নির্বাচনে নানামুখী অনিয়মের অভিযোগ আর বিনা ভোটে জয়ের রেকর্ডে ঢাকা পড়েছে এবারের তৃণমূলের ভোট উৎসব। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নিকট অতীতে এত বেশি প্রাণহানি আর অনিয়ম কেউ দেখেনি। শুধু ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীই নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং নির্বাচনে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও এবার অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নির্বাচন কমিশনের নির্বিকার অবস্থানের কারণেই এই নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। চার ধাপের ভোট শেষে নির্বাচনী সহিংসতায় অন্তত ৮৮ জন নিহত ও কয়েকশ আহত হওয়ার খবর মিলেছে। এত কিছুর পরও নির্বাচন কমিশনের অবস্থান ছিল দায়সারা। হাতেগোনা দু-একটি ঘটনা ছাড়া অনিয়মের বিরুদ্ধে ইসির দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। বছরজুড়েই এই নির্বাচন ছিল দেশের তৃণমূল রাজনীতির আলোচনার বিষয়। এসব ঘটনা নিয়ে সংসদের বৈঠকেও উত্তাপ ছড়িয়েছে। তবে পরিস্থিতি বদলায়নি।
এই বছরের শুরু থেকেই দশম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আয়োজনের তোড়জোড় শুরু করে ইসি। কিন্তু করোনার কারণে প্রথম ধাপের তপশিল ঘোষণার পরে নির্বাচন আটকে যায়। শুরুতে দেশের ২০ জেলার ৬৩ উপজেলার ৩২৩টি ইউনিয়ন পরিষদে ১১ এপ্রিল ভোট গ্রহণের দিন নির্ধারণ করা হয়। নানা বাধা পেরিয়ে করোনাকাল শেষ না হতেই গত ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর দু'দফায় প্রথম ধাপে ৩৬৫টি ইউপির ভোট অনুষ্ঠিত হয়।
ইসি থেকে পাওয়া ভোটের ফলে দেখা গেছে, নিজ দলের বিদ্রোহীদের কাছে নাকাল হতে হয়েছে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীদের। নির্বাচনের আগে ইসি আয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে একাধিক বৈঠকেও বলা হয়েছে, এবারের ইউপি নির্বাচনে সহিংসতার মূল কারণ ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহীদের সঙ্গে নৌকার প্রার্থীদের বিরোধ। যেখানেই বিদ্রোহীরা শক্তিশালী ছিল সেখানেই বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কখনোই ইসির নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে মনে হয়নি। কোথাও তারা সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে আবার কোথাও বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে পক্ষপাতমূলক ভূমিকা রাখার অভিযোগ ওঠে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত বিদ্রোহীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন ভোটের মাঠে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়া অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতাকর্মীরা। দলীয় প্রতীক না থাকলেও অনেক স্থানে বিএনপির নেতাকর্মীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটের লড়াইয়ে ছিলেন।
চার ধাপের ইউপি নির্বাচনের ফলে দেখা যায়, ভোট হওয়া ইউনিয়ন পরিষদগুলোর এক হাজার ৩৭৭টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতেছেন এক হাজার ২৪৯টিতে। এই স্বতন্ত্রদের বেশিরভাগই সরকারি দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। জানুয়ারিতে আরও দুই ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এবারের ইউপি নির্বাচনে আলোচিত ঘটনা ছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার প্রবণতা। চার ধাপে মোট ৩০০টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৯৭ জনই আওয়ামী লীগের ও তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। অনেক স্থানে পুরো ইউপির একটি পদেও ভোট হয়নি। কারণ সব পদেই একজন করে প্রার্থী ছিলেন। অনেকে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পরও প্রভাবশালীদের চাপের মুখে প্রত্যাহারে বাধ্য হয়েছেন।
ইউপি ভোটে দলীয় প্রতীক বরাদ্দের বিধান চালু হওয়ার পরে দ্বিতীয়বারের মতো ভোট হচ্ছে। চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীক বরাদ্দের সুযোগ থাকলেও অন্য পদগুলোতে দলীয় প্রতীক দেওয়ার সুযোগ নেই। আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি এই ভোটে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ না দিলেও তাদের নেতাকর্মী এই ভোটে অংশ নিচ্ছেন।
ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পঞ্চম ধাপে চট্টগ্রামের রাউজানের ১৪টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বার ও নারী মেম্বার পদে সবাই ভোট ছাড়াই জয়ী হন। ওই উপজেলায় ভোটেরই প্রয়োজন হয়নি। একই অবস্থা ছিল কুমিল্লার লাকসামের পাঁচটি ইউনিয়নেও। সেখানেও সবক'টি পদে ভোট ছাড়াই জিতে নেন প্রার্থীরা। শরীয়তপুরের একটি ইউনিয়নে একই ঘটনা ঘটলেও পরে সই জালিয়াতি ধরা পড়ায় সেখানে ভোট স্থগিত রাখা হয়।