দীর্ঘ ৯ মাস কারাবাসের পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয় পাকিস্তান সরকার। তাকে পাঠানো হয় লন্ডনে। বঙ্গবন্ধু হিথ্রো বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেও সেখানে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে চাননি। ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি দৈনিক বাংলার সংবাদ বলছে- বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, 'আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন আমি সুস্থ আছি, বেঁচে আছি। এ মুহূর্তে আপনারা শুধু আমাকে দেখুন, কিছু শোনার আশা করবেন না। তাই এখন আমি আর বেশি কিছু বলতে চাই না। সম্ভবত আজকের পরে একটা বিবৃতি দিতে পারি।'

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাওয়ালপিন্ডি থেকে পাকিস্তান সরকারের চার্টার করা পিআইএর একটি বিশেষ বিমানে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হন। রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগের ১০ ঘণ্টা পর ৮ জানুয়ারি গ্রিনিচ সময় সকাল ৬টা ৩৬ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ১২টা ৩৬ মিনিট) হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছান। লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হওয়ার সাত ঘণ্টা পর বিষয়টি জানাজানি হয় বলে সেই সময়ের পত্রিকাগুলো সংবাদ প্রকাশ করে।

বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছে তিন ঘণ্টা বিমানবন্দরে অবস্থান করেন। পাকিস্তান ত্যাগের সময় তার গন্তব্য নিয়ে কিছুই জানানো হয়নি। এটুকুুই বলা হয় যে, বঙ্গবন্ধু বিমানে যে স্থানে গমন করেছেন, সেখানেই তিনি তার পরবর্তী কর্মসূচি জানাবেন। এ সময় পরনে ছিল টাইবিহীন সাদা শার্ট, ধূসর স্যুট ও ওভারকোট। তিন ঘণ্টা পর বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে ওয়েস্ট এন্ডের ক্লারিজ হোটেলের উদ্দেশে রওনা দেন। গাড়িতে ওঠার সময় তিনি সামনে বসতে পারেন কিনা- জিজ্ঞাসা করলে কর্মকর্তারা বলেন, অবশ্যই। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।

পরে হোটেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। তিনি বলেন, 'আমি এখানে আর এক মুহূর্ত থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।' বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানান, তিনি আগামীকাল বা পরের দিন ঢাকা ফিরবেন বলে আশা করছেন। বাংলাদেশ শিগগির জাতিসংঘে সদস্যপদের জন্য অনুরোধ করবে। বাংলাদেশের দাবিকে সমর্থনের জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্সকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ এখন অবিসংবাদিত সত্য এবং এদেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে।'

'জানতাম বাংলাদেশ মুক্ত হবেই'

লন্ডনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে সম্মেলন কক্ষে প্রবেশের সময় বঙ্গবন্ধু 'জয় বাংলা' স্লোগান দিয়ে সাংবাদিকদের অভিনন্দিত করেন। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক রাখবে- এমন কোনো প্রতিশ্রুতি তিনি ভুট্টোকে দেননি। দৈনিক বাংলা বিএসএস ও এনার বরাত দিয়ে করা সংবাদে জানায়, তিনি সেদিন দরাজ কণ্ঠে কথা বলেন; দেহে কোনো অসুস্থতার লক্ষণ ছিল না। বঙ্গবন্ধু বলেন, 'যখন তার জনগণ তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেছে, তখন আমি 'রাষ্ট্রদ্রোহের' দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কারাগারে বন্দি জীবন কাটাচ্ছি। এই ট্রাইব্যুনালের বিচারের রায় কখনও প্রকাশ করা হয়নি। একটি খুব খারাপ স্থানে কল্পনাতীত একাকিত্বে বন্দিজীবন কাটাতে হয়েছে। কোনো রেডিও না, চিঠি না, বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই ছিল না। মরার জন্য মনের দিক থেকে আমি প্রস্তুত ছিলাম। যেদিন জেলে নেওয়া হলো, তখন আমি বাঁচবো কিনা ধারণা ছিল না। তবে এটা জানতাম, বাংলাদেশ মুক্ত হবেই। আমার দেশের লাখ লাখ লোককে হত্যা করা হয়েছে, নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়েছে। বেঁচে থাকলে হিটলারও লজ্জা পেতো।'

পরিবারের সঙ্গে টেলিফোনে আবেগঘন আধাঘণ্টা

লন্ডন থেকে টেলিফোনে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম প্রশ্ন- বেঁচে আছো তো? ২৫ মার্চের দুর্বিষহ কালরাতের পর ৮ তারিখ শনিবার (১৯৭২) প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কথা শুরু করেন- 'তোমরা সবাই বেঁচে আছো তো?' সেই শনিবার সন্ধ্যার একটু আগে হোটেল থেকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আধাঘণ্টা কথা বলেন। লন্ডনে বঙ্গবন্ধু হোটেল ক্লারিজেসে অবস্থান করেন।

৯ মাস পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলছেন বেগম মুজিব

প্রথমে বড় ছেলে শেখ কামাল, পরে ক্রমান্বয়ে বেগম মুজিব, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও ছোট ছেলের সঙ্গে কথা বলেন। ঘটনাবহুল ও দুর্বিষহ ৯ মাস পর পরিবারের সদস্যরা পরস্পরের কণ্ঠ শুনতে পেলেন। বেগম মুজিব আবেগঘন কণ্ঠে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এনা পরিবেশিত খবরে বলা হয়, বেগম মুজিব সাংবাদিকদের জানান, তিনি আবেগে এত অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে, প্রথমবার কথা বলতে পারেননি। দ্বিতীয়বার কল এলে শেখ সাহেব জানতে চান- আমি কেমন আছি। আমি বললাম, 'আমরা ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন?'

রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা

লন্ডনে থাকাকালেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলেন এবং নয়াদিল্লি সফরের আমন্ত্রণ জানান। ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবুর রহমানের কুশল জানতে চেয়ে বলেন, 'আমরা খুবই খুশি- আপনি মুক্তি পেয়েছেন।' শেখ মুজিবুর রহমান ইন্দিরা গান্ধীর মাধ্যমে ভারতের জনগণকে অভিনন্দন জানান। এর পর ইন্দিরা গান্ধী জানতে চান- 'কেমন আছেন?'
জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'আমি ভালো আছি। আমি আপনাদের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ।' ৮ তারিখে তার কথা হয় সহযোদ্ধা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে যুক্ত হয়ে বলেন- 'হ্যালো তাজউদ্দীন, আমি সাংবাদিক পরিবৃত্ত আছি, তাদের কী বলবো? দেশের মানুষ কেমন আছে? বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে যে অগণিত নারী-পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছেন, এই মুহূর্তে তাদের কথা আমার জানতে খুব ইচ্ছে করছে।'

উদিসা ইসলাম: সাংবাদিক; সৌজন্যে বাংলা ট্রিবিউন