মায়ের হাসির চেয়ে প্রিয় আর কী হতে পারে! মায়ের পানের বাটা থেকে একটুখানি পান নিয়ে আলতো করে মুখে পুরে দিতে মন আনচান করে। কিন্তু যে আমার মা নয়, তার পানের বাটাই বলি আর কোলই বলি, সে নিয়ে আমার তেমন আগ্রহ থাকে না।

আমার মাতৃভাষার বিষয়টাও তেমনই। আমার কাছে যত প্রিয়, অন্য ভাষাভাষীর কাছে তেমন নয়। কিন্তু বৈষয়িক দিক দিয়ে যদি পুরো চিত্র পাল্টে কথা বলি, তবে অন্যের মায়ের গয়নার বাক্সেও আমার নজর পড়তে পারে। ভিনদেশি মায়ের ব্যাংক ব্যালেন্সের খোঁজে তার চেকবই নিয়ে নাড়াচাড়া করতে বেশ ইচ্ছা জাগতেও পারে। এটা হলো মানব মনে বৈষয়িক হিসাব-নিকাশ।

এটিকে সূত্র মেনে বলতে চাই, বাণিজ্যিক লেনদেন করে নিজের মুনাফা বৃদ্ধি করতে যে ভাষায় যোগাযোগ করতে হয়, সে ভাষার বাণিজ্যিক মূল্য তৈরি হয়। যখন এভাবে একটি ভাষার বাণিজ্যিক মূল্য সৃষ্টি হয়, তখন সে ভাষায় লেখা সাহিত্য, লোকজ জীবনপ্রবাহ, নানাবিধ শিল্পকর্ম আরেকটি দেশের, জনপদের মানুষের কাছে গুরুত্ব লাভ করে।

বাংলাদেশের ৫০ বছর বয়সেও বিশ্বব্যাপী তার কোনো অর্থনৈতিক শক্তির প্রভাব নির্ণীত হয়নি এখনও। এখনও বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় দুই হাজার ৬৪ ডলার। তার আগের অর্থবছরে মাথাপিছু গড় আয় ছিল এক হাজার ৯০৯ ডলার। অর্থাৎ, দেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় এক বছরের ব্যবধানে ১৫৫ ডলার বেড়েছে।

অর্থনৈতিক শক্তিতে পিছিয়ে থাকার কারণে অন্যান্য দেশের মানুষের কাছে বাংলা ভাষার বাণিজ্যিক গুরুত্ব কম বা তেমন নয়। অন্যদিকে সারাবিশ্বে বাড়তি মর্যাদা পেতে হলে জাতিসংঘে বাংলা ভাষার দাপ্তরিক মর্যাদা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে, ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তি লাভ করে। যদিও এর আগে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের ৩০তম অধিবেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আরও পেছনে ফিরে গেলে রবীন্দ্রনাথের নোবেল কিংবা সত্যজিৎ রায়ের অস্কার জয়ের কথা বলতে হয়। তবে মূলত গত এক দশক ধরে বাংলাদেশে ও বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের মধ্যে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবিটি জোরালো হচ্ছে।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা করার জন্য তারা প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন এবং এর বাস্তবায়নে জোরদার কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা বর্তমানে ছয়টি- ইংরেজি, ফরাসি, রুশ, স্প্যানিশ, চীনা ও আরবি। ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ, রুশ ও চায়নিজ ভাষা ১৯৪৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। একই বছর ২৪ জুন শুধু ইংলিশ ও ফ্রেঞ্চ ভাষা নিরাপত্তা পরিষদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। অন্যদিকে রুশ ও স্প্যানিশ ভাষা নিরাপত্তা পরিষদের ভাষা হিসেবে স্থান পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২২ জানুয়ারি ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত। চীনাদের মান্দারিন ভাষা নিরাপত্তা পরিষদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার শুরু হয় ১৯৭৪ সালে। সবশেষে আরবি ভাষা জাতিসংঘের ষষ্ঠ দাপ্তরিক ভাষার তালিকাভুক্ত হয় ১৯৭৩ সালে। আর নিরাপত্তা পরিষদের ভাষা হিসেবে কার্যক্রম শুরু হয় ২১ ডিসেম্বর ১৯৮২ সালে।

এ পথপরিক্রমায় বাংলা ভাষায় বিশ্বব্যাপী মর্যাদা পেতেও সময় নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। এটা বাস্তবতা। পুরো প্রসঙ্গকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করতে গিয়ে দেখতে পাই বর্তমানে বিশ্বজুড়ে চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্য। বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষার অধুনা গুরুত্ব বিষয়টিকে যেহেতু অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে বিশ্নেষণ করতে পছন্দ করছি, সেহেতু চীনের অর্থনৈতিক বিকাশের ধারাটিকে স্বল্প পরিসরে দেখতে পেলে ভালো হয়। চীনা অর্থনীতিবিদ ক্রিস লিয়ং বলেছেন, 'কমিউনিস্ট পার্টি যখন চীনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে, তখন দেশটি খুবই গরিব একটি দেশ ছিল। ব্যবসা করার জন্য তাদের কোনো অংশীদার ছিল না। কারও সঙ্গে ছিল না কূটনৈতিক সম্পর্ক। তারা শুধু নিজেদের ওপরেই নির্ভরশীল ছিল।'

গত ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে চীন তাদের বাজার অর্থনীতিতে একের পর এক যুগান্তকারী সংস্কার ঘটিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য নতুন নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের কবল থেকে বের করে এনেছে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের আন্তর্জাতিক প্রধান অর্থনীতিবিদ ডেভিড মান বলেছেন, '১৯৭০-এর দশকের শেষদিক থেকে তার পরের সময়ে আমরা দেখি, বিশ্বের অর্থনৈতিক ইতিহাসে চীনের অর্থনীতি এক অলৌকিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।'

চীনের অর্থনৈতিক শক্তি ও পরিচালনা এমন অবস্থায় রয়েছে যে, করোনাকালে সারাবিশ্বের অর্থনীতির বড় ক্ষতি হলেও চীনের অর্থনীতির ওপর খুব বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। অতিমারির অতীত পেছনে ফেলে ২০২৮ সালেই আমেরিকাকে ছাপিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে উঠে আসবে চীন। ব্রিটেনের অন্যতম শীর্ষ অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা সংস্থা 'সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ' বার্ষিক রিপোর্টে এমনটাই বলেছে। গত ডিসেম্বরের শুরুতে একই ইঙ্গিত দিয়েছিল জাপানের সেন্টার ফর ইকোনমিক রিসার্চ। তারা জানিয়েছিল, ২০২৮ অথবা ২০২৯ সালের মধ্যেই আমেরিকাকে ছাপিয়ে যাবে চীন।

সুতরাং সবাই জানে, এখন চীনা ভাষা জানা মানে আগামী দিনে বিশ্বের অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার চীনের সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্যে সফলতা। ফলে চীনা ভাষার প্রতিও বিশ্বের মানুষের মনোযোগ অনেক। চীন যদি নিজের অর্থনৈতিক শক্তিকে জোরালো করতে সফল না হতো, তবে চীনা ভাষার প্রতিও সারাবিশ্বের মানুষের ব্যাপক আগ্রহ থাকত না। এটা সত্য, চীনের হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতি অসংখ্য মানুষের ঝোঁক ছিল এবং আছে বলেই সে ভাষার প্রতিও যথেষ্ট আগ্রহ ছিল ও আছে। কিন্তু অর্থনৈতিক উল্লম্ম্ফনের কারণে চীনা ভাষার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে প্রবল। বলা ভালো, ওদের ভাষাটির একটি দাপট জন্ম নিচ্ছে। এই হলো জাদুর খেলা। টাকা পকেটে থাকলে সকলে পুছে।

এ হিসাবটায় আলো ফেলে বলতে চাই, যখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তি বিকশিত হবে, তখন বাংলা ভাষা শেখার প্রতিও অন্যান্য দেশের মানুষের আগ্রহ বেড়ে যাবে। তাহলে সেখান থেকে আমরা কতটা পিছিয়ে? এ নিক্তিতেই এবার বলি, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়াবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারের বেশি। ওই সময়ে হতদরিদ্রের হার কমে শূন্যের ঘরে নেমে আসবে। আর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে 'বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১' শীর্ষক প্রতিবেদনে এই লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) তৈরি এ প্রতিবেদনটিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন দিয়েছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নীত হবে। বর্তমান বাজারমূল্যে তখন মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ১২ হাজার ৫০০ ডলারের বেশি, যা বর্তমানে এক হাজার ৯০৯ ডলার। এ ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে হতদরিদ্র নির্মূল হবে (৩ শতাংশে নামলে নির্মূল বলা হয়)। আর ২০৪১ সালে হতদরিদ্রের হার কমে দশমিক ৬৮ শতাংশ হবে, যা বর্তমানে ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ২০৪১ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। এই হার বর্তমানে ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ।

বর্তমানে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির ৩২ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা ২০৩০ সালে বেড়ে দাঁড়াবে জিডিপির ৪০ দশমিক ৬০ শতাংশে। আর ২০৪১ সালে মোট বিনিয়োগ দাঁড়াবে ৪৬ দশমিক ৮৮ শতাংশে।

সুতরাং ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশে তার অর্থনৈতিক শক্তি বিকাশে একটি সঠিক নেতৃত্বে; একটি সঠিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারায় এগিয়ে চলেছে। এই যে অর্থনৈতিক চলমানতা বাড়ছে এবং বাড়বে, তা করতে হলে তো বিশ্বের অসংখ্য দেশের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হয় এবং তা হবে ভাষার মাধ্যমেই। সে ভাষাটি কি বাংলা? না, তা নয়। এখনও নয়। এখনও ইংরেজি দিয়েই কাজ চলছে। তবে সময় আসবে বাংলা ভাষার জন্য একটি পর্যাপ্ত মর্যাদালাভের, যখন বিশ্বের অনেক দেশের মানুষই বাংলা ভাষায় যোগাযোগ করবে; সে সময়টিই হলো বাংলাদেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে একদিন শক্তিশালী হয়ে উঠবে, তখন।

এটাও ঠিক, বাইরের দেশের যেসব মানুষ এখন আমাদের এখানে বেড়াতে আসে, তাদের কারও মাঝে ছোট্ট প্রচেষ্টা থাকে বাংলায় কথা বলার। তবে এটা একবারেই ট্যুরিজম ভাষা, ভ্রমণ করার ভাষা। বাণিজ্য ভাষা নয়।

আমাদের দেশ থেকে বাণিজ্য করার জন্য বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো আলোচনায় যোগ দিতে অথবা আগ্রহ প্রকাশের সিদ্ধান্তগুলোকে পরিপকস্ফ করতে যে যোগাযোগ হয়, তা তো বর্তমানে দাপুটে আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজিতেই হয়। এ স্তরকে আরও এগিয়ে দিতে মূলত ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাঙ্গনগুলো অগ্রণী। এর পুরো বিষয়কে পৃষ্ঠপোষকতা করছে ধনিক শ্রেণি। ফলে নতুন প্রজন্ম কিন্তু মাতৃভাষায় যোগাযোগ করতে মনোযোগী হতে পারছে না বা আগ্রহীও হচ্ছে না। তারা বাংলা শিখছে না। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হতে হলে কিংবা সমাজে প্রতাপ জাহির করতে হলে শিখতে হবে ইংরেজি- এটাই তাদের মগজে ঘোর। কেন তারা এমন হয়ে উঠছে? এর পেছনে রাষ্ট্রীয় নীতি ব্যর্থতা, বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের দৈন্য প্রকট।

সম্প্রতি গুগল মামা বাংলাকে অনুবাদ করে দিচ্ছে বা অন্য ভাষাকেও বাংলায় পাঠ উপযোগী করতে যান্ত্রিক সহায়তা করছে। কিন্তু সেসব একেবারেই অখাদ্য। এমন অনুবাদে মূল সুরটি বোঝা যায়। কী বলতে চায় লেখক, এতটুকুই। এর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষত ফেসবুকে যে কোনো পোস্টের ইদানীং অনুবাদও আসছে। কিন্তু এ দিয়ে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে যোগাযোগের মাধ্যম ভাষা হিসেবে দেখতে পাওয়ার আশা মরীচিকা।

তাহলে বলার এই, বাংলা ভাষার কৌলীন্য এখনও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জায়গা পায়নি। বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য যোগাযোগে অপরিহার্য ভাষা হয়ে ওঠেনি। যতক্ষণ বাংলা ভাষা বাণিজ্য ভাষা হয়ে না উঠবে, ততক্ষণ আমাদের মাতৃভাষা কেবল আমাদের মাতৃভাষাই হয়ে থাকবে এবং আমাদের শিল্প-সাহিত্যও তেমন গুরুত্ব লাভ করবে না। এর সবকিছুতে পরিবর্তন আনতে হলে আমাদের চিন্তার সামগ্রিক প্রেক্ষিতে পরিবর্তন দরকার। এখনই বড় প্রয়োজন বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য যোগাযোগের ভাষার আসনে অধিষ্ঠিত করতে বাস্তবোচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
লেখক
কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

বিষয় : বাংলা ভাষা হোক বাণিজ্য ভাষা

মন্তব্য করুন