বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া বেআইনি এবং দেশের পেনাল কোডের মাধ্যমে তা নিষিদ্ধ। দণ্ডবিধির ৪৯৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ব্যক্তিত্বের দ্বারা প্রতারণা’কে অপরাধী করে এবং বাংলাদেশে অনলাইন জুয়াকে বিচার করার জন্য ব্যবহৃত হয় প্রাথমিক আইনি বিধান। এই ধারা লঙ্ঘনের জন্য শাস্তি ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে।

 বিদ্যমান বঙ্গীয় প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭-এর কয়েকটি ধারা যুগোপযোগী করার পাশাপাশি স্পষ্টীকরণের মাধ্যমে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও ডিভাইসে জুয়াকে শাস্তির আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডিসি সম্মেলনে। প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তিতে বলা হয়, বঙ্গীয় প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭-এর ৩ ধারায় যে কোনো ঘর, তাঁবু, কক্ষ, প্রাঙ্গণ বা প্রাচীরবেষ্টিত স্থানকে জুয়ার স্থান হিসেবে গণ্য করা হলেও যুগের পরিবর্তনে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও ডিভাইসের মাধ্যমে জুয়া খেলা হলেও তা আইনের আওতায় না হওয়ায় শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয় না। বর্তমানে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও ডিভাইসের মাধ্যমে জুয়া খেলা খুব সহজলভ্য হওয়ায় জুয়া বেড়েই চলেছে। তাই ধারাটি যুগোপযোগী সংশোধন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

এ ছাড়া আইনের ৩ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি তিন মাস কারাদণ্ড অথবা ২০০ টাকা অর্থদণ্ড, ৪ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি এক মাস কারাদণ্ড অথবা ১০০ টাকা অর্থদণ্ড এবং ১১ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি এক মাস কারাদণ্ডসহ ৫০ টাকা অর্থদণ্ড করার বিধান রয়েছে, যা বর্তমান সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের সুপারিশে বলা হয়েছে, আইনের ৩ ধারা সংশোধন করে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে জুয়ার স্থান হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। আইনের বিভিন্ন ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছর কারাদণ্ডসহ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) অনলাইন জুয়াসহ অবৈধ কার্যকলাপে জড়িত যে কোনো ওয়েবসাইট ব্লক করার ক্ষমতা রাখে। এই অবস্থায় গত বছরের অক্টোবর মাসে অনলাইনে জুয়াসংশ্লিষ্ট ৩৩১টি ওয়েবসাইট বন্ধ করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এ ছাড়া অনলাইন জুয়া বা বাজি সংক্রান্ত ১৫০টি গুগল অ্যাপ বন্ধের জন্য রিপোর্ট করা হলে এরই মধ্যে গুগল কর্তৃপক্ষ প্লে স্টোর থেকে ১৪টি বন্ধ করেছে। বাকি অ্যাপ বন্ধ করার জন্য যাচাই-বাছাইসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। অনলাইন জুয়া সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেয়, এমন ২৭টি ফেসবুক লিঙ্ক এবং ৬৯টি ইউটিউব লিঙ্ক বন্ধের জন্যও রিপোর্ট করা হলে ১৭টি ফেসবুক লিঙ্ক ও একটি ইউটিউব লিঙ্ক বন্ধ করা হয়েছে। আরও কিছু লিঙ্ক বন্ধের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।

অ্যাপের নিয়ম অনুযায়ী, খেলার চিপস কিনতে প্রয়োজন পড়ে নগদ অর্থ, ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড। অপরাধীচক্র এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশ থেকে কোটি কোটি টাকাও পাচার করে থাকে। মোবাইল অ্যাপ ছাড়াও অপরাধীরা বিভিন্ন ওয়েবসাইট/ডোমেইনের মাধ্যমে সরাসরি অনলাইন গেম/জুয়া খেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে এবং এ জন্য দেশ-বিদেশে হোস্টকৃত বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রথমে অ্যাকাউন্ট খুলে নিবন্ধন করা হয়। তারপর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কার্ড বা অন্য কোনো মাধ্যমে জমা দিয়ে জুয়ায় অংশ নিতে হয়। অনলাইন জুয়াড়িরা বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়েও টাকা আদান-প্রদান করে থাকে।

ওদিকে বিশ্বজুড়ে যে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, হকি লিগের আসর বেড়েই চলেছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে অনলাইনে জুয়ার আসর। প্রচলিত আইন অনুযায়ী দেশে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সম্প্রতি বিভিন্ন ওয়েবসাইট-অ্যাপের মাধ্যমে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস খেলাসহ বিভিন্ন লিগ ম্যাচ ঘিরে অবৈধ অনলাইন জুয়া বা বাজি চলে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে প্রকাশ্যে এর হার কমলেও অনলাইনে তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। রমরমা এ জুয়ায় নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে হাজারো পরিবার।

এই পরিস্থিতিতে উনিশ শতকের জুয়া আইন দিয়ে অনলাইন জুয়াড়িদের প্রতিরোধ করা যাবে না। পরিস্থিতি আরও গুরুতর আকার ধারণ করার আগেই আইনটি সংশোধন ও যুগোপযোগী করতে হবে। পাশাপাশি অনলাইনে জুয়া বা বাজির ওয়েবসাইটে নজরদারি কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। বিটিআরসি থেকে অনুরোধ করা হয়েছে, নাগরিকরা যেন অনলাইন জুয়া সংক্রান্ত সাইটের লিঙ্ক বা ইউআরএল উল্লেখ করে ই-মেইল বা লিখিত আকারে বিটিআরসিকে অবহিত করেন। একই সঙ্গে সচেতনমূলক কার্যক্রমও জরুরি। 

জাহিদুর রহমান: শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজকোর্ট