করোনা মহামারির আগের বছরের ধাক্কা নিয়ে ২০২১ সালের যাত্রা শুরু হয়। গুটিয়ে যাওয়া বিশ্বব্যবস্থায় সুখবর হয়ে আসে কভিড-১৯-এর প্রতিষেধক টিকা। ভাইরাস ও বিজ্ঞানের লড়াইয়ে কাবু এই ১২ মাসে মানবসভ্যতায় থেমে থাকেনি ঝড়-ঝঞ্ঝা, ক্ষোভ-বিক্ষোভ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, আধিপত্যের প্রতিযোগিতা। তার মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ানোর আহ্বানে প্রতিদিন উঠেছে নতুন সূর্য। ঘড়ির কাঁটার তালে টিকটিক করে পার হয়েছে আশা-নিরাশার ৩৬৫ দিন।
বিদায়ী বছরের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার পর উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ২০ জানুয়ারি দেশটির ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন জো বাইডেন। ট্রাম্পের নীতি বদলে জলবায়ু চুক্তি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইরান পরমাণু চুক্তি, নিউ স্টার্ট চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ফেরান বাইডেন। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ও আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে সোচ্চার হন তিনি। তবে নিজ দেশ ও বিশ্বে শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদী হুমকি নিয়েই তাকে নতুন বছর শুরু করতে হচ্ছে।
করোনার বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রধান অস্ত্র হিসেবে বিদায়ী বছরের বড় সাফল্য টিকা। উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি ডোজ টিকা, যার বেশিরভাগ রয়েছে ধনী দেশগুলোর গুদামে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ নাগাদ বিশ্বের সাড়ে ৪০০ কোটি মানুষ পেয়েছে করোনার প্রথম ডোজ টিকা। তবে বারবার রূপ বদলে দাপট দেখিয়ে চলেছে করোনার নতুন নতুন ধরন। সর্বশেষ 'ডেলমিক্রন' নামে একটি ধরন নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। এ নিয়ে ২০২২ সালেও ঘাম ঝরাতে হতে পারে বিশ্বকে।
প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরিতেই আটকে যায় বিশ্বনেতাদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলন। ৩১ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বরের এ সম্মেলনে কয়লার ব্যবহার বন্ধে ভারত ও চীন দূরবর্তী লক্ষ্য দিয়েছে। তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ধরে রাখার প্রতিশ্রুতি দিতে ব্যর্থ হয়েছেন বিশ্বনেতারা। ক্ষতিপূরণ পায়নি দরিদ্র দেশগুলো। গ্রেটা টুনবার্গের মতো কর্মীরা বিশ্বজুড়ে জলবায়ু রক্ষার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বে গণতন্ত্র সূচকে যে নিম্নগামিতা শুরু হয়, ২০২১ সালেও তা অব্যাহত ছিল। বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক পরিসর বাড়াতে ৯-১০ ডিসেম্বর ১১০টি দেশ নিয়ে গণতন্ত্র সম্মেলন করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন। কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে বিশ্বে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সাইবার নিরাপত্তায় জোর দিচ্ছেন বাইডেন।
দীর্ঘ দুই দশকের যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে আগস্টে আফগানিস্তান থেকে গ্লানিকর বিদায় নেয় যুক্তরাষ্ট্র। ক্ষমতা দখল করে তালেবান। ভিয়েতনাম ও ইরাক যুদ্ধের পর এটিই যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের বড় পরাজয়।
প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা ও স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে ১৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন একটি চুক্তি করেন, যার নাম হয় অকাস চুক্তি। এর ফলে ক্ষুব্ধ হয় ফ্রান্স।
যুক্তরাষ্ট্রের মেক্সিকো সীমান্ত ও ইউরোপের বেলারুশ সীমান্তে অভিবাসী সংকট ভয়াবহ রূপ নেয়। সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে সলিল সমাধি হয়েছে সহস্রাধিক মানুষের।
বাইডেন ক্ষমতায় আসায় ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি বাঁচিয়ে রাখার আশা তৈরি হয়। বৈঠক হলেও কোনো সুরাহা ছাড়াই নতুন বছরে প্রবেশ করছে এই সংকট। দক্ষিণ এশিয়ায় বিদায়ী বছরে সবচেয়ে বড় ঘটনা ভারতে প্রাণক্ষয়ী কৃষক আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের চাপিয়ে দেওয়া তিন কৃষি আইন শেষ পর্যন্ত পার্লামেন্টে বাতিল করতে বাধ্য হওয়া।
বিদায়ী বছরে উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে- চিলি, পেরু ও হন্ডুরাসে নির্বাচনে বামপন্থিদের জয়। ফেব্রুয়ারিতে সিনেটে অভিশংসন থেকে ট্রাম্পকে খালাস, জুনে জি-৭ সম্মেলনে কার্বন হ্রাসে নেতাদের মতৈক্য, অক্টোবরে সম্পদ পাচারের তথ্য নিয়ে প্যানডোরা পেপারস প্রকাশ, নভেম্বরে ড্রোন হামলা থেকে ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর প্রাণে রক্ষা, ডিসেম্বরে ইউক্রেন সীমান্তে রুশ সেনা মোতায়েন। আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল- জামার্নিতে মেরকেল যুগের অবসান।