গত বছরের শেষে এবং চলতি বছরের শুরুর দিকে ইতালিসহ ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশ থেকে বহু অভিবাসী বাংলাদেশে এসেছিলেন ছুটি কাটাতে। নির্ধারিত কয়েক মাস ছুটি কাটিয়ে তাদের সেইসব অভিবাসন দেশে ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও করোনাভাইরাসের কারণে বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় তারা আটকে পড়েছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি বিমান চলাচল শুরু হলে কিছু অভিবাসী কভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ নিয়ে ইতালি পৌঁছান। কিন্তু সেখানে নমুনা পরীক্ষার পর জানা গেল অভিবাসীদের অনেকেই কভিড পজিটিভ। এই বিষয়টি ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইতালিতে বাংলাদেশ সম্বন্ধে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয় এবং দেশটি অভিবাসীদের ফেরত পাঠিয়ে দেয়। এটা ঘটেছে পরীক্ষা না করেই কভিডের ভুয়া সনদ সরবরাহের কারণে। কভিড টেস্টের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর সততা, একাগ্রতা ও জবাবদিহির বিষয় বিবেচনায় নেয়নি অনুমোদনদাতা প্রতিষ্ঠান। এর ফলে আমরা দেখলাম ২০১৪ সাল থেকে লাইসেন্সহীন একটি হাসপাতালকেও কভিড টেস্টের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। রিজেন্টের মতো জেকেজি নামেরও একটি ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানকেও অনুমতি দেওয়া হয়েছি। মানুষের জীবনাতঙ্ককে পুঁজি করে পরীক্ষা ছাড়াই করোনার ভুয়া সনদ সরবরাহ করেছে জালিয়াত প্রতিষ্ঠানগুলো। অভিবাসীরা কিন্তু এ জন্য কোনোক্রমেই দায়ী নন। তারা সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রেখে কভিড টেস্টের জন্য নমুনা দিয়েছেন। কিন্তু এই জালিয়াত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।

কভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী জীবন-জীবিকার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে, আমদানি-রপ্তানিসহ সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকটের মধ্যে রয়েছে। যে সময়ে দেশীয় অর্থনীতি ও অভিবাসন প্রক্রিয়া হুমকির মুখে পড়েছে, সেই পরিস্থিতিতে রিজেন্ট-জেকেজির মতো প্রতিষ্ঠানকে করোনা পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়ার ফলে অভিবাসীরা নতুন করে সংকটে পড়লেন। এ ঘটনার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর যথেষ্ট চাপ আসার কথা ছিল। অন্য কোনো রাষ্ট্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সেখানকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গেই দুঃখ প্রকাশ করে পদত্যাগ করতেন। আমাদের দেশে এমন সংস্কৃতি নেই বিধায় এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে। এখানে কাউকেই জবাবদিহির আওতায় আসতে হয় না। আমরা জানি এই ভুয়া সনদের প্রভাব শুধু অভিবাসীদের ওপরই পড়বে না। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে কভিড-১৯ ব্যবস্থাপনার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে বিশ্বদরবারে। সবাই বুঝতে পারল বাংলাদেশে কভিড মোকাবিলার ক্ষেত্রে দুর্নীতি হচ্ছে। এতে সন্দেহ নেই যে, আমাদের সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কার্যত এ রকম একটি নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে যে, বাংলাদেশে কভিড মোকাবিলায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।

ভূয়া সনদের কারণে ভাবমূর্তির যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার প্রভাব পড়বে অনেক ক্ষেত্রে। ইতোমধ্যে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ জানিয়েছে আগামী অক্টোবর মাস পর্যন্ত তারা বাংলাদেশ থেকে বিমান প্রবেশ করাবে না। সেনজেন ভিসা প্রদানের সুযোগ স্থগিত করা হয়েছে। এর অর্থ হলো- বিমানের ব্যবসা বন্ধ থাকবে এবং এর লোকসান সরকারকে বহন করতে হবে। আমরা জানি যে, বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। তারা সেখানে যথেষ্ট ভালো করেন এবং বড় বড় প্রতিষ্ঠানে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। মূলত তারাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের হয়ে অ্যাম্বাসাডরের ভূমিকা পালন করে থাকেন। বিমান চলাচল বন্ধ করায় এ বছর অনেকে শিক্ষার্থীই পড়তে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। এর প্রভাব পড়বে দীর্ঘমেয়াদে। বিগত সময়েও আমরা দেখেছি নকল মাস্ক ও পিপিই সরবরাহের কারণে আমাদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ডাক্তার-নার্স প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু কোথাও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ইতালি থেকে অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর ঘটনা ছোট মনে হলেও এর নেতিবাচক প্রভাব কিন্তু বহুমুখী। এর ফলে মানুষের ভেতরে হতাশা কাজ করছে। এই হতাশা রাষ্ট্রের ইতিবাচক রাজনীতির জন্য সহায়ক নয়। দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতে এ ধরনের দুর্নীতি-জালিয়াতি কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। একদিকে স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিয়ে চলেছেন, অন্যদিকে কিছু প্রতিষ্ঠান মানুষের জীবনঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন জালিয়াতির মাধ্যমে।

ইতালি থেকে ফেরত পাঠানোর ঘটনায় অভিবাসনের ক্ষেত্রে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা হাজারো কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে সমাধান করা সম্ভব হবে না। আমরা যদি দেশের অভ্যন্তরে করোনা ব্যবস্থাপনার উন্নতি না ঘটাতে পারি তাহলে কূটনৈতিক সফলতা আসা কঠিন। যারা এ ধরনের জালিয়াতি করেছে, আগে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এর পাশাপাশি এ ঘটনার জন্য দায়ী কর্তাব্যক্তিরা যদি দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করতেন বা তাদের বরখাস্ত করা হতো, তাহলেও কিছুটা স্বস্তি ফিরত। এখন প্রমাণ করতে হবে সংকট কাটিয়ে আমরা ভালোভাবে কভিড মোকাবিলা করছি। এটা প্রমাণ করা গেলেই কেবল কূটনৈতিক তৎপরতা কাজে দেবে। আর প্রমাণ করা না গেলে কূটনীতিকরা বিদেশে কী বলবেন? রিজেন্ট সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে সত্য; কিন্তু উপযুক্ত শাস্তি প্রক্রিয়া দৃষ্টিগোচর হচ্ছে কই? এই জালিয়াতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে অন্যদের কঠোর সতর্কতা প্রদান করাই হবে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ। যারা এই মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে, তাদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য মামলা হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দায় এড়ানোর যে প্রবণতা দেখাচ্ছে, তা অবশ্যই পরিহার করতে হবে।

ইতালি ফেরত অভিবাসীরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের উচিত হবে আদালতে ক্ষতিপূরণের মামলা করা। তাদের যাওয়া-আসার খরচ, ভিসা খরচ, তারা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন- এই সবকিছু হিসাব করে ক্ষতিপূরণ দাবি করা উচিত। এর পাশাপাশি সরকারেরও উচিত হবে তাদের ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। রিজেন্ট-জেকেজিসহ জালিয়াত প্রতিষ্ঠানগুলোকেই এই ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। সরকার আইনি প্রক্রিয়ায় জালিয়াতদের কাছ থেকে এই ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায় করতে পারে। ভুয়া সনদ দিয়ে মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আদালতও স্বপ্রণোদিত হয়ে সমন জারি করতে পারে। অভিবাসন জাতীয় অর্থনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই সেক্টর যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে জন্য সরকার সচেতন হবে এটাই সবার কামনা। ইতালি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজন সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা, দোষীদের শাস্তি এবং প্রত্যাবর্তনকারীদের ক্ষতিপূরণ প্রদান।

অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; চেয়ারম্যান, রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)
tsiddiqui59@gmail.com