শুরু হয়েছে মধুমাস জ্যৈষ্ঠ। এ মাসের সবচেয়ে দামি ফল লিচু, আবার পাওয়া যায় সবচেয়ে কম সময় ধরে। দেশের সব জেলায় কমবেশি লিচুর ফলন হলেও কিছু অঞ্চলের খ্যাতি দেশজোড়া। কিশোরগঞ্জের ‘মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু’র কদর ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ অনেক এলাকায়। প্রায় দুইশ বছর ধরে জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার হোসেন্দী ইউনিয়নের মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে আবাদ হচ্ছে রসালো ফলটির। তবু দাপ্তরিকভাবে নামকরণ হয়নি এই এলাকার লিচুর। যদিও মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে ‘মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু’র সুনাম।

পাঁচ দশক ধরে লিচুর সঙ্গে জীবন জড়িয়েছেন মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের তৌহিদ মিয়া। তিনি বললেন, বাবার লিচু ব্যবসায় সঙ্গে শৈশবেই পরিচিত হন। তাঁর মৃত্যু হয়েছে তিন দশক আগে। আগে বড় বড় টুকরিভরা লিচু ট্রেনে করে নিয়ে যেতেন নানা জেলায়। সিলেট যেতেন নৌপথে। এখন আর কষ্ট করতে হয় না। ব্যাপক প্রচারের সুবাদে ঢাকাসহ নানা এলাকার পাইকাররা ট্রাক নিয়ে মঙ্গলবাড়িয়া আসেন।

চলতি মৌসুমে ফুল ধরার পরই বিভিন্ন মালিকের ২৫০টি গাছ কিনে নেন তৌহিদ মিয়া। এ জন্য গুনতে হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। ফলন ভালো হলে ৬ লাখ টাকায় বিক্রির আশা করছেন। তিনি বলেন, প্রচণ্ড তাপদাহসহ বৈরী আবহাওয়ার কারণে এবার গাছে মুকুল কম ধরে। এ ছাড়া কুঁড়ি থাকতেই বেশকিছু ঝরে পড়েছে।

তৌহিদ মিয়ার ভাষ্যে, এখন ধানের চেয়ে লিচু চাষ লাভজনক। ১০ কাঠা জমিতে ধান আবাদ করে বছরে বিক্রি হয় ৩৬ হাজার টাকায়। খরচও আছে ১০ হাজার টাকা। একই জমিতে অল্প খরচে লিচু চাষ করলে প্রায় ৮০ হাজার টাকার ফল বিক্রি করা যায়।

একই গ্রামের মুখলেছ মিয়ার রয়েছে ৫০টি গাছ। এ ছাড়া ১০ থেকে ২০টি করে গাছ কিনেছেন এমন ব্যবসায়ীও আছেন। আশপাশের এলাকা থেকে বেশ কয়েকজন ক্রেতাকে সেখানে সোমবার বিকেলে লিচু কিনতে দেখা যায়। এদিন দেখা গেছে, অনেক গাছের লিচু এখনও অপরিণত। তবে কিছু কিছু গাছ থেকে লিচু আহরণ শুরু হয়েছে। বাগানিরা ১০০টি করে লিচুর থোকা বাঁধছেন। সাধারণ আকারের প্রতি থোকা বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। খানিকটা বড় আকারের লিচুর প্রতি থোকার দাম ৮০০ টাকা।

লোকশ্রুতি আছে, মঙ্গলবাড়িয়ার এক ব্যক্তি প্রায় দুইশ বছর আগে চীন থেকে লিচুর কলম এনে বাড়িতে লাগিয়েছিলেন। সেই কলম থেকেই স্থানীয় এই জাতের প্রসার ঘটছে।

পাকুন্দিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর-ই-আলম বলেন, বর্তমানে মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে লিচু গাছের সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। প্রতি মৌসুমে এখান থেকে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হয়। চলতি মৌসুমে মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু বাগানিদের নিয়ে চারটি পরামর্শ সভা করেছেন বলেও জানান নূর-ই-আলম। ফুল আসার আগে, ফুল আসার সময়, লিচু ধরার সময় ও পরিণত হওয়ার সময় এসব সভা করে গাছ ও ফল পরিচর্যা বিষয়ে পরামর্শ দেন। প্রয়োজনে বাগানিরা ফোন করেও তাঁর পরামর্শ নিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, উৎপত্তিস্থল অনুসারেও লিচুর নামকরণ হয়ে থাকে। যেমন মুম্বাই লিচু, মাদ্রাজি লিচু, চায়না-৩ লিচু ইত্যাদি। আবার বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত জাত বারি লিচু-১, বারি লিচু-২, বারি লিচু-৩। মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর আকার, স্বাদ ও গন্ধের বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নামকরণ হওয়া উচিত বলেও তিনি মনে করেন।

বিষয়টি নিয়ে আগেও ভেবেছিলেন এ উপজেলার সাবেক কৃষি কর্মকর্তা (২০১২-২০১৬) লিয়াকত হোসেন খান। তিনি বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (আমদানি) পদে কর্মরত। সোমবার মোবাইল ফোনে সমকালকে লিয়াকত হোসেন বলেন, মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর নামকরণ বিষয়ে

গাজীপুরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফল বিভাগে লিখিত আবেদন করেছিলেন। তখন ওই বিভাগের দল পরিদর্শনও করে। পরে তিনি অন্যত্র বদলি হওয়ায় এ বিষয়ে খোঁজ নিতে পারেননি।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর-ই-আলম সোমবার কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে ফোন করেছিলেন বিষয়টির অগ্রগতি জানতে। তবে কোনো অগ্রগতির তথ্য পাননি। এ নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাবেন বলে জানান।