ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আমাদের মাঝে নিজস্ব চেতনা বা জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে, যা আজও আমাদের সব আন্দোলন-সংগ্রামে প্রেরণার অন্যতম উৎস হয়ে আছে। আমাদের যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন, দাবি আদায়ের সংগ্রাম, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে উজ্জীবক শক্তি হিসেবে কাজ করে ৫২'র ভাষা আন্দোলন। বাঙালির ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী। এটি পূর্ববাংলাকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের পথ চিনিয়েছে। আমরা বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, আমাদের দেশ বাংলাদেশ- এসব বোধ ভাষা আন্দোলন থেকেই উৎসারিত। তাই তো ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই পরবর্তী সময়ে আমাদের সব আন্দোলন-সংগ্রাম ডালপালা বিস্তার করে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সেই পথেরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্ব্বল অর্জন। তাই আমাদের সংস্কৃতির অন্যান্য অংশের মতো চিত্রকলায়ও ভাষা আন্দোলনের ব্যপক প্রভাব পড়েছে এবং এটা অনিবার্য ছিল।
ভাষা আন্দোলন যখন হলো, ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট বা চারুকলা তখন একেবারেই নবীন পর্যায়ে। ১৯৪৮ সাল থেকে সূচনা হয় ভাষা আন্দোলনের। আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাও সেই '৪৮ সালে। 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা'- মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও খাজা নাজিমুদ্দিনের এই ঘোষাণার পর অন্যান্য ছাত্রের মতো আর্ট কলেজের ছাত্ররাও সে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালে যখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল, সেই সময় আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, ইমদাদ হোসেন, কাইয়ুম চৌধুরী, বিজন চৌধুরীসহ তখনকার সময়ের তরুণ শিল্পীরা খুব সক্রিয়ভাবে সে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই শিল্পীরাই কিন্তু পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশর চিত্রকলার চর্চায় সেরা শিল্পী হিসেবে বিবেচিত। এদের মধ্যে বিজন চৌধুরী পরবর্তী সময়ে কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বরেণ্য শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। বাকি সবাই বাংলাদেশের শিল্পী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
ভাষা আন্দোলনের সময় তরুণ শিল্পীরা যে ছবিগুলো এঁকেছিলেন, তা আন্দোলনের প্রয়োজনেই এঁকেছিলেন। যার অনেকটাই এখন আর খুঁজে পাই না বা ধ্বংস হয়ে গেছে। লিটল ম্যাগাজিনসহ বিভিন্ন প্রকাশনায় যেসব ড্রইং আমরা পাই, সেগুলোর নান্দনিক দিক ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রয়োজনে বা আন্দোলনের জন্য আঁকা হলেও সেসব ড্রইংয়ে শিল্পীরা চিত্রকলার নান্দনিকতা রক্ষা করেই কাজ করেছেন। দুঃখের বিষয়, মুর্তজা বশীর ও আমিনুল ইসলাম ছাড়া বাকিদের ছবি আর পাওয়া যায় না। তখনকার দিনে তাদের চিত্রকলার যে ধরন, সেই ধরন ধরেই কিন্তু তারা এগিয়ে গিয়েছিলেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পকলার ধরন-ধারণ পাল্টায়। ষাট বা সত্তরের দশকে এসে শিল্পকলার ধারা বদলেছে। তাদের চিত্রকলার চর্চায়ও পরিবর্তন এসেছে। তারা নিজস্ব ধরন তৈরি করে নিয়ে কাজ করেছেন।


এখানে কে কী কাজ করেছেন, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো পঞ্চাশের দশকে যে ভাষা আন্দোলন, সেই আন্দোলকে উপজীব্য করেই সবাই নিজেকে নির্মাণ করেছেন। উদ্বুদ্ধ বা উজ্জীবিত হয়েছেন ভাষা আন্দোলন থেকে। দেশাত্মবোধ বলি কিংবা ভাষা বা সংস্কৃতি, সবকিছুই এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এবং নিজস্বতা নিয়ে এগিয়ে গেছে। একটার সঙ্গে আরেকটা অঙ্গাঙ্গী যুক্ত বলেই এটা হয়েছে। আর এর সঙ্গে নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তো ছিলই। আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনে নিজস্ব সংস্কৃতির এই বিকাশ খুব কার্যকর ও সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। শিল্পীরাও একইভাবে কাজ করেছেন। তাদের কর্মকাণ্ড এবং চিত্রকলায় পঞ্চাশের দশকের ভাষা আন্দোলন উজ্জীবক প্রভাব হিসেবে কাজ করেছে। আমরা জানি, শিল্পচর্চা বা চিত্রকলার চর্চায় আন্তর্জাতিক যে ধরন-ধারণ চলে, সেগুলো আমাদের দেশের শিল্পীরাও করেছেন। কিন্তু চর্চাকে বেগবান করার যে বিষয়টি, সেটি এসেছে বায়ান্ন থেকে।
এদেশের শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীতসহ সুকুমারবৃত্তির প্রতিটি ধারার জন্য বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকটা ছিল রেনেসাঁ। এখান থেকে আমরা ভাষা পেয়েছি, কবিদের পেয়েছি, সঙ্গীতের মানুষদের পেয়েছি। আমাদের চিত্রকলার ক্ষেত্রেও ঠিক এটাই হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নানা আন্দোলন-সংগ্রামে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পৌঁছাই। স্বাধীনতা পাই। স্বাধীনতার পর চিত্রকলা বা শিল্পকলা খুব স্বাভাবিকভাবেই এক ভিন্নমাত্রার গতি পেয়েছে। কিন্তু যখনই শিল্পকলার এই চর্চার কথা ভাবতে যাই, পেছন ফিরে দেখি, ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেই তার গোড়াপত্তন।
দেশে এখন বিভিন্নভাবে কাজ হচ্ছে। নানা মাধ্যম, নানা ধরনে একেক শিল্পী একেকভাবে কাজ করছেন। এখন কোনো শিল্পী যখন কাজ করতে বসেন, সেটা ভাস্কর্য শিল্পী, চিত্রশিল্পী বা মৃৎশিল্পী; যিনিই হোন; তিনি যে সব সময় আন্দোলনের কথা স্মরণ করে কাজ করতে বসেন, বিষয়টা তেমন নয়। আমাদের শিল্পীদের মেধা-মনন, চেতনায় সেটা তৈরি হয়ে গেছে, যার উৎস ভাষা আন্দোলন।
লেখক
চিত্রশিল্পী