উনিশশ আটচল্লিশ-বায়ান্নর ভাষার জন্য সংগ্রাম যেমনি সাংস্কৃতিক, তেমনি রাজনৈতিক। এই দুই-এ একাকার। এই সংগ্রামের চরিত্র বুঝতে হলে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠালগ্নে ফিরে যেতে হয়।

পাকিস্তান ছিল একটি অস্বাভাবিক রাষ্ট্র। ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের দুই অংশ নিয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দুই অংশের মধ্যে কেবল ভৌগোলিক দূরত্বই ছিল না; ছিল জীবনাচার, ভাষা ও সাংস্কৃতিক দূরত্ব। মোদ্দা কথা, ব্রিটিশ শাসনের কবলমুক্ত হয়েও পূর্ববাংলা স্বাধীন হয় না; পাকিস্তানের কাছে নতুন করে শৃঙ্খলিত হয়। আর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রথম আঘাত এলো ভাষার ওপর।

পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২০ মার্চ রেসকোর্স ময়দান (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এবং ২১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেন। তিনি উভয় সমাবেশে একমাত্র উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশ থেকে ছাত্ররা প্রতিবাদ জানাল। একযোগে বলল- নো নো নো। রাজপথে স্লোগান ধ্বনিত হলো- জিন্নাহর ঘোষণা/ মানি না মানি না।

এর আগে ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের আইনসভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবি জানানো হয়, যা অস্বীকৃত হওয়ায় পূর্ববাংলার ছাত্র-জনতা ক্ষুব্ধ হয়। শুরু হয় ভাষা আন্দোলন।

এই আন্দোলনের পেছনে মাতৃভাষার প্রতি জনগণের গভীর মমত্ববোধ তো ছিলই। আরও ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ। আম জনতারও বুঝতে সময় লাগেনি যে, শুধু উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে চাকরির বাজার উর্দুওয়ালাদের দখলে চলে যাবে; বাংলাভাষীরা পিছিয়ে থাকবে। ব্রিটিশ ভারতে হিন্দুদের দাপটে সন্তানদের চাকরি মিলছিল না বলেই তারা পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। জমিদাদের হাত থেকে জমি আর হিন্দু মধ্যবিত্তের কবল থেকে চাকরি- দুই-ই ছিল তাদের আরাধ্য। তাই তো হিন্দু-মুসলমান বিরোধ; লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান আন্দোলন; পরিণতিতে দেশভাগ।

সেই সাধের পাকিস্তানে যখন বাংলা ভাষা ব্রাত্য, তখন রাজনীতির নতুন ধারা সূচিত হয়। বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে হিন্দু ও মুসলমান ছিল মুখোমুখি। আর পঞ্চাশের দশকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তারা একই মিছিলে শরিক হয়। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। গণপরিষদে যখন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষাকে অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা করার দাবি করেন; তাতে পূর্ববাংলার মুসলিম লীগ সদস্যরা সমর্থন জানাননি। তাই ঢাকা ফেরার পথে তিনি ভয়ে ভয়ে ছিলেন। এই ভয়ের মাত্রা বেড়ে যায় যখন দেখেন ঢাকা বিমানবন্দরের গেটে কিছু যুবকের জটলা। তার আশঙ্কা হচ্ছিল, ওরা চাদরের মধ্যে হয়তো ছুরি লুকিয়ে রেখেছে। কাছে এসে দেখলেন, চাদরের ভেতর থেকে ছুরি নয়, ফুলের মালা বের হচ্ছে। সে মালা তাকে ও তার কংগ্রেস সহকর্মীদের গলায় পরিয়ে দেওয়া হলো। এভাবেই শুরু হলো বাংলা ভাষা নিয়ে রাজনীতির নবযাত্রা; হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সংগ্রাম।

১৯৪৮-এ সূচিত ছাত্র-জনতার আন্দোলন '৫২তে বেগবান হয়ে ওঠে। একুশে ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের পর তা গনঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। পাকিস্তান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। সেই সঙ্গে রাজপথের সংগ্রামও নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়।

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আবহমানকালের বাংলা জেগে ওঠে। জারি-সারি, মারফতি, কীর্তন- সবকিছু একাকার হয়ে যায়। বাংলার মানুষ ভারতচন্দ্র-চণ্ডীদাস-লালন-মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বাংলাকে আঁকড়ে ধরে। এই বোধ কেবল সংস্কৃতির চৌহদ্দিতে আটকে থাকে না; রাজনীতিতেও তা প্রতিফলিত হয়। সূচিত হয় অসাম্প্রদায়িক ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারা।


বাংলাকেন্দ্রিক অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারা ব্রিটিশ ভারতেও বহমান ছিল। এতে মূর্তমান ছিল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও ধর্মভিত্তিক হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদের দাপটে তা ছিল ম্রিয়মাণ। তবে ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ঘিরে যে আবেগ-উচ্ছ্বাস ছিল, তা ব্রিটিশ ভারতের রাজনীতিও ছুঁয়েছে। বঙ্গ ভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে রচিত 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গান বাংলার রাজনীতিতেও আলোড়ন তুলেছিল। তবে বাংলাকেন্দ্রিক রাজনীতির নবঅধ্যায় রচনায় উদ্যোগী হয়েছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। ১৯২৩ সালে তার উদ্যোগে হিন্দু-মুসলিম নেতাদের নিয়ে যে বেঙ্গল প্যাক্ট হয়েছিল; তাতে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের চাকরিতে ৬০ শতাংশ নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়। এটি ছিল হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সুযোগের সমতা আনার অনন্য প্রয়াস। ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের অকালমৃত্যুর কারণে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের ধারা ব্যর্থ হয়।

বসু ভ্রাতৃদ্বয়ও (নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও শরৎচন্দ্র বসু) বাংলাকেন্দ্রিক রাজনীতি ও হিন্দু-মুসলমানের মিলনে প্রয়াস ছিলেন। বাংলার রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে হিন্দু-মুসলমান সবার কাছে আদৃত হয়েছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। তবে জমিদারি উচ্ছেদের দাবি তুলে তিনি জমিদার-প্রভাবিত কংগ্রেস নেতাদের বিরাগভাজন হন। ১৯৩৭ সালের বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের পর ফজলুল হক কৃষক প্রজা পার্টি নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এটি কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের ধারায় ছেদ পড়ে। ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদারও কংগ্রেসের এ প্রত্যাখ্যানকে ঐতিহাসিক ভুল বলে আখ্যায়িত করেন। সেদিন কংগ্রেস যুক্ত সরকার গঠনে সম্মত হলে বাংলার ইতিহাস ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে পারত। অবশেষে শেরেবাংলা মুসলিম লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠনে সম্মত হন। হক-লীগ সরকার গঠিত হয়। এক পর্যায়ে শেরেবাংলা মুসলিম লীগে যোগ দেন। এতে তার দল-বল মুসলিম লীগের পেটে চলে যায়। রাজনীতিতে বাড়তে থাকে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ। এর পরও বাংলার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা ও বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ ছিল। অনেক রাজনীতিক সাহিত্যচর্চা করতেন, যাদের সঙ্গে ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির নিবিড় বন্ধন।

চল্লিশের দশকজুড়েই কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ ছিল মুসলিম লীগের ঘাঁটি। সে সময় অধ্যাপনা করতেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত। তার লেখায় জানা যায়, ছাত্ররা সবাই মুসলিম লীগের সমর্থক হলেও তাদের মধ্যে বিভক্তি ছিল। একদিকে উর্দুভাষী, অন্যদিকে বাংলাভাষী। বাংলাভাষীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তাদের নেতা ছিলেন শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু তার 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে লিখেছেন, ১৯৪৬ সালে দিল্লি অধিবেশন ঘিরে সমাবেশ হয়েছিল। সেখানে তারা উর্দু স্লোগানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলায় স্লোগান দিয়েছেন।

বাংলার হিন্দু-মুসলমান নেতারা হাতে হাত রেখেছিলেন ব্রিটিশ শাসনের বিদায়বেলায়; ১৯৪৭ সালের এপ্রিল-মে মাসে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শরৎ বসু, কিরণ শঙ্কর রায় প্রমুখ মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস নেতা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতাদের অসম্মতিতে এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলো না। অবশেষে বাংলা খণ্ডিত হলো। পূর্ববাংলা হলো পাকিস্তানের অংশ।

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে লুপ্তপ্রায় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়া লাগে। ভাষা ও দেশ-বন্দনার মধ্য দিয়ে তা ক্রমেই বেগবান হয়। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বা মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিকল্প ভাবনা হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ জনমনে জায়গা করে নেয়।

ভাষা আন্দালনে ধর্মীয় ধারার তমদ্দিন মজলিস ছিল; কমিউনিস্ট পার্টিও ছিল। সব ছাপিয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী জোয়ার। তবে আন্দোলনে বাম ধারার ভূমিকা অন্যন্য। জাতীয়তাবাদী ও বাম ধারার সমন্বয়ে পূর্ববাংলার মুক্তি সংগ্রাম এগিয়ে যায়। একে হয়ে ওঠে অন্যের পরিপূরক। তবে নেতৃত্বে ছিলেন জাতীয়তাবাদীরাই। বামরা কেন মুক্তিসংগ্রামের হাল ধরতে পারল না, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।

ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানওয়ালাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে। 'ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়'- এই বাণী ছাত্র, শ্রমিক, লেখক, শিল্পী, দোকানি, কেরানি থেকে গ্রামের চাষি, মাঝি, আউল-বাউল এক জোট হয়। এর রাজনৈতিক রূপায়ণ ঘটে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ছাত্র-জনতাই বাংলার তিন প্রধান নেতা শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে এক মঞ্চে নিয়ে আসে। বাংলাকেন্দ্রিক সব দলই যুক্তফ্রন্টে শামিল হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব সাফল্যের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জোয়ার সৃষ্টি হয়। নির্বাচনের পর শাসকের ষড়যন্ত্রের মুখে নেতৃত্ব পথ হারায়। আওয়ামী লীগ ও কৃষক শ্রমিক পার্টি কেন্দ্রের আশীর্বাদ লাভের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। পরবর্তী সময়ে গঠিত মস্কোপন্থি ও পিকিংপন্থি ন্যাপও পাকিস্তানকেন্দ্রিক সমাজতন্ত্র কায়েমের লাইন গ্রহণ করে। বাধাগ্রস্ত হয় বাংলাকেন্দ্রিক রাজনীতির স্বকীয় ধারা।

এক দশকের নিষ্ফম্ফল জমিনে রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল ছাত্র আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিকশিত রাজনীতিকে নতুন গতি দান করেন। স্বায়ত্তশাসন সংবলিত ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ৬ দফার মাঝেই নিহিত ছিল স্বাধীনতার বীজ।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ৬ দফার সংগ্রাম এক দফায় পরিণত হয়। সত্তরের নির্বাচনে ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে গণরায় ঘোষিত হয়। এভাবেই বাংলাদেশ স্বাধীনতার সিংহদ্বারে উপনীত হয়। সংঘটিত হয় মুক্তিযুদ্ধ।

আমাদের সমগ্র মুক্তিসংগ্রামের মূল চালিকাশক্তি বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তবে এ সংগ্রাম শুধু বাঙালি জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সব জাতিসত্তার মানুষ, পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীরা এতে সম্পৃক্ত হয়েছিল। একাত্তরে সব মানুষের সমমর্যদার বাংলাদেশ গঠিত হয়; যার মূলমন্ত্র সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। 

লেখক
মুক্তিযোদ্ধা
প্রাবন্ধিক