- চতুরঙ্গ
- 'সময় বহিয়া যায়' কিন্তু জন্মদিন ফিরে ফিরে আসে
'সময় বহিয়া যায়' কিন্তু জন্মদিন ফিরে ফিরে আসে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পত্রিকায় কলাম লিখতেন নিশ্চয়ই বিবেকের তাড়না থেকে, সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই- এটা বোঝা যায়। বস্তুত, ৮০ ও ৯০-এর দশকে আমার মতে তিন শীর্ষ কলাম লেখকদের একজন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যিনি গাছপাথর ছদ্মনামে 'সময় বহিয়া যায়' শিরোনামে সেই সময়ের বহুল প্রচারিত 'সংবাদে' দীর্ঘকাল একটানা লিখেছেন। অন্য দু'জন হলেন- আবুল কালাম শামসুদ্দিন, অল্পদর্শী নামে 'বৈহাসিকের পার্শ্বচিন্তা' শিরোনামে আর সন্তোষ গুপ্ত লিখতেন অনিরুদ্ধ ছদ্মনামে। সেই স্কুলজীবনেই চাতক পক্ষীর মতো অপেক্ষায় থাকতাম এঁদের কলাম পড়ার জন্য। অনেকেই 'সংবাদ' রাখতেন শুধু এঁদের কলাম পড়ার জন্য।
কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করতে চাই। এতে মানুষ জানতে পারবে শিক্ষক হিসেবে, গুরু হিসেবে ও মানুষ হিসেবে তিনি কেমন। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাঁর লেখা নিয়মিত কলাম 'সময় বহিয়া যায়' অনেক অল্প বয়স থেকেই পড়ে পড়ে আমি তাঁর ভক্ত হয়ে উঠেছি। বস্তুত, আমি যে সমাজবাদী, ইহজাগতিক, সাম্যনিষ্ঠ, মানবিক মননের অধিকারী হতে পেরেছি, এর পেছনে যাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আমার কলেজ জীবনের শিক্ষক লিওনার্ড শেখর গোমেজ একদিন আমাকে তাঁর নিজের মোটরসাইকেলে চড়িয়ে নিয়ে গিয়ে তাঁর শিক্ষক এই গাছপাথরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন, 'স্যার, ও আপনার একজন ভক্ত। আপনার কাছে মাঝে মাঝে আসবে। ওকে একটু সময় দিয়েন!' সেই যে সম্পর্ক তৈরি হলো, যে সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে।
কত কিছু যে শিখেছি তাঁর কাছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। তিনি সাদা দলের নেতা, উপাচার্য হওয়ার জন্য মনোনীত হয়েছিলেন- এই রকম একজন মানুষ কলাভবনে দেখা হলেই টিচার্স লাউঞ্জে নিয়ে গিয়ে খাওয়াতেন আর গল্প করতেন। তাঁর বাড়িতে গেলে বিপত্নীক তিনি নিজ হাতে কফি বানিয়ে খাইয়েছেন। স্যারকে আমি ফোন করেও মাঝে মাঝে এটা, ওটা জানতে চেয়েছি। একদিন আমি হুমায়ুন আজাদের 'সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে' অনুবাদ করতে গিয়ে 'নষ্টদের' ইংরেজি অনুবাদ কী হবে বুঝতে পারছিলাম না। স্যারকে ফোন করে জানতে চাইতেই বললেন, 'দ্য স্পয়েল্ট'। বিশ্বরাজনীতি নিয়েও টেলিফোনে অনেক সময় ধরে কথা বলেছি। কখনও বিরক্ত হননি। সে জন্যই বলি, তাঁর কাছে আমার ঋণের পরিমাণটা একটু বেশিই। একদিন বড় হয়ে পত্রিকায় কলাম লিখব, জনগণের মানস গঠনে ভূমিকা রাখব- এই স্বপ্নটা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাছ থেকেই পাওয়া। গদ্যের মধ্যেও, কান পাতলে, পাঠক শুনতে পাবেন ছন্দের রিনিঝিনি- এর দীক্ষাগুরুও তিনি।
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক ২০০৩ সালের দিকে আমাকে একদিন বলেছিলেন, 'হুমায়ূন আহমদের বই যেমন এখন বিক্রি হয়, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা যে কোনো বই পুরো আশি ও নব্বই দশকজুড়ে এভাবে বিক্রি হয়েছে।' বস্তুত, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কলাম ও বই আমার আগের প্রজন্ম, আমার প্রজন্ম ও পরের প্রজন্মের মনন গঠনে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। অনেকেই হয়তো তাঁর আরাধ্য সমাজতন্ত্রকে জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেনি, কিন্তু শ্রেয়বোধ, কল্যাণচেতনা ও সমন্বিত জীবনচেতনা প্রথিত করেছে তাঁর লেখা, এই তিন প্রজন্মের একটা বড় অংশের মধ্যে। আমি নিজে মার্পবাদের সংস্পর্শে আসি স্কুলজীবনেই পারিবারিক আবহে। কিন্তু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কলাম ও বই আমার মার্পীয় চেতনাকে দৃঢ় ও শানিত করেছে, আজও করছে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাহিত্য সমালোচনা আর দশ জনের চেয়ের আলাদা। কারণ, এই কঠিন কাজটি তিনি করেন ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের আলোকে। ইতিহাসচেতনার ও সমাজতত্ত্বের জ্ঞান ছাড়া যে সাহিত্য সমালোচনা, তা যথার্থ সাহিত্য সমালোচনা নয়। একটি উদাহরণ দিই। বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে তিনি লিখেছেন : 'বঙ্কিমচন্দ্র নায়ক খুঁজতে গিয়ে দেখতে পেলেন পরাধীন দেশে নায়ক পাওয়া কঠিন। নায়কের খোঁজে তিনি ইতিহাসের কাছে গেলেন, গেলেন জমিদার বাড়িতে, দেখলেন নায়করা সবাই রিপুর সেবক, আরও দেখলেন মেয়েরা এই পরাধীনদের ঘরে পরাধীন; দেখলেন, বন্দি মেয়েরা অনেক সময় পুরুষকে হারিয়ে দেয়; দেখলেন, পুরুষরা যথার্থ পুরুষ নয়। নবকুমার আশ্রয় দিতে পারে না কপালকুণ্ডলাকে; দেখলেন, উদার সৌন্দর্যকে স্থান করে দেবে এমন আশ্রয় নেই তাঁর নায়কদের গৃহে। কুন্দনন্দিনী তাই আত্মহত্যা করে; দেখলেন, মানুষগুলো সব আবদ্ধ একটি বৃহৎ কারাগারে। তারই ভেতর তাদের ওঠাবসা, যুদ্ধ ও প্রেম।'
এক অগ্রজ কবি আমাকে অনেক কাল আগে বলেছিলেন, "সাহিত্য সমালোচনা কী জিনিস, তা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর 'কুমুর বন্ধন' না পড়লে বুঝতে পারবে না। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস, যোগাযোগ ও কুমুর চরিত্র আর কেউ এমনভাবে ব্যাখ্যা করেতে পারেননি।" এ কথা শুনেই আমি বইটি সংগ্রহ করি এবং একটানা পড়ে ফেলি। এটি পড়ে একদিকে আমি সাহিত্য পাঠের আনন্দ লাভ করি, আবার অন্যদিকে, পড়তে পড়তে কোথায় যেন হারিয়ে যাই।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সমাজবাদী চেতনা ও তার অনুশীলন আর কর্তব্যপরায়ণতা বিস্ময়কর। ঢাকা শহরে আমাদের বাসায় প্রতি বছর তিন-চারবার অনুষ্ঠান করতাম যেখানে শাস্ত্রীয় সংগীতের আয়োজন থাকত। জাতীয় পর্যায়ের অনেক বুদ্ধিজীবী আমার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কখনও আসেননি। না যাওয়ার জন্য অনুযোগ করতেই একদিন তিনি বললেন, 'কোনো অনুষ্ঠান যদি সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে সমষ্টির উদ্যোগে হয়, একমাত্র তাহলেই আমি যেতে পারি। উদ্দেশ্য যদি হয় দাওয়াত খাওয়া, আমি যাই না।' আমার আর কোনো অনুযোগ থাকল না এবং তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল বহুগুণ। যেদিন তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়, তিনি সেদিনও এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে। বক্তৃতা করলেন পুরোটা সময় এবং তাঁর সেই চিরচেনা স্বভাবসুলভ আলোচনামুখরতায় কোনো ছন্দপতন লক্ষ্য করা যায়নি। এ ঘটনাটি আমার জানা ছিল না। আমাকে বলেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, 'বি দ্য চেইঞ্জ দ্যট ইউ উইশ টু সি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।' সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গান্ধীবাদী নন, কিন্তু গান্ধীর এই উক্তিটির এমন অনুশীলন সারাটা জীবন করে গেছেন। সমাজতন্ত্রের আদর্শকে সারাজীবন হৃদয়ে ধারণ করেছেন, চর্চা করেছেন ও প্রচার করেছেন। কোনো দিন এতটুকুও বিচ্যুত হননি।
অত্যন্ত কঠিন বিষয় সহজবোধ্য করে লিখতে পারার জাদুকরী ক্ষমতা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখার প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাঁর লেখার মধ্যে ঘুরে ফিরে পুঁজিবাদের অশুভ ও সর্বগ্রাসী চারিত্র্য এবং সমাজতন্ত্রের কল্যাণকর দিকগুলো বারবার আসে, কিন্তু তা পাঠকের মধ্যে একঘেয়েমি সৃষ্টি করে না। কারণ যেসব ঘটনা সাধারণ মানুষের জীবনকে স্পর্শ করে, তিনি সুকৌশলে সে সব ঘটনার অবতারণা করেন এবং তা ব্যাখ্যা করেন তত্ত্বের আলোকে উপমার মধ্য দিয়ে। তিনি একবার লিখলেন, 'মোটরসাইকেলের মধ্যে একটা উদ্ধত ভাব আছে, কিন্তু বাইসাইকেলের মধ্যে আছে বিনয়।'
তাঁর লেখার আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো, গদ্যের মধ্যেও একটি ছন্দ আছে, যা পাঠক খুব সহজেই অনুভব করেন। তাঁর সদ্য প্রয়াত স্ত্রীকে নিয়ে লেখা 'বন্ধুর মুখচ্ছবি' সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ছাপা হয়েছিল। 'বন্ধুর মুখচ্ছবি'র মর্মস্পর্শী ভাষা পাঠককুলকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। বাজার থেকে সব কপি উধাও হয়ে গেলে আমরা একে অপরকে বেদনাবিধুর এই গল্পটি ফটোকপি বিলি করেছি। একদিন তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। ঘটনা খুলে বললাম। 'নাজমা জেসমিন চৌধুরী স্মারকগ্রন্থের' একটাই কপি স্যারের কাছে ছিল। তিনি সেটাই আমাকে দিয়ে দিলেন। এক পর্যায়ে আমি তাঁকে বললাম, 'স্যার, আপনি লেখেন গদ্য, কিন্তু পড়লে মনে হয় আমি কবিতা পাঠ করছি। আপনি কবিতা লেখেন না কেন?' তিনি হাসলেন আর বললেন, 'বর্তমানে যাঁরা কবিতা লিখছেন, তাঁদের চেয়ে ভালো যেদিন লিখতে পারব, একমাত্র সেদিনই তা প্রকাশ করব। আবর্জনা লিখে পাঠকের সামনে হাজির করতে চাই না।'
পিতার মৃত্যু ও স্ত্রীর মৃত্যু ভীষণভাবে আঘাত করেছিল এই স্থিতপ্রজ্ঞ মানুষটিকেও। প্রথম মৃত্যুটি ঘটে তাঁর ইংল্যান্ডের প্রবাস জীবনে। আগেই বলেছি, 'বন্ধুর মুখচ্ছবি'র মর্মস্পর্শী ভাষা পাঠককে অশ্রুসিক্ত করে। তিনি লিখেছেন, 'ঐ বিদেশ বিভুঁইয়ে, পিতার মৃত্যুর খবর নিয়ে, তুমি ছাড়া, বলো নাজমা, আর কার কাছে যাব?' এর পর তিনি লিখছেন, 'আমার কি জন্ম হয়েছিল, নাজমা, তোমার সঙ্গে পরিচয়ের আগে? আমি জানি না; কিন্তু পিতার মৃত্যুর সেই অন্ধকারে আরেকটি জন্মের ঘটনা ঘটেছিল, সেটা জানি।' স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি লিখছেন, '... অন্ধকার আর এক রকমের হয়, রোমান্টিক ধারণার মতো। সেই অন্ধকার খুব প্রিয় ছিল তোমার, যে অন্ধকারে আকাশে তারা জ্বলে মিটি মিটি কিংবা গুচ্ছ গুচ্ছ ...।' কত ভালো হতো নিজের মৃত্যুর পরে গিয়ে যদি প্রিয়তমা স্ত্রীর সঙ্গে আবার দেখা হতো! কিন্তু হায়! মৃত্যুই যে জীবনের সীমারেখা। নাজমা জেসমিন চৌধুরী, তাঁর সেই প্রিয়তমা স্ত্রী, যিনি একদা অন্ধকার আকাশের মিটি মিটি তারার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে আসলে কি আর দেখা হবে? হবে না!
মন্তব্য করুন