- বাংলাদেশ
- যুক্তরাষ্ট্রের অতি আগ্রহ ও আমাদের দুশ্চিন্তা
যুক্তরাষ্ট্রের অতি আগ্রহ ও আমাদের দুশ্চিন্তা

যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য আরোপিত ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতি নিয়ে সর্বমহলে আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের মানুষের প্রভাবশালী অংশটি পাশ্চাত্যমুখী। সুবিধাপ্রাপ্তদের বিপুল একটি অংশও যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা কিংবা ইউরোপকে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য মনে করে। পাশ্চাত্যের উদারবাদী গণতান্ত্রিক সমাজে স্বকীয়তা নিয়ে নিরাপদ, নির্ঝঞ্ঝাট ও আয়েশি জীবন-যাপন করার সুযোগই এর কারণ। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের বিশ্বসেরা শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি এদেশের শিক্ষার্থীরাও স্বাভাবিকভাবে আকর্ষণ বোধ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ভিসা নিষেধাজ্ঞা কি এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে শঙ্কিত করেছে? উত্তর সম্ভবত ‘হ্যাঁ’। সরকার ও গণতন্ত্রের অংশীজনদের ভাবনা কী, তা জানতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
কিছুদিন আগে মার্কিন সরকারে কর্মরত এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তিনি খানিকটা অবাক হয়ে বলেছেন যে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের আগ্রহ তিনি তাঁর পেশাগত জীবনে আর দেখেননি! আমার নিজের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতাও তাই বলে। পেশাগত কারণে কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলতে এবং বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের বন্ধুদের সঙ্গে গত এক বছরে প্রায় ডজনখানেক আলাপচারিতার সূত্রে এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারি, বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেড়েছে। এর নানাবিধ কারণ রয়েছে।
প্রথমত, ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা বড় একটি কারণ। এর এক দিকে রয়েছে চীনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়ানীতি, অন্যদিকে ভারত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে মোহভঙ্গের ঘটনা। প্রায় দুই দশক আগে ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যকার বেসামরিক পারমাণবিক জ্বালানি চুক্তি হয়। তার পর থেকে ভারত দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ছাড় পেয়ে আসছিল। সম্ভবত অন্যতম কারণ ছিল ভারতকে ঘিরে আশাবাদ যে, দেশটি জাপানের সঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়ানীতির সক্রিয় অংশীদার হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু গত দশকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি মিলে পশ্চিমাদের কিছুটা মোহভঙ্গ হয়েছে বলে প্রতীয়মান।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বর্ধিষ্ণু আগ্রহের আরেকটি কারণ হতে পারে রোহিঙ্গা সংকট ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সদ্য প্রণীত ‘বার্মা আইন’। রোহিঙ্গা সংকটে যে ক’টি দেশ অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে সক্রিয় সহযোগিতা করেছে তাদের নেতৃত্বে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধ এবং সেখানকার গণতান্ত্রিক পক্ষগুলোকে সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ। সেখানে ভূ-রাজনীতির বিষয়ও ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
তৃতীয়ত, এবং ঘোষিত কারণটি হচ্ছে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রকৃত সংকট। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে কার্যত স্বীকার করা হয়েছে যে বাংলাদেশে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বড় অনিয়ম হয়েছে। এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনটিকে অংশগ্রহণমূলক করতে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সক্রিয় তৎপরতার কথা আমরা জানি। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ঘাটতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের স্পষ্ট ধারণা রয়েছে। গণতন্ত্রে উত্তরণে তারা কীভাবে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে পারে সে বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শও করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জন্য কৌশলগত। ফলে যারাই বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে যে ওয়াশিংটনে লবিস্ট নিয়োগ করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব, তারা স্পষ্টতই ভুল পরামর্শ দিয়েছে এবং বাংলাদেশের জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ অপচয় করেছে।
বৈশ্বিক অবস্থানের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের এরকম আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। প্রশ্ন হচ্ছে এরকম সব দেশে যুক্তরাষ্ট্র শক্ত পদক্ষেপ নেয় না কেন এবং বাংলাদেশেই বা নিচ্ছে কেন। এর উত্তর কিছুটা হয়তো ওপরের তিনটি কারণের মধ্যে মিলবে। কিছু কারণ হয়তো আমাদের অজানা। বাস্তবতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র একটি শক্ত অবস্থান নিয়েছে বা নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। এবং বর্তমান পদক্ষেপটি আসন্ন বড় কিছু পদক্ষেপের সূত্রপাত বলেই মনে হয়। বাংলাদেশ কীভাবে এটি মোকাবিলা করতে পারে?
বাংলাদেশের মতো বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তির মধ্যখানে থাকা দেশগুলোর সার্বভৌমত্বের সেরা রক্ষাকবচ হতে পারে গণতন্ত্র। দেশের জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হলো প্রথম। অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সেটির প্রথম ধাপ। কিন্তু বিগত দুটি একতরফা নির্বাচনে শাসকগোষ্ঠী সে পথ থেকে সরে এসে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে আরও বেশি নাজুক করে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ এসবেরই প্রতিফলন। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার পরে চলতি ভিসা নিষেধাজ্ঞা একদিকে যেমন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংকটের মাত্রাকে তুলে ধরেছে, অন্যদিকে আত্মবিশ্লেষণ ও সঠিক পথে ফিরে যাওয়ারও সুযোগ তৈরি করেছে। ক্ষমতাসীনদেরই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা বাংলাদেশকে কোন পথে নিয়ে যেতে চান।
প্রশ্ন আসতে পারে যে বাংলাদেশের বর্তমান রেজিম যদি যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রয়াসে বৈশ্বিক নানা উদ্বেগকে পাশ কাটিয়ে আগের মতো একতরফা বা প্রশ্নবিদ্ধ পদ্ধতিতে নির্বাচনের পথ নেয় তাহলে কী হবে। আমি আশঙ্কা করি এতে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সমূহ সংকটে পতিত হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে আমরা যে উচ্চাশা পোষণ করি, আদতে দেশটির অর্থনৈতিক ভিত্তি বেশ নড়বড়ে। দেশটির রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ ভাগই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। রেমিট্যান্স ও তৈরি পোশাক খাতে সংকট দেখা দিলে বাংলাদেশের অর্থনীতির টিকে থাকাই দুষ্কর হবে। তৈরি পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্লক হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়া নিয়ে প্রায় একই অবস্থান নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জিএসপি প্লাস পাওয়ার শর্ত হিসেবে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছে। আগামী নির্বাচনে যেকোনো অনিয়ম যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে কঠোর অবস্থান নিতে বাধ্য করতে পারে। এর এখনকারটি মূলত ভিসা নিষেধাজ্ঞা হলেও মূল ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে ঘিরে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা একটি অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় কিনা। নাকি ২০১৪ সালের মতো একতরফা নির্বাচন কিংবা ২০১৮ সালের মতো অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়। তারা যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও এর জনগণের স্বার্থের প্রতি অনুগত থাকে, সেক্ষেত্রে সুবিবেচনামূলক পদক্ষেপ নেবে এবং নিজেদের লাভালাভ ও ক্ষয়ক্ষতির ঊর্ধ্বে উঠে দেশের সার্বিক কল্যাণের কথা চিন্তা করবে। তা যদি করে তবে দেশের গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সঙ্গে নিয়ে সমঝোতার পথে হাঁটতে হবে। তারা যদি আগের মতো যেকোনো মূল্যে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখাকে লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য গুরুতর সংকট আসন্ন। বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আছে।
সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া: সহযোগী সম্পাদক, ওয়াশিংটনভিত্তিক মাসিক ‘সাউথ এশিয়া পারস্পেকটিভ’। উপদেষ্টা, ইনটস্টটিউট ফর রিজিওনাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসন। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান কান্ট্রি স্পেশালিস্ট, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইউএসএ।
মন্তব্য করুন