- বাংলাদেশ
- লকডাউন অকার্যকর, এখন করণীয় কী
লকডাউন অকার্যকর, এখন করণীয় কী
ভয় জাগাচ্ছে করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ
রাজবংশী রায় |
রাজবংশী রায়
প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২১
আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২১
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২১ । আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২১ । প্রিন্ট সংস্করণজনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, সরকারের বিভিন্ন স্তরে সমন্বয়হীনতা প্রমাণ করে, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই 'লকডাউন' কিংবা 'বিধিনিষেধ' সংক্রান্ত পদক্ষেপটি গ্রহণ করা হয়েছিল। এ কারণে শুরু থেকেই মাঠপর্যায়ে ওই বিধিনিষেধের কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যায়নি।
দেশে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার গত ৬ এপ্রিল থেকে যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল, তা প্রথম দিন থেকেই ঢিলেঢালা ছিল। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা ওই ব্যবস্থাকে 'বিধিনিষেধ' বলা হলেও সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী একে 'লকডাউন' বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু শুরু থেকে কোথাও লকডাউনের লেশমাত্র ছিল না। প্রশ্ন উঠেছে, সরকার কেন বিধিনিষেধগুলো কার্যকর করতে পারল না? তবে বিশেষজ্ঞরা বিধিনিষেধ কার্যকর করতে না পারার পেছনে কয়েকটি কারণকে দায়ী করেছেন। সরকারি বিধিনিষেধের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়- সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস শুধু জরুরি কাজ সম্পাদনের জন্য সীমিত পরিসরে প্রয়োজনীয় জনবলকে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আনা-নেওয়া করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের যানবাহন সরবরাহ করেনি। এতে করে দুর্ভোগে পড়েন চাকরিজীবীরা। আবার বাস মালিক ও পরিবহন শ্রমিকরা মনে করেছিলেন, গত বছরের মতো দীর্ঘ সময় ধরে পরিবহন বন্ধ থাকবে। এ জন্য তারাও সরকারি সিদ্ধান্ত মানতে চাইছিলেন না। আবার গণপরিবহন বন্ধ থাকায় সড়কে শত শত প্রাইভেট কার চলেছে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। অনেকে বলেছেন, গরিব আটকে রেখে ধনীদের চলাচলের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় গত বুধবার গণপরিবহন চালু করা হয়। এর পর রাজধানীজুড়ে সৃষ্টি হয় যানজট। সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি ও বিধিনিষেধ সবকিছু ভেঙে পড়ে।
সরকারি প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি অফিস প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নিয়ে কাজ করাবে। সরকারি অফিস-আদালতে ওই নির্দেশনা কার্যকর করা হলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তা কার্যকর হয়নি। ফলে বেসরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তবে এর আগে নির্দেশনা জারির পরপরই গত ৫ এপ্রিল বিকেল থেকে শিল্পকারখানা খোলা, সরকারি-বেসরকারি অফিস খোলা রেখে দোকানপাট ও শপিংমল বন্ধ রাখার প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয় রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায়। ধাপে ধাপে তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। কোথাও কোথাও তা সংঘাতে রূপ নেয়। দোকান মালিকরা বলেছেন, বিধিনিষেধের নামে তাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। তাদের অন্যতম চুক্তি ছিল, শিল্পকারখানা, অফিস-আদালত খোলা রেখে মার্কেট ও শপিংমল বন্ধ রাখা দ্বিমুখী আচরণ। এমনকি বইমেলাও চালু রাখা হয়েছে। গত বছর লকডাউনের কারণে ঈদ ও পহেলা বৈশাখের বেচাবিক্রি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেই ধাক্কা তারা এখনও সামলে উঠতে পারেননি। সামনে ঈদ। তার আগে আবারও দোকানপাট ও শপিংমল বন্ধ করা হলো। জীবন-জীবিকার তাগিদে এ সিদ্ধান্ত তারা মানবেন না বলে ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সমকালকে বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক। কিছু খোলা আবার কিছু বন্ধ রেখে তো লকডাউন হয় না। লকডাউন হলো পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়া। অর্থাৎ পরিবারের সদস্যদের বাইরে অন্যদের সঙ্গে কোনো ধরনের দেখা-সাক্ষাৎ হবে না। সবকিছু বন্ধ থাকবে। এ অবস্থা থাকলে মানুষ উদাহরণ দেখিয়ে অজুহাত খুঁজত না। এতে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে। একটি পর্যায়ে মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। সুতরাং যে উদ্দেশ্যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, তা হোঁচট খেয়েছে।
ভয় জাগাচ্ছে ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ :সরকারি বিধিনিষেধ আরোপের পর ধারণা করা হয়েছিল, আক্রান্ত ও মৃত্যু কমে আসবে; কিন্তু তা হয়নি। বিধিনিষেধ জারির পর আক্রান্ত ও মৃত্যুতে নতুন নতুন রেকর্ড হয়েছে। টানা চার দিন ধরে আক্রান্তের সংখ্যা সাত হাজারের ওপরে ছিল। গত চব্বিশ ঘণ্টায় আক্রান্ত সাত হাজারের নিচে নামলেও মৃত্যুতে রেকর্ড হয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টায় ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এক দিনে এটিই সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা। এতদিন সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ ছিল সোনার হরিণ। এখন সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে সাধারণ শয্যার বেলায়ও একই অবস্থা দাঁড়িয়েছে। হাসপাতালের শয্যা সংকটের মধ্যেই খবর এসেছে যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়া করোনার নতুন ধরন দেশেও মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। গত বছরের জুন-জুলাই মাসে করোনার উচ্চ সংক্রমণের সময়ও প্রায় ৭২ শতাংশ কভিড-১৯ ডেডিকেটেড শয্যা ফাঁকা ছিল। কিন্তু বর্তমানে রাজধানীর কভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর ৯৮ শতাংশ শয্যাই পূর্ণ হয়ে গেছে। আড়াই হাজার শয্যা বাড়িয়ে রোগী সামাল দেওয়া চেষ্টা করছে স্বাস্থ্য বিভাগ। ধারণা করা হচ্ছে, করোনার নতুন ধরন আগের গুলোর তুলনায় মারাত্মক। এ কারণে আক্রান্ত অধিকাংশ মানুষের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়ছে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম সমকালকে বলেন, যে হারে রোগী বাড়ছে, তাতে হাসপাতালে জায়গা দেওয়া কঠিন হবে পড়বে। করোনার নতুন ধরনটির মানুষকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি। এ কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকাংশের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়ছে। এ অবস্থায় সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, মাস্ক ব্যবহার করুন এবং সরকার জারি করা বিধিনিষেধ মেনে চলুন।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে করণীয় কী- জানতে চান বিশেষজ্ঞরা :বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেছেন, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে, আগের জারি করা বিধিনিষেধ পরিকল্পনা করে করা হয়নি। যে কারণে তা ব্যর্থ হয়েছে। জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয় আর সরকারি অন্যান্য কার্যক্রম এক ধারায় চলে না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে তারপরই এসব নির্দেশনা জারি করা উচিত ছিল। কিন্তু সেটি করা হয়েছিল কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। প্রজ্ঞাপন জারির সঙ্গে যুক্তদের কাছে জানতে চাওয়া প্রয়োজন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নতুন করে তারা কী করবেন?
স্বাস্থ অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ সমকালকে বলেন, যে প্রক্রিয়ায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল সেটি বিজ্ঞানসম্মত হয়নি, এটি শুরু থেকেই বলে আসছি। সাত দিনের বিধিনিষেধ কীভাবে দেওয়া হলো? করোনার সুপ্তিকাল এক থেকে ১৪ দিন। একটি ধাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে নূ্যনতম ১৪ দিন এই বিধিনিষেধ আরোপ করে রাখতে হবে। আর দুটি ধাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ২৮ দিন বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। এটিই বিজ্ঞানসম্মত। কিন্তু অবৈজ্ঞানিক এবং পরিকল্পনাহীন প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো। যার কারণে এটি পুরোপুরি হোঁচট খেয়েছে।
করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী সব বিষয়ে নতুন করে ভাবছেন। আরেকটু পরিকল্পনা করে আগামী রোববার নাগাদ হয়তো নতুন নির্দেশনা জারি করা হতে পারে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি তিনি।
দোকানপাট ও শপিংমল খুলে দেওয়ার প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, দোকান ও শপিংমল খুলে দেওয়ার দাবিতে কয়েকদিন ধরে রাস্তায় বিক্ষোভ চলছিল। ওই বিক্ষোভ এখন দোকান মালিকদের নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। একটি অসাধু চক্র সেই বিক্ষোভের ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছিল। এমন পরিস্থিতিতে দোকান ও শপিংমল খুলে দেওয়া হয়েছে। অন্য বিধিনিষেধগুলো আগের মতোই থাকবে। আর দোকান ও শপিংমলে প্রত্যেক ক্রেতা-বিক্রেতাকে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিষয় : লকডাউন
মন্তব্য করুন