ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

ডিজিটাল আইনের শুদ্ধ প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে

সাক্ষাৎকারে আনিসুল হক

ডিজিটাল আইনের শুদ্ধ প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে

ওয়াকিল আহমেদ হিরন

প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২৩ | ১৬:৩৩

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ শুদ্ধভাবে করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। সমকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, এই আইনে কোনো দুর্বলতা থাকলে তা সংশোধনেও উদ্যোগ নেওয়া হবে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত রয়েছে জানিয়ে বলেন, খালেদা জিয়া গৃহবন্দি নন, তিনি দেশের যে কোনো জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারেন। গতকাল শনিবার গুলশানে তাঁর কার্যালয়ে এ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।

সমকাল: সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক, চিত্রনায়িকা, সরকারি কর্মচারীসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ আইনের অপব্যবহার বাড়ছে বলেও সমালোচনা হচ্ছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

আনিসুল হক: যিনি সংক্ষুব্ধ হন, তিনি মামলা করেন। আমি মনে করি, এর মধ্যে কিছু মামলা সঠিক। নওগাঁর সরকারি কর্মচারী সুলতানা জেসমিনকে র‍্যাবের আটকের ৩২ ঘণ্টা পরে মামলা হয়েছে। মামলা হওয়ার আগে গ্রেপ্তার অবশ্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার। প্রথম আলোর সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যে মামলাটি হয়েছে, সেটি সঠিক হয়েছে। আমরা ভাত, চাল, মাছ ও মাংসের স্বাধীনতা চাই– সাত বছর বয়সের ছেলেকে ১০ টাকা ও প্ল্যাকার্ড দিয়ে ছবি তোলা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা হয়েছে। এর ইম্প্যাক্ট হচ্ছে ইথিওপিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও দুর্ভিক্ষ চলছে। আসলে কি দুর্ভিক্ষ চলছে, নাকি দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য এটি করা হয়েছে? এটি সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড না করা হলে তাঁর বিরুদ্ধে পেনাল কোডে মামলা করা হতো। সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করার অপরাধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। মামলা হওয়ায় এ ব্যাপারে আর কথা বলতে চাই না। আমি ২০২০ সাল থেকে বলে আসছি এবং বুঝতে পেরেছি, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের কিছু মামলা প্রয়োগে অপব্যবহার হচ্ছে। এই মিসইউজ এবং অ্যাবিউজ বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের অফিসে আমি দুইবার আলাপ করেছি। সারা পৃথিবীতে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে হয়তো আইন নেই, কিন্তু এ ধরনের আইন আছে। সারা পৃথিবীতে বেস্ট প্র্যাকটিস আমরা গ্রহণ করতে পারি কিনা, সেটা পর্যালোচনার জন্য আলাপ-আলোচনা করছি। এর মধ্যে আমরা যেটা করেছি তা হচ্ছে, সাংবাদিক বা যাঁর বিরুদ্ধেই ডিজিটাল আইনে মামলা হোক, তাঁকে যেন দ্রুত গ্রেপ্তার না করা হয় এবং মামলাটির অভিযোগ গ্রহণযোগ্য কিনা তা যাচাইয়ের জন্য একটি সেল আছে, সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এসব পদক্ষেপ নেওয়ায় অপব্যবহার অনেকটা বন্ধ ছিল। এখন দু-একটি মামলা হচ্ছে। নওগাঁর সুলতানা জেসমিনের নামে যারা মামলা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের চিন্তাভাবনা চলছে। চিত্রনায়িকা মাহিকে তাৎক্ষণিকভাবে জামিন দেওয়া হয়েছে। সে মামলাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। বিউটি পার্লার নিয়ে খুলনার সাইবার ট্রাইব্যুনালে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। মামলার বিষয়বস্তু জানার জন্য খোঁজখবর নিচ্ছি। আইনের অপব্যবহার যেখানেই হয়েছে, পদক্ষেপ নিচ্ছি বন্ধ করার।

সমকাল: বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এই আইন বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও আইনের সমস্যা দূর করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগ কতদূর?

আনিসুল হক: খবরের কাগজে পড়েছি, জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রধান এই আইন স্থগিতের দাবি জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে কোনো চিঠি পাই নাই। যতক্ষণ পর্যন্ত এ পত্র না পাব, ততক্ষণ কোনো মন্তব্য করব না। দু-একটা খবরের কাগজে সংবাদটি প্রকাশ হয়েছে দেখেছি। তবে খবরের কাগজের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কাগজে প্রকাশিত খবরের ওপর বক্তব্য দেওয়া এখনই ঠিক হবে না। জাতিসংঘের ওই হাইকমিশনের প্রধানের সঙ্গে গত ২১ মার্চ বৈঠক করেছি। আমি সবটাই তাঁকে খুলে বলেছি। তিনি বলেননি, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি বলেছেন, আইনের অপব্যবহার যেন না হয়। আমিও এ ব্যাপারে তাঁকে আশ্বাস দিয়েছি। তিনি আমার কথায় সন্তুষ্ট হয়েছেন। আমরা সঠিক পথেই এগোচ্ছি। দরকার হলে কিছু সংশোধন করার পদক্ষেপও নেব। কিন্তু এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আইন। এ আইন বাতিল করার প্রশ্নই ওঠে না। গত ১৪ মার্চ অংশীজন, সুধীসমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসেছিলাম; সেই আলোচনা চলছে। তাঁদের বক্তব্য শুনেছি, আমার বক্তব্য তাঁদের এখনও বলিনি। এপ্রিলের মাঝামাঝি আমরা আবার বসব। মনে হয়, পরিকল্পিতভাবে একটি গোষ্ঠী এই আইন নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমরা আইনটার প্রয়োগ শুদ্ধ করার জন্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের একটা সংবিধান উপহার দিয়ে গেছেন। সংবিধানে পরিষ্কার বলা আছে, মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা রাষ্ট্র দিচ্ছে। প্রথম কথা হচ্ছে বাক্‌স্বাধীনতা; দ্বিতীয়ত হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। আমি বলব, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বন্ধ করার জন্য করা হয়নি।

সমকাল: যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। নির্বাচন, বিচার ব্যবস্থা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

আনিসুল হক: আমি এ রিপোর্ট পুরোপুরি পড়ব এবং আপনি যেসব বললেন, সেগুলো যদি সত্যিই থেকে থাকে, লিখিতভাবে জবাব দেব।

সমকাল: রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনা ও খালেদা জিয়াকে ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে ইঙ্গিত দিচ্ছে সরকার। বিরোধী দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপের উদ্যোগ নেওয়া হবে কিনা।

আনিসুল হক: ২০২০ সালের ২৫ মার্চ প্রথম যখন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তখন কিন্তু নির্বাচনের প্রশ্ন ওঠেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহানুভবতায় তাঁকে সেদিন শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তখন তাঁর স্বাস্থ্য খুব খারাপ ছিল এবং চিকিৎসার জন্য এটাকে পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি করা হয়েছে। শর্ত দেওয়া হয়েছে, তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে পারবেন। তিনি এখনও যদি সারাদেশে ঘুরে বেড়ান, আমরা আপত্তি করছি না। কিন্তু বারবারই একটা কথা বলা হচ্ছে, তিনি গৃহবন্দি। পরিষ্কারভাবে বলতে চাই– খালেদা জিয়া গৃহবন্দি নন। তাহলে এই যে প্রশ্নটা আসছে বিএনপিকে নির্বাচনে নেওয়ার জন্য তাঁকে ছাড়া হবে। তাঁকে ছাড়ার কী আছে, আর বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগেই তো তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তিনি রাজনীতি করতে পারবেন কি পারবেন না– এটা তো আইনের মধ্যেই আছে। আপনারা দেখে নেন।

সমকাল: সুষ্ঠু নির্বাচনের সহায়তা চেয়ে বিএনপি জাতিসংঘকে চিঠি দিচ্ছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

আনিসুল হক: বিএনপি জনগণের কাছে না গিয়ে অন্যান্য দেশের রাজধানীতে দৌড়ায়। তাদের অভ্যাসই এটা। তাদের অনুরোধ করব, জনগণের কাছে যান। জনগণ কাকে ভোট দেবে, সেটা আগে ঠিক হোক। বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে, আগামীতেও আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে।

সমকাল: বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলো আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও সুষ্ঠু চায় বলে জানিয়েছে। এ বিষয়ে সরকার কোনো উদ্যোগ নেবে কি?

আনিসুল হক: যাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানাই। পরামর্শ দেওয়ার আগে আমরা বলেছি, বর্তমান সরকার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় এবং সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন আইন করা হয়েছে। এই উপমহাদেশে আমাদের দেশ ছাড়া কোনো দেশে এমন আইন হয়নি। এ আইন নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়েছে। বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সব দল এই আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছে। তাদের সংশোধনী গ্রহণ করেই আইনটি পাস করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ।

সমকাল: গত ২৮ মার্চ দেশের ২৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মান্ধ সব রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে জামায়াত নিষিদ্ধের কোনো পদক্ষেপ নেবেন কিনা?

আনিসুল হক: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা সংবিধানের মাধ্যমে বন্ধ করেছিলেন। তাঁকে হত্যার পর জিয়াউর রহমানসহ অন্যরা এটাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। আমরা চাই, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি বন্ধ হোক। এটা নির্বাচন কমিশন দেখবে। জামায়াত নিষিদ্ধের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস অ্যাক্ট সংশোধন করতে হবে। সেই সংশোধন আমরা প্রস্তুত করে রেখেছি। চেষ্টা করব কিছুদিনের মধ্যে এটা শেষ করতে।

সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

আনিসুল হক: আপনাদেরও ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন

×