- চতুরঙ্গ
- 'হে মোর বন্যা তুমি অনন্যা'
'হে মোর বন্যা তুমি অনন্যা'

অংকন চট্টোপাধ্যায়
রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী,কলকাতা
প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২১
আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২১
প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২১ । আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২১
তখন জানুয়ারি মাস, কলকাতার একটি প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠান, গাইবেন দুই বাংলার দুই বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। এপারের প্রমিতা মল্লিক ও তার এক শিষ্য; ওপারের রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও তার এক শিষ্য। চারজনের এই পরম্পরা-চর্চা। তখন সবে এগারো ক্লাস পাস করেছি।
যেহেতু ছোট থেকেই গান গাই তাই এক বন্ধুর কৃপায় এক দিন শোনা হলো 'মংপুর দিনগুলি বন্যার গানে'। এরপর 'অভিসার', বন্যাদি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যুগল সংকলন। তারপর 'লাগুক হাওয়া', 'বারতা পেয়েছি মনে মনে' এভাবে এক এক করে প্রায় সবই। তখনও রবীন্দ্রনাথের গান আসলেই কী জানি না। স্কুলে যেটুকু শেখায় তার বাইরে গাইও না। নজরুল গাই, ধ্রুপদি সংগীত করি। রবীন্দ্রনাথের গান তখন আমার কাছে আরও অনেকের মতোই 'ন্যাকা ঢঙে' গাওয়ার গান। কিন্তু সর্বনাশ ঘটাল এই অ্যালবামগুলো। এসব গান শুনে প্রথম মনে হলো, রবীন্দ্রনাথের গান খোলা হাওয়ার মতন, ফুলের পরশের মতন, স্নিগ্ধ, শীতল, অতল, গভীর। তখন কি-ই বা বয়স! জীবনকে দেখিওনি কিছুই। তবুও বন্যাদির গলায় গানগুলো শুনে মনে হতে লাগল এ তো আমারই গান। যা আমি বলব তা তো এমনই হওয়া উচিত। এই করে করেই যেন নেশা লেগে গেল। তখনও অ্যান্ড্রয়েড ফোন আসেনি হাতে, ছোট স্ক্রিনের ফোনে সারাদিন ধরে খুঁজে খুঁজে চালাতে লাগলাম বন্যাদির গানের কালেকশন। কালেকশন করতে করতে কলেজে উঠে গেলাম। কলেজের সামনে ফ্রি ওয়াইফাই পেতাম, সেখানে বৃষ্টিতে কোনোক্রমে ছাতা মাথায় দিয়েও চলত বন্যাদির গানের খোঁজ। এই খোঁজার মাঝেই এক দিন সেই অনুষ্ঠান।

অনুষ্ঠান শুরু হলো। ভেবে রেখেছি, যা যা গান তিনি গাইবেন তার মধ্যে একটাও যদি ওর রেকর্ডে না থাকে সেইটা মোবাইলে রেকর্ড করতে হবে। সেদিন বন্যাদির পাশে বসে রয়েছেন বাংলাদেশের আরেকজন গুণী শিল্পী, সুমায়া ইমাম ইমা। চারজন পরপর গাইছেন বটে, কিন্তু সেদিন আমি কেবলই দেখে যাচ্ছি বন্যাদিকে। হালকা হলুদ সিল্কের শাড়িতে, খোলা চুল আর হিরের নাকফুল পরা একজন স্বর্গের দেবী যেন অধিষ্ঠিত রয়েছেন। কী মোহাবিষ্ট করে দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হলো!
সেদিন শেষ গান গাইলেন বন্যাদি। 'তোমায় নতুন করে পাব বলে'। বুকে সাহস নিয়ে গেলাম তাকে প্রণাম করতে। কথাও হলো। মাথায় হাত রাখলেন। রাত্রিতে আনন্দের চোটে যেন উড়তে উড়তে বাড়ি ফিরলাম। অথচ তখন কেবল তার গানটুকুই চিনি, মানুষ বন্যাকে তখন একবিন্দুও চিনিনি। যখন কিছুটা চিনেছি অনেকটা বড় হয়েছি ততদিনে। ইউটিইউবে তার সমস্ত সাক্ষাৎকার শোনা হয়েছে, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছি তার কথা, তার বোধ। শুনেছি, কেমন করে শান্তিনিকেতন তার আপনজন হয়ে উঠেছিল, কেমন করে মোহরদির পায়ের কাছটিতে বসে তিনি নিজের আধারকে গান দিয়ে ভরে নিয়েছিলেন। মোহরদি অর্থাৎ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় আর বন্যাদিকে নিয়ে সে সময় শান্তিনিকেতনে একটি মিথ্যা রটনা ছিল, বন্যাকেই পক্ষপাতিত্ব করে সব সময় সর্বত্র নাকি বেশি সুযোগ করে দেন মোহরদি। সেই কথার পরিপ্রেক্ষিতে মোহর দিকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি নাকি বলেছিলেন, 'বন্যাকে কেন বেশি করে দিই জান? কারণ বন্যা গানের জন্য পাগল। যার শেখবার খিদে অপরিসীম, তাকে শিখিয়েও তো শান্তি।' সত্যিই, গানের সঙ্গে এমন বিশ্বস্ত বন্ধুতা বন্যাদির মতো মানুষই রাখতে পারেন।
একটা ছোট্ট গল্প মনে পড়ে গেল, যেটি মনে করলে ভক্ত হিসেবে আমার বারবার শিক্ষা হয়। একবার আমেরিকায় থাকাকালে বন্যাদির পিতার প্রয়াণ ঘটে। সেই সময়, অত তাড়াতাড়ি ফেরা সম্ভব নয় তো বটেই, উপরন্তু সেই দিনই একটি ওয়ার্কশপও নিতে হবে তাকে। বন্যাদির সবচেয়ে কাছের জন চলে যাওয়ার দুঃখ, আকস্মিক মৃত্যুর খবর মেনে নিতে না পারা সব মিলিয়ে অস্থির তিনি সেই সময় কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেন না, কিন্তু তবু তিনি ক্লাসটি নিতে গিয়েছিলেন। সবাই বারণ করার পরেও তিনি গান শিখিয়েওছিলেন। কেবল গান গাইবার সময় তার দুই চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমেছিল। গান এসে তার কান্নায় করস্পর্শ করে তাকে শান্ত করে গিয়েছিল। গান আর বন্যার এমনই অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক।
শিল্পী বন্যার কথা ছেড়ে দিলেও যত কিছু পড়ে থাকে সেই সব দিয়েও একজন ভক্ত হিসেবে আমার গর্বে, ভালোবাসায়, আনন্দে বুক ভরে যায়। তার সমাজসেবা, তার ভবিষ্যতের নানান সুচিন্তন আগামীদিনে কত শুভ কাজ করে যাবে তা আমরা যারা বন্যাদিকে জানি, তারা সবাই একবাক্যে মানব।
আজ আমাদের সুরের দেবী বন্যাদির জন্মদিন। তার কণ্ঠ চিরসবুজ থাকুক। শান্তিনিকেতন আর বাংলাদেশের মাটি তার পদচিহ্নের আলিম্পন হয়ে সমগ্র বিশ্বে ছাপ রেখে দিক। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ বোধহয় জানতেন ভবিষ্যতে এমন কেউ আসবেন যিনি তার গানকে এতখানি পূর্ণতা দেবেন। তাই হয়তো 'শেষের কবিতা'য় তিনি লিখে গিয়েছিলেন, 'হে মোর বন্যা তুমি অনন্যা, আপনি স্বরূপে আপনি ধন্যা'।