- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- প্রকল্প চূড়ান্তের আগেই কর্মী নিয়োগ!
প্রকল্প চূড়ান্তের আগেই কর্মী নিয়োগ!

বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার মর্তুজাপুর গ্রামের যুবক মনোয়ার হোসেনমনির তিন বছর আগে একটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরির জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু সোনার হরিণটি তার কাছে অধরাই রয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলছিলেন, ‘সবাই জানে আমি সরকারি চাকরি পেয়েছি। কিন্তু বেতন যে পাই না- তা কেউ জানে না। ভবিষ্যতে যে পাব তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।'
তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী (এনডিডি) সুরক্ষা ট্রাস্টের আওতাধীন অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, সেরিব্রাল পালসি ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনের জন্য প্রস্তাবিত বগুড়া কেন্দ্রে কেয়ারগিভার পদে ২০১৮ সালের শেষে অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে তিনিসহ উত্তীর্ণ ১২ জনকে ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। তারপর নিয়োগপত্র দেওয়ার কথা থাকলেও তারা পাননি। ফলে ওই পদের জন্য ধার্য করা ১৮ হাজার টাকা বেতনও তাদের ভাগ্যে জুটছে না। প্রস্তাবিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়োগের জন্য মনোনীত ১২ জনেরও একই অবস্থা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী (সরকারিভাবে দেওয়া নাম) ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে সমাজসেবা মন্ত্রণালয় থেকে বগুড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় পৃথক দুটি পুনর্বাসন কেন্দ্র চালুর জন্য নেওয়া বিশেষ ওই প্রকল্প চূড়ান্ত হওয়ার আগেই জনবল নিয়োগে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, পরীক্ষা গ্রহণ এবং তাতে উত্তীর্ণদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
শুধু তাই-ই নয়, ওই প্রকল্পে বর্ণিত নিবাসীদের জন্য বগুড়ায় সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত যৌনকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটিও খালি করা হয়।
নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা গেছে, চার ধরনের প্রতিবন্ধিতা যথাক্রমে অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, সেরিব্রাল পালসি ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৩ সালে এনডিডি সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন করা হয়। দু'বছর পরে ওই ট্রাস্টের বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়।
ওই ট্রাস্টের অধীনে এনডিডি ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য বগুড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থিত যৌনকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রকে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে বগুড়া কেন্দ্রে ৫০ জন পুরুষ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সমসংখ্যক মহিলা প্রতিবন্ধীকে রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ের পদস্থ এক কর্মকর্তার আগ্রহেই ২০১৮ সালে তড়িঘড়ি এনডিডি প্রকল্প নেওয়া হয়। পরে তিনি অন্যত্র বদলি হয়ে গেলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ভাটা পড়ে। তখন বগুড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থিত যৌনকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোকে এনডিডি প্রতিবন্ধীদের পরিবর্তে ভিক্ষুক পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব আসে।
দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, সেরিব্রাল পালসি ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নাকি ভিক্ষুকদের চেয়ে পুনর্বাসন সবচেয়ে জরুরি সেটা নিয়ে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। যে কারণে উভয় প্রকল্পের মধ্যে কোনটি বাস্তবায়ন করা হবে তা নিয়ে রশি টানাটানি চলছে।
সমাজসেবা অধিপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রস্তাবিত দুটি পুনর্বাসন কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে সেটি মানা হয়নি। বরং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের আগেই জনবল নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর সে কারণে প্রস্তাবিত বগুড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া কেন্দ্রের জন্য মনোনীত ২৪ জন কেয়ারগিভারের নিয়োগ অর্থ মন্ত্রণালয়ে আটকে যায়। সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দুটি পুনর্বাসন কেন্দ্রের জন্য জনবলের সংখ্যা ২৪ থেকে কমিয়ে ১৬ করতে বলা হয়েছে।
প্রকল্প চূড়ান্ত না হতেই এভাবে জনবল নিয়োগে উদ্যোগী হওয়া এবং তার জন্য বিশেষায়িত একটি সেন্টারের নিবাসীদের অন্যত্র পাঠিয়ে তা খালি করার বিষয়টি ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন বগুড়ার সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযানের (সুপ্র) বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কেজিএম ফারুকের মতে, সরকারি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সচরাচর দেখা যায় প্রতিষ্ঠান আছে কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল নেই। কিন্তু এখানে ঠিক তার উল্টোটা ঘটেছে। প্রকল্প চূড়ান্ত হওয়ার আগেই জনবল নিয়োগের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে বগুড়ার ১২ যুবকের জীবন-জীবিকা যেভাবে ৩ বছর ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে তা সত্যিই দুঃখজনক। আশা করি কর্তৃপক্ষ দ্রুতই তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে।
বগুড়া সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক আবু সাঈদ মো. কাওছার রহমান জানান, বগুড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এনডিডি নাকি ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্প শুরু হবে সে ব্যাপারে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ গত ১৭ জানুয়ারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের ভার্চুয়াল সভা হয়েছে। আগামীতে আবারও সভা হবে। তখন হয়তো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে।
মন্তব্য করুন