
রাজধানীর ধূপখোলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে রাতের আঁধারে চলছে মার্কেট নির্মাণের কাজ- সমকাল
ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে উপমহাদেশের অন্যতম পরিচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল জগন্নাথ কলেজ। ১৬৩ বছরের ঐতিহ্য বহন করে চলা প্রতিষ্ঠানটি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়। কিন্তু ৩০ একর আয়তনের এ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভবিষ্যৎ কী, তা জানেন না শিক্ষক-শিক্ষার্থী বা প্রশাসনের কেউই। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কেরানীগঞ্জে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন হলে পুরোনো জায়গা একেবারে ছেড়ে দিতে হবে। তখন সেই জায়গায় কী হবে, তা নিয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্নিষ্টরা চাচ্ছেন, জায়গাটি যেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই থাকে। অন্তত একটি ফ্যাকাল্টি এখানে রেখে বহু বছরের পুরোনো ঐতিহ্য রক্ষা করা যায়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জায়গার অধিকাংশ এরই মধ্যে বেদখল হয়ে গেছে। ১২টি হোস্টেলের মধ্যে ৯টিই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে নেই। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এগুলো ভেঙে মার্কেটসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন, প্রভাবশালী মন্ত্রীরা প্রতিশ্রুতি দিলেও বেদখল হল উদ্ধারে কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র খেলার মাঠটিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মার্কেট নির্মাণের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করেছে।
জানা যায়, ১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল। ১৮৭২ সালে তার নাম বদলে করা হয় 'জগন্নাথ স্কুল'। বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী তার বাবার নামে এ নামকরণ করেন। ১৮৮৪ সালে এটি দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজ এবং ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজে পরিণত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে জগন্নাথ কলেজের স্নাতক কার্যক্রম বন্ধ করে এখানকার ডিগ্রির শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গ্রন্থাগারের বই, জার্নাল সেখানে স্থানান্তর করা হয়।
কয়েকজন সাবেক শিক্ষার্থী জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জগন্নাথ কলেজেও গণহত্যা চালানো হয়। যুদ্ধে এ কলেজের কয়েক হাজার শিক্ষক ও শিক্ষার্থী শহীদ হন। যুদ্ধ শেষে এখানে গণকবর পাওয়া যায়। উদ্ধার করা হয় কয়েক ট্রাক মানুষের কঙ্কাল। ১৯৮২ সাল থেকে এলাকার প্রভাবশালীরা জগন্নাথ কলেজের হোস্টেলগুলো দখলের চেষ্টা শুরু করেন। ছাত্রদের সঙ্গে এলাকাবাসীর সংঘর্ষ হয় কয়েকবার। সর্বপ্রথম হাতছাড়া হয় কুমারটুলী ছাত্রাবাস। এরপর একের পর এক বেদখল হতে থাকে হোস্টেল। ১৯৯২ সাল নাগাদ মাত্র তিনটি হোস্টেল কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকে। বাকিগুলো পুলিশ ও এলাকাবাসী দখল করে নেয়।
প্রভাবশালীদের দখলে ৯ হল: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ অনুযায়ী কলেজের সব সম্পত্তি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য মুসিহ মুহিত অডিট ফার্মকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ফার্মটির অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১২টি হোস্টেল ছিল। পাটুয়াটুলীর ওয়াইজঘাট ৮ ও ৯ নম্বর জিএল পার্থ লেনের ৮ দশমিক ৮৮৯ কাঠার ওপর তিব্বত হলটি দখলের অভিযোগ রয়েছে সাংসদ হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে। ২০০১ সালে হলটির স্থানে 'গুলশান আরা সিটি মার্কেট' নির্মাণ শুরু করেন তিনি। প্রতিবাদে কয়েক দফা আন্দোলনেও নামেন জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা। তিনি অবশ্য বরাবরই জায়গাটি তার নিজস্ব বলে দাবি করেন।
আরমানিটোলার এসি রায় রোডে আবদুর রহমান হলটি এখন পুলিশ সদস্যদের আবাস হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। আরমানিটোলা মাহুতটুলীর ১ নম্বর শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী রোডের ৪০ কাঠা জমিতে শহীদ আনোয়ার শফিক হলটি স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে। যদুনাথ বসাক লেন, টিপু সুলতান রোডের সাইদুর রহমান হল ও রউফ মজুমদার হল দুটির বর্তমানে অস্তিত্ব নেই। পাটুয়াটুলীর ১৬ ও ১৭ নম্বর রমাকান্ত নন্দী লেনের শহীদ আজমল হোসেন হল দখল করে একসময় পুলিশ সদস্যদের কিছু পরিবার থাকত। এর কিছু অংশে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন সমিতি। ১৯৯৬ সালে এর একাংশ দখল করেন স্থানীয় মোশারফ হোসেন খান। বংশালের ২৬ নম্বর মালিটোলায় বজলুর রহমান হলের ভবনে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে শহীদ জিয়াউর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ১৯৮৫ সালে স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষে ছাত্ররা হলটি ছাড়তে বাধ্য হয়। তাঁতীবাজারের ঝুলনবাড়ী লেনে শহীদ শাহাবুদ্দিন হল দুই যুগেরও বেশি সময় পুলিশের দখলে ছিল। ২০০৯ সালের জুনে আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল হক এর দখল নেন। পাটুয়াটুলীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ছয়তলা আবাসস্থলের জায়গায় তৈরি হয়েছে ক্রাউন মার্কেট। ওবায়দুল্লাহ নামের একজন মালিকানার দাবিদার।
উদ্ধারে গতি নেই: ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক মাসের মধ্যে ১২টি হল ও বেদখল হওয়া অন্যান্য সম্পত্তি উদ্ধার করতে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করে। ২০০৯ সালের মার্চে পাঁচটি হল (আনোয়ার শফিক হল, শাহাবুদ্দিন হল, আজমল হোসেন হল, তিব্বত হল ও হাবিবুর রহমান হল) বিশ্ববিদ্যালয়কে ইজারা দেওয়ার সুপারিশ করে কমিটি। একই বছরের ৫ মে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঁচটি হলের দীর্ঘমেয়াদি লিজের আবেদন করে। ৯ জুলাই ভূমি মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেয়। ২০১০ সালের ২১ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক আইনগত সুবিধার্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে হলগুলো লিজের পরিবর্তে অধিগ্রহণের ব্যবস্থা নিতে বললেও একাধিক মন্ত্রণালয়ের সংশ্নিষ্টতা ও আইনি জটিলতায় হল উদ্ধার কার্যক্রম থমকে থাকে। ২০১১ ও ২০১৪ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে মালিটোলার ড. হাবিবুর রহমান হল ও গোপীমোহন বসাক লেনের নজরুল ইসলাম হল উদ্ধার করা হয়। ড. হাবিবুর রহমান হল সংস্কার করে কর্মচারীদের দেওয়া হলেও নজরুল ইসলাম হল ব্যবহারের অনুপযোগী। এ ছাড়া ৩৫ ও ৩৬ প্যারিদাস রোডের ১ নম্বর ঈশ্বরচন্দ্র দাস লেনে ১০ কাঠার বাণী ভবনের কিছু অংশ বেদখল হয়ে গেলেও সিংহভাগ দখল করে এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা সেখানে বসবাস করছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি কর্মকর্তা কামাল সরকার বলেন, কেরানীগঞ্জে নতুন ক্যাম্পাসের কাজ চলমান। কলেজ আমলের ১২টি হলের মধ্যে হাবিবুর রহমান হল, বাণী ভবন ও নজরুল ইসলাম হলের একাংশ আমাদের দখলে আছে। বাকি হলগুলো উদ্ধারে কোনো কার্যক্রম চলমান নেই।
খেলার মাঠে মার্কেট: ধূপখোলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে মার্কেট নির্মাণ প্রকল্পে অনড় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আপত্তি উপেক্ষা করে রাতের আঁধারে চলছে মাঠ খনন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, সিটি করপোরেশনের মেয়র আশ্বাস দিলেও তাদের না জানিয়েই মাঠে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করা হয়েছে। কিছুদিন আগে প্রকল্পের কাজের অংশ হিসেবে মাঠের বিশ্ববিদ্যালয় অংশে খুঁটি স্থাপন করা হয়। পরে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনের কারণে তা তুলে ফেলা হয়। এরপর এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বৈঠক করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এদিকে ২৬ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাঠ খননের কাজ শুরু করে। কাজ থামাতে আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়ার কথা বলছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। জানা যায়, ঢাকার গেণ্ডারিয়া থানার ধূপখোলায় অবস্থিত এ মাঠকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাগ দেওয়া হয় তৎকালীন জগন্নাথ কলেজকে। আরেকটি অংশ একটি ক্লাবের কাছে। অপর অংশটি জনসাধারণের খেলাধুলার জন্য রাখা হয়। এটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ। এখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা তাদের বিভিন্ন টুর্নামেন্ট পরিচালনা ও শরীরচর্চা করে থাকেন। এ মাঠেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
জগন্নাথ কলেজ ছাত্রসংসদের সাবেক ভিপি আলমগীর শিকদার লোটন বলেন, দেশের রাজনীতির ঐতিহ্যের অন্যতম পটভূমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। কোনোভাবে যেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি সরকার নিয়ে না নেয়।
তিনি বলেন, ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনিক ভবনটি রেখে এখানে একটি ফ্যাকাল্টি রাখা যেতে পারে। কোনোভাবে ঐতিহ্য বিলীন করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠটি প্রেসিডেন্ট এরশাদ জগন্নাথ কলেজকে দিয়ে গেছেন। মাঠটিতে গরুর হাট করতে করতে আজকে বিলীনের পথে। মার্কেট না করে ছাত্রদের জন্য মাঠটি সংস্কারের দাবি জানাই।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ও সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. কাজী সাইফুদ্দিন বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ক্যাম্পাস স্বর্ণমুদ্রার মতো। দেড়শ বছরের অধিক ঐতিহ্যের এ পুরোনো ক্যাম্পাস বিশ্ব ঐতিহ্যের সমতুল্য।
তিনি বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদয় সম্পত্তি সরকারের কাছে হস্তান্তর মানা হবে না। সরকারকে বিব্রত করতে তৎকালীন প্রশাসন এ ধরনের শর্তে রাজি হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী ওহিদুজ্জামান বলেন, উপাচার্য দেশে ফিরলে বেদখলকৃত হল উদ্ধারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। খেলার মাঠ রক্ষার্থে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশনে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
ক্যাম্পাসের জায়গা হস্তান্তরের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি সরকারের সিদ্ধান্ত।
মন্তব্য করুন