
বন্যার পানিতে ভেসে গেছে ঘর। দিনমজুর জাকারিয়া বউ-বাচ্চা-শাশুড়িসহ আশ্রয় নিয়েছেন সড়কে। এ বছর তাঁদের কোরবানি হবে না, মিলবে না নতুন পোশাকও। পরিবার নিয়ে ঈদ করবেন রাস্তায়। মঙ্গলবার সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের জাতুয়া এলাকা থেকে তোলা ছবি -ইউসুফ আলী
সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক ধরে ৩০-৩২ কিলোমিটার যাওয়ার পর জাতুয়া ব্রিজ। চারদিকে পানিতে থইথই করা ব্রিজের কাছে রাস্তার পাশে আশ্রয় নিয়েছে অনেক পরিবার। তাঁদের মধ্যে ছাতক উপজেলার দক্ষিণ কুরমা ইউনিয়নের মহৎপুর গ্রামের রোজিনা বেগমও আছেন। সোহান, সোহানা, সোহাগ নামের তিন শিশুসন্তান আর দিনমজুর স্বামী জাকারিয়া আমিনকে নিয়ে এক মাস ধরে রাস্তার পাশেই তাঁর সংসার। পানি সামান্য কমলেও বানের জলে বাড়িঘর ভেসে গেছে। বাধ্য হয়ে নিজের ও মায়ের পরিবারসহ রাস্তার পাশে আশ্রয় নিয়েছেন রোজিনা। আর চার দিন পর পবিত্র ঈদুল আজহা। তবে এবারের ঈদ রাস্তায় কাটাতে হবে বলে আশঙ্কা করছে রোজিনার পরিবার।
গত ১৪ জুন থেকে ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সিলেট এবং সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। দীর্ঘ ২০-২২ দিন ধরে দুই জেলার বিপুলসংখ্যক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। সরকারি হিসাবে, প্রাথমিকভাবে দুই জেলায় লক্ষাধিক বাড়িঘর আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য মিলেছে। গতকাল সিলেটে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে প্রাপ্ত অর্থ বন্যায় গৃহহীনদের বাড়িঘর মেরামতের জন্য বিতরণ করা হয়েছে। এজন্য বরাদ্দকৃত পাঁচ কোটি টাকা থেকে প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় কার্যত বিধ্বস্ত সুনামগঞ্জে বন্যাকবলিত পরিবারের মধ্যে আরও তিন দিন আগে বিতরণ শুরু হয়েছে। স্থানীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা হয়েছে।
মে মাসের পর মাত্র পনেরো দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফা বন্যায় সিলেট বিভাগে অর্ধকোটি মানুষ প্লাবিত হন। সরকারের পক্ষে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দেওয়া শুরু হলেও অনেকে তালিকাভুক্ত হননি। জাতুয়া ব্রিজের পাশে স্বী-সন্তানসহ আশ্রয় নেওয়া জাকারিয়া বলেন, বন্যায় সব শেষ হয়ে গেছে। তাই রাস্তার পাশে ঘর বানিয়ে কোনো রকমে দিন পার করছি। পাশ থেকে স্ত্রী রোজিনা বলেন, রাস্তার পাশে বলে গাড়ি গেলেই সাহায্যের আশায় থাকি। কিন্তু এখানে গাড়ি থামে না। সবাই গাড়িভর্তি ত্রাণ নিয়ে দূরে চলে যায়।
পার্শ্ববর্তী জাতুয়া মদন গ্রামের আব্দুল খালিক ও ফেলিনা বেগম দম্পতি এক ছেলে ও পাঁচ মেয়েকে নিয়ে রাস্তার পাশে আশ্রয় নিয়েছেন। খালিক বলেন, বাড়িঘর নেই, সব পানিতে গেছে। যেখানে ঘর ছিল, সেখানে এখনও পানি। পানি নামলেও যে ঘর বানাব, তার সামর্থ্যও নেই। সরকার থেকে কিছু দিলে সন্তানদের নিয়ে বাঁচতে পারব। নইলে ভিক্ষা করতে নামতে হবে। দুই স্ত্রী রোকেয়া ও লালবিকে রাস্তার পাশে আশ্রয় নিয়েছেন আম্বর আলী। তাঁদের সঙ্গে ছয় বছরের নাতি আরমানও ছাপড়া ঘরে আছে। আম্বর আলী বলেন, ২০-২৫ দিন ধরে পরিবার নিয়ে রাস্তার পাশে আছি। কষ্ট হলেও থাকতে হবে, যাওয়ার জায়গা নাই।
সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক ধরে এগিয়ে গেলে রাস্তার পাশে আশ্রয় নেওয়া মবশ্বির বলেন, মাটির দেয়ালের ঘর ছিল। বানের পানিতে ভেঙে গেছে। তাই রাস্তার পাশে বউ-বাচ্চা নিয়ে আছি। আমাদের সঙ্গে দুটো গরুও আছে। এগুলোকে কোথায় রাখব, খাবার দেব কী? তিনি বলেন, গরুগুলোর সঙ্গে থাকতে কষ্ট হয়। পাশে ছাপড়া ঘরে বৃদ্ধা মল্লিকা বেগমের সঙ্গে আছে ১১ বছরের নাতি জহুর আলী। তিনি বলেন, এখনও ঘর থেকে পানি নামেনি। আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারিনি। বৃষ্টি হলে ছাপড়া ঘরে পানি পড়ে। এসবের মধ্যেই বেঁচে আছি।
এই সড়কের দুই পাশে অসংখ্য বন্যার্ত মানুষ ও গবাদি পশুর বেঁচে থাকার লড়াই দীর্ঘ হচ্ছে। চলতি বছরে তিন দফা বন্যায় অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। বন্যার পানিতে ভিজে যাওয়া সামান্য ধান-চাল রাস্তার পাশে শুকানোর চেষ্টা করছেন আরিফা। তিনি বলেন, আগের বন্যায় বেশির ভাগ ফসল নষ্ট হয়েছে। এবারের বন্যা সামান্য যেটুকু ছিল, তাও শেষ। ঘরে পানি উঠতে শুরু করার পর এক কাপড়ে বেরিয়ে আসেন নাজমা বেগম। তিনি বলেন, বাচ্চাদের পরানোর মতো বাড়তি কাপড় নাই। কার কাছে যাব।
সুনামগঞ্জ জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ রয়েছে। তবে বিভিন্ন রাস্তা বা সড়কের পাশে যাঁরা আছেন, তাঁদের হিসাব নেই বলে জানান তিনি। স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি বলেন, বাড়তি ত্রাণের আশায় অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে রাস্তার পাশে থাকছেন। এমন অভিযোগ অস্বীকার করে কুতুব উদ্দিন বলেন, বন্যায় মানুষ-পশু সব এক হয়ে গেছে। ঘরের মহিলাদের নিয়ে রাস্তার পাশে আশ্রয় নিয়েছি কি শখ করে? আমাদেরও তো লজ্জাশরম আছে। কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের বাধ্য করেছে।
সুনামগঞ্জে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, নদীর পানি ধীরে ধীরে কমছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে পানি খুব ধীরে কমছে বলে জানান তিনি। গতকাল বিকেল ৬টায় পাউবোর তথ্য অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি কমেছে। কানাইঘাটে সুরমার পানি সর্বোচ্চ দশমিক শূন্য ৯ সেন্টিমিটার কমেছে। অন্যদিকে কুশিয়ারার পানি অমলসিদ ও শেওলা পয়েন্টে দশমিক শূন্য ৮ সেন্টিমিটার কমেছে। তবে ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে কমেছে মাত্র দশমিক শূন্য এক সেন্টিমিটার। সব পয়েন্টে নদীর পানি এখনও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গতকাল বন্যা-পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলা ও আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে সুনামগঞ্জে মতবিনিময় করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। বন্যাদুর্গতদের পুনর্বাসন কাজ শিগগিরই শুরু হবে বলে জানিয়েছেন দুই মন্ত্রী।
মন্তব্য করুন