
ছেলেটার নাম আসমত উল্লা। বয়স ২০-২১ হবে। নিশ্চিত বলতে পারে না সে। জন্মসাল মনে নেই তার। ২০১৭ সালে পরিবারের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমানা পার হয়ে বাংলাদেশে আসার আগে সে আট ক্লাসে পড়ত। পড়া নিয়ে খুব উচ্চাশা তার ছিল না। তবে, চাচাতো ভাই রফিক উল্লা থাকে মালয়েশিয়ায়, সেখানে চলে যাবার ব্যাপারে নানা স্বপ্ন ছিল। গত দুই বছরে চেষ্টাও করেছে চলে যাওয়ার। এমনিতে তো বৈধ উপায়ে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। একমাত্র পথ নৌকায় করে আন্দামান সাগর পাড়ি দেওয়া। অনেকে চলেও যাচ্ছে।
গত বছর ডিসেম্বরে বেশ কয়েকটি নৌকা আন্দামান সাগরে হারিয়ে যাওয়ায় সে স্বপ্নে অনেকটাই ভাটা পড়েছে। বরং এখন সে এখানেই একটা কাজ খুঁজে নিয়েছে। রেড ক্রিসেন্টের হয়ে ক্যাম্পে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করে সে। অনেক কাজের মধ্যে তার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ঘূর্ণিঝড় বা যে কোনো দুর্যোগের আগে তার কওমের লোকের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা।
গত মার্চে ১১ নম্বর ক্যাম্পে আগুন লাগলে সবার সঙ্গে সেও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল উদ্ধার কাজে। দুর্যোগের সময় কী করতে হয় তার কিছু প্রশিক্ষণও সে পেয়েছে।
‘আমরা যখন বৃষ্টিতে ভিজে, ঠান্ডা, ক্ষুধা আর তৃষ্ণা সয়ে প্রচণ্ড অনিশ্চয়তা নিয়ে সীমানা পার হয়ে আসি, তখন মনে হচ্ছিল, এর চেয়ে বড় দুর্যোগ আর মানুষের জীবনে হতে পারে না’, বলছিল আসমত উল্লা। এ বছর মার্চ মাসের আগুন বা ২০২১ সালের বড় আগুন কিংবা ২০২১ সালের সাইক্লোন ইয়াস– আমাদের সেই কষ্টের তুলনায় কিছুই না। বড় দুর্যোগ আমরা দেখে ফেলেছি। কাজেই আমাদের আর ভয় করে না।
সে আরও বলেছে, আজ (১৩ মে) সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। আকাশের দিকে তাকালেই বোঝা যাচ্ছে, কিছু একটা ঘনিয়ে আসছে। আমরা শুনলাম, ইতোমধ্যেই ১০ নম্বর মহা-বিপৎসংকেত দিয়েছে। আমি নিজেই তিন পতাকা তুলে দিয়ে এসেছি কয়েক জায়গায়। আজ সারাদিন ধরে আমরা শুকনো খাবার আর আমাদের পরিচয়পত্র কীভাবে রক্ষা করব, সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। পলিথিনে পেঁচিয়ে মাটির নিচে পুঁতে রাখছি। এমনভাবে রাখছি, যাতে জোয়ারের পানিতে ঘর ডুবে গেলেও তা পরে খুঁজে পাওয়া যায়।
আজ সারাদিন ধরে থেকে থেকেই মনে হচ্ছে, কী ঘটবে আমাদের কপালে। বাতাসের যে গতিবেগের কথা শুনছি, তাতে আমাদের বাঁশের তৈরি ঘর টিকবে না। বাংলাদেশ সরকার থেকে আমাদের বাঁশের তৈরি ঘরের চেয়ে বেশি পাকাপোক্ত ঘর দেওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে। হয়তো, আমাদের আবার মিয়ানমারে ফিরে যেতে হবে বলে এই ব্যবস্থা। যদিও গত ৫ বছর ধরে আমরা এভাবেই আছি। এভাবে থাকলে ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা করা যায় না। সারাক্ষণ একটা অস্থায়ী পরিকল্পনার মধ্যেই থাকতে হয়। এটাও একটা ভয়েরই ব্যাপার।
এই যে প্রায় ১২ লাখ মানুষ আমরা আছি, তাদের জন্য কোনো সাইক্লোন শেল্টার করার কোনো পরিকল্পনা নেই। কারণ, আমরা তো চলেই যাব। এ কারণেই কোনো স্থায়ী কাঠামো এখানে করা হবে না। আমরা ভাবছি, তাহলে সাইক্লোন হলে, সেই সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস হলে আমরা কোথায় যাব? আমরা কি এভাবেই বসে থাকব? অপেক্ষা করতে থাকব কোনো অজানা ব্যবস্থার জন্য? আমরা অবশ্য আতঙ্কিত নই। কী আর হবে? আমরা এর চেয়েও বড় দুর্যোগ পার করে বেঁচে আছি। কপালে হায়াত থাকলে এবারও বেঁচে যাব।
কিছুদিন আগে যখন আগুন লাগল, তখন একটা জিনিস আমি খেয়াল করলাম। আমরা সবাই নিজের শরীর নিয়ে যে কোনো দিকে দৌড় দিলাম। নিজের প্রাণ বাঁচালাম আগুন থেকে। এর পর আমরা আমাদের পরিবারের মানুষকে খুঁজে বের করলাম। ঘরের মায়া করলাম না, কাপড়চোপড়ের মায়া করলাম না, কোনো জিনিসপত্রের মায়া করলাম না। আমার মায়ের স্বর্ণের গহনা যা ছিল, ঘরের মাটির নিচে পুঁতে রাখল বের হয়ে যাওয়ার আগে। যদি ঘর পুড়েও যায়, পরে এসে যাতে সেটা বের করে নিতে পারি। এ ছাড়া আর কিছুই আমরা বাঁচানোর চেষ্টা করিনি। সেটা সম্ভবও ছিল না।
এর একটা সুবিধা আছে। এই যে ঘূর্ণিঝড় ঘনিয়ে আসছে, আমাদের তাই ভয় করছে না। আমরা আবারও নিজের শরীর বাঁচানোর চেষ্টা করব। যার যার মতো করে বেঁচে থাকব। ঝড় থেমে গেলে আমাদের পরিবারের সদস্যদের খুঁজে বের করব। কওমের লোকেদের খুঁজে বের করব। এর পর আবার আমাদের হয়তো ঘর করে দেওয়া হবে। সেখানেই আমরা থাকব। হয়তো, আমাদের পরিবারের কোনো কোনো সদস্যকে আমরা খুঁজে পাব না।
তবু, আমরা বেঁচে থাকব। আমরা অনেক মহাবিপদ পার হয়েছি। বিপদ থেকে আর পালাব কোথায়? বেঁচে আমাদের থাকতেই হবে। যতদিন পারি। এখন আমাদের সামনে একটাই লক্ষ্য– বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকলে কিছু একটা হবে। না থাকলে দুনিয়া দুনিয়ার মতোই চলবে। শুধু আমরা থাকব না।
মারুফ বরকত: কমিউনিকেশন ম্যানেজার, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ
bmaruf@gmail.com
মন্তব্য করুন