার নেই। কয়েকটি পত্রিকা পাঠালাম মাত্র। ইউনুসের কাছে শাহাবুদ্দিনের একটি বায়োডাটা ও একটা অ্যাপ্লিকেশন পাঠিও। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভিসিকে অ্যাডভার্ট করতে হবে ভিজিটিং লেকচারারশিপের জন্য। বাকিটুকু আমি এখান থেকে ব্যবস্থা করব। আর তোমরা তো আসছ ডিসেম্বরে। ইনশাল্লাহ দেখা হবে। কোনো কিছু প্রয়োজন হলে জানাতে দ্বিধা কোরো না। বাকি সব খবর এদের কাছে শুনতে পারবে। শুভেচ্ছা জেনো।
মা মণিদের স্নেহ রইল।
মাহমুদ ভাই
ওই সময় আর্ট কলেজের পেইন্টিং বিভাগের শেষ বর্ষ এবং মাস্টার্সের ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নিয়েছি। এক ঘণ্টার ক্লাস চার-পাঁচ ঘণ্টায় শেষ হতো না। বর্তমানে শিক্ষক মোহাম্মদ ইকবাল শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল। তখন মাহমুদুল হকের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হতো। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম, শিক্ষার্থীরা আমার ক্লাস করে খুশি। আমি স্বাধীনতা পদক পাওয়ার পর ফুলের তোড়া নিয়ে তিনিই ছাত্রছাত্রীসহ শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন।
এমন কিছু শুধু মাহমুদুল হকই করতে পারেন। অন্যদের পক্ষে এমন কিছু করা প্রায় অসম্ভবই বলতে হয়। মানুষকে সাহায্য করতে বন্ধু হিসেবে তিনি অসাধারণ-অতুলনীয়। তার স্মৃতির প্রতি আমার বিনীত শ্রদ্ধা।
শাহাবুদ্দিন আহমেদ :মুক্তিযোদ্ধা, প্লাটুন কমান্ডার ও বিশিষ্ট শিল্পী
মন্তব্য করুন