
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মূল কাঠামো সরকার। সরকারের আবার নানা কাঠামো আছে। এর মধ্যে কিছু কাঠামো বা প্রতিষ্ঠান সরাসরি সরকার নিয়ন্ত্রিত, কিছু সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত। নির্বাচন কমিশন তেমনি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। আমরা জানি, নির্বাচনকালীন সব ক্ষমতার অধিকারী এই প্রতিষ্ঠানটির উজ্জ্বলতা যেমন স্বাধীন বাংলাদেশে কম দৃশ্যমান হয়নি, তেমনি বিবর্ণতাও কম জনক্ষোভের সৃষ্টি করেনি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিক সমাজের গুরুত্ব অনেক বেশি। তারাই সুশাসনের নিয়ামক শক্তি। আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট লেখা আছে- রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, অর্থাৎ জনগণই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কাজেই সরকারের কিংবা দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড জনসমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। সরকার বা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাবমূর্তি নির্ভর করে জনআস্থার পারদ ওঠানামার ওপর।
আমরা দেখেছি, সাম্প্রতিক বা এরও আগে দফায় দফায় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন নিয়ে জনআস্থার পারদের ওঠানামা। কখনও কখনও তা এতটাই নেমে গেছে, এর ফলে সৃষ্ট জনক্ষোভ থেকে সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন পর্যন্ত ঘটেছে। এর ফলে প্রাতিষ্ঠানিক আলো যেমন জিইয়ে থাকা অন্ধকার দূর করে, তেমনি ব্যবস্থাপনার বিকাশে জনআস্থার পারদও হয় ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, পরিতাপ সেখানেই। নির্বাচন কমিশন ঘিরে জনআস্থার পারদ যেভাবে নেমে গিয়েছিল, তা আর ঊর্ধ্বমুখী হয়নি। তবে এখন সে সময় ফের উপস্থিত। নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হতে চলছে। এই নির্বাচনের ক্ষণগণনার পাশাপাশি নতুন কমিশনের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণের প্রত্যাশীদের জমাটবদ্ধ প্রত্যাশার বাস্তবে কতটা প্রতিফলন ঘটবে, দেখার বিষয় সেটিই। বিদায়ী কমিশনের অনেক কলঙ্করেখার মধ্যে অন্যতম হলো 'রাতে ভোট'।
২৪ মে নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আশার কথা শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'ভোট তার নিয়ম অনুযায়ী হবে, দিনের ভোট দিনেই হবে। ভোট রাতে হবে না। এটা স্পষ্ট উচ্চারণে বলতে চাই।' প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এই মন্তব্য সাক্ষ্য দেয়, রাতে ভোট বাক্স ব্যালটে ভরে যাওয়ার যে অভিযোগ রয়েছে, তা অমূলক নয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় কর্তৃত্ব সরকারের হাতে সমর্পিত হলেও আমাদের সংবিধানে নির্বাচন কমিশনের সহযোগী শক্তি হিসেবে সরকারের দায়িত্ব পালনের নির্দেশও স্পষ্ট। সিইসি স্পষ্ট করে যে উচ্চারণ করেছেন তাতে এখন অন্তত অতীতের কিছু বিষয় আর অস্পষ্ট রইল না। তিনি এও বলেছেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে কমিশন এখনও শতভাগ আস্থাভাজন হতে পারেনি। আপাতত নিন্দিত নির্বাচন কমিশনের নতুন সিইসির বক্তব্যে নন্দিত হলেও সময়ই বলে দেবে উচ্চারণ আর বাস্তবতায় সামঞ্জস্য কতটা রয়েছে।
আমাদের সমাজে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ, 'বৃক্ষ তোমার নাম কি, ফলেই পরিচয়।' কাজী হাবিবুল আউয়াল যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তাতে জনআকাঙ্ক্ষার যে প্রতিফলন ঘটেছে, এ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে না। কিন্তু হতাশার কথা হলো, আমাদের অভিজ্ঞতা এসব ক্ষেত্রে খুব প্রীতিকর নয়। অপ্রীতির এই দাগ মুছতে নতুন নির্বাচন কমিশন যদি তাদের প্রথম পরীক্ষা কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বচ্ছতার নিরিখে উত্তীর্ণ হতে পারে, তাহলে জনআস্থার নিম্নমুখী পারদ কিছুটা হলে ঊর্ধ্বমুখী হবে। কিছুটা বলছি এজন্যই, শুধু একটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই পুরোপুরি স্বস্তির আবহ তৈরি হবে না। নির্বাচন ব্যবস্থায় যে ক্ষত এরই মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে, তা উপশমে তাদের উত্তীর্ণ হতে হবে ধারাবাহিকভাবে সব পরীক্ষায়। এ ক্ষেত্রে সরকার সহযোগী শক্তি হলেও তাদের 'চাওয়ার' বিষয়টি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সরকার ও তার প্রশাসনিক কাঠামো যদি নিজেদের প্রভাব বলয় সৃষ্টি না করে, তাহলে সিইসির সদিচ্ছা পূর্ণতা পেতে পারে। এরও দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে। যেমন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের পূর্বাপর কিছু পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের ভোট গৃহীত হবে। গত কমিশনের অধীনে ধাপে ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে রক্তারক্তি খুনাখুনির যে চিত্র দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল, এই অভিশাপ জিইয়ে না থাকলেই মঙ্গল। সিইসির প্রত্যয় জয়যুক্ত হোক।
দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু: সাংবাদিক ও লেখক
deba_bishnu@yahoo.com
মন্তব্য করুন