
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বাধা, কারচুপি বা অনিয়ম করলে দায়ী ব্যক্তি বা তার পরিবারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তকে তথাকথিত বলে উল্লেখ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
নিষেধাজ্ঞার হুমকির পরদিন বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, এ বৈঠক আগে থেকে ঠিক করা ছিল এবং দুই দেশের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার নিয়মিত বৈঠকের অংশ। বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাশাপাশি সব বিষয়ে আলোচনা করেছি। সেই সঙ্গে নতুন ভিসা নীতি নিয়ে আলোচনা করেছি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতি থেকে আপনারা দেখেছেন, বাংলাদেশের জনগণ, সরকার, প্রধানমন্ত্রীসহ এ দেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চাওয়া ব্যক্তিদের সহযোগিতা করতে এ নতুন ভিসা নীতি গ্রহণ করেছি আমরা। আমরা গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করছি।
বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভিসা নীতি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে সহযোগিতা করবে বলে আশা করি। যারা জ্বালাও-পোড়াও করে, তারা হয়তো এর থেকে বিরত থাকবে। এ বিষয়ে নিশ্চিত না হলেও আশা রয়েছে।
ভিসা নীতি নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলোচনায় এ পদক্ষেপের সুফল জানতে চেয়েছেন বলে ড. মোমেন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, জানতে চেয়েছি এটি অন্য দেশে পরীক্ষিত হয়েছে কিনা। রাষ্ট্রদূত বলেছেন, পরীক্ষিত হয়নি; এটি নতুন নীতি। যুক্তরাষ্ট্র আশা করে, এটি বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রদূতের কাছে জানতে চেয়েছি, এ নীতির কারণে কোথাও গণতন্ত্রের উন্নয়ন হয়েছে কিনা। এর উত্তর দেননি রাষ্ট্রদূত।
সরকার এটিকে স্বাগত জানিয়েছে কি– এর উত্তরে তিনি বলেন, তারা করেছে তাদের নিয়মে। আমাদের স্বচ্ছ ও সুন্দর নির্বাচনে সাহায্য করলে ভালো। তবে এ নীতির মাধ্যমে স্বচ্ছ ও সুন্দর নির্বাচন সম্ভব হবে কিনা, তা আমি নিশ্চিত নই। এ নীতির কোনো পরীক্ষা কোথাও হয়নি।
প্রথমে জিএসপি স্থগিত, তার পর র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং সর্বশেষ ভিসা নীতি– এগুলোকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো ব্যর্থতা দেখেন কিনা? উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন– না না, আমাদের কোনো ব্যর্থতা নেই। বরং আমরা যা যা চাচ্ছি, সে অনুযায়ী কাজ হচ্ছে। মার্কিন ভিসা নীতিও বাংলাদেশে অজ্ঞাত মামলার মতো কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে জিজ্ঞাসা করেন।
পরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, এটার যথেচ্ছভাবে প্রয়োগ আশা করি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য নয়।
তথাকথিত বলার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন যে আইন রয়েছে, এ নীতি তার নতুন সংযোজন। যে কোনো নতুন নীতিতে তার প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন থাকে। সেটি সময়ের সঙ্গে পরিপক্ব হয়। এটি মাত্র এক বছর আগে সংশোধিত আইন। তারা এ পর্যন্ত মাত্র দু-একটি দেশে ব্যবহার করেছে।
এ ভিসা নীতিতে সরকার খুশি নাকি অখুশি জানতে চাইলে শাহরিয়ার আলম বলেন, এখানে খুশি বা অখুশি হওয়ার মতো বিষয় নেই। বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে আমরা সিদ্ধান্তটিকে ভালো দৃষ্টিকোণে নিয়েছি।
এদিকে গতকাল সকালে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আমরা সুষ্ঠু-সুন্দর নির্বাচন করতে চাই। এটাকেই তারা সমর্থন দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তাতে প্রধানমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। তিনি বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট করতে যত ধরনের আয়োজন করা প্রয়োজন, আমরা করব। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে বদ্ধপরিকর।
নতুন মার্কিন ভিসা নীতির ফলে বাড়তি চাপ অনুভব করছেন কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘না, বাড়তি কোনো চাপ নেই। তারা তাদের কাজ করেছে, আমরা আমাদের কাজ করেছি।’
ভিসা নীতির বিষয়টি এত দিন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি কেন– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের নীতি তারা জানাক, আমি কেন জানাব। তাদেরই জানাতে দেন, তারা সেটি জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে চিঠি দিয়েছেন, অপূর্ব চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে এক জায়গায় বলেছেন, ‘এই নীতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়ক হবে। আর গণতন্ত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি (নির্বাচন) যে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বাধাগ্রস্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারে।’
সরকারের পক্ষ থেকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। তার পরও কেন ভিসা নীতি আরোপের বিষয়টি আসছে– এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মোমেন বলেন, দুষ্ট লোকেরা জ্বালাও-পোড়াও করে। গতকালও পুলিশকে পিটিয়েছে, বাস জ্বালিয়ে দিয়েছে। অতএব, তারা একটু সাবধান হবে। এই ভিসা নীতি শুধু যে সরকারি দল বা সরকারে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের জন্য নয়; বিরোধীপক্ষে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের ওপরও বর্তাবে।
নতুন ভিসা নীতির পর যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে কিনা– জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুবই ভালো সম্পর্ক রয়েছে, কোনো টানাপোড়েন নেই। ৫২ বছরে আমাদের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়েছে। তারা এই সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। এটি তারা চিঠিতে লিখেছে।
তবে এক বিবৃতিতে মার্কিন ঘোষিত ভিসা নীতিকে তথাকথিত বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া গণমাধ্যমকে তুলে ধরেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। এতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণাটিকে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সব পর্যায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকারের দ্ব্যর্থহীন প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করছে। তবে বাংলাদেশ আশা করে, এই ভিসা নীতি যথেচ্ছভাবে প্রয়োগের পরিবর্তে বস্তুনিষ্ঠতা অনুসরণ করা হবে।’
বাংলাদেশের জনগণ গণতান্ত্রিক ও ভোটাধিকারের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। জনগণের রায় উপেক্ষা করে ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী কোনো সরকার টিকে থাকার নজির বাংলাদেশে নেই। জনগণের ভোটাধিকারকে আওয়ামী লীগ সরকার পবিত্র রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে এবং এ অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দলটির কঠোর সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ইতিহাস রয়েছে। বর্তমান সরকার শান্তিপূর্ণ ও বৈধ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার আওতায় সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে।
বাইডেন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে আবারও গুরুত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে এক বছরের বেশি আগে নতুন ভিসা নীতি চালু করেছে দেশটি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়া ও ২০২৩ সালের মার্চে নাইজেরিয়ার ওপর নতুন এ ভিসা নীতি প্রয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র। দেশ দুটিতে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে তারা। আর এবার সেই কাতারে এসে দাঁড়াল বাংলাদেশ।
ডোনাল্ড লুর ব্যাখ্যা
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির আদেশদাতা এবং আদেশ বাস্তবায়নকারী উভয়ের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে বলে জানিয়েছেন দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। চ্যানেল আইয়ের টক শো তৃতীয় মাত্রায় বুধবার রাতে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এ কথা বলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে ডোনাল্ড লু বলেন, যাঁরা সহিংসতা বা ভোটারদের ভয় দেখাবেন বা ভোট কারচুপি করবেন, তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না। একই সঙ্গে যাঁরা আদেশ দেবেন, তাঁরাও ভিসা পাবেন না।
নতুন ভিসা নীতি সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমরা কারও বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিইনি। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বাধাগ্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত করার সঙ্গে যাঁরা দায়ী বলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার মনে করবে, তাঁদের বিরুদ্ধে মার্কিন ভিসায় বিধিনিষেধ আরোপ করা যাবে। তিনি হতে পারেন সরকার, বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা বিরোধী দলের সদস্য।
ডোনাল্ড লু আরও বলেন, এই নীতি সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যদের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োগ করা হবে। যেমন– যদি আমরা দেখতে পাই বিরোধী দলের কোনো সদস্য নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে সহিংসতায় জড়িত ছিলেন বা ভোটারদের ভীতি প্রদর্শনে জড়িত ছিলেন, তাহলে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেওয়া হবে না। একইভাবে সরকারের কোনো সদস্য বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্য ভোটারদের ভীতি প্রদর্শন বা সহিংসতা বা বাকস্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করায় জড়িত থাকলে তিনিও মার্কিন ভিসা পাবেন না। পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্য, অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী-সন্তানরাও এই বিধিনিষেধের আওতায় পড়বেন।
মন্তব্য করুন